কাউকে অসুস্থ দেখাটা খুবই কষ্টের । কিন্তু তার চেয়েও বেশি কষ্টের চিকিৎসার খরচ জোগাতে সেই ব্যক্তির নাস্তানাবুদ হওয়া দেখা । কেউ হাসপাতালে ভরতি হলেই তাঁর নিকটাত্মীয়দের হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় । চিকিৎসার খরচ বহন করতে না পেরে অনেক রোগীর পরিবার ধারে ডুবে যায় । ওষুধের ক্রমবর্ধমান খরচ, চিকিৎসকের ফি, বিভিন্ন পরীক্ষার খরচ... সব মিলিয়ে মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস অবস্থা । বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী দশকে সারা বিশ্বে, বিশেষ করে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে চিকিৎসার খরচ ক্রমেই বাড়বে । তাহলে এই জ্বলন্ত সমস্যার সমাধান কী? এর সঙ্গে লড়াই করার উপায় কী? অসুস্থতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে কী ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত?
সমীক্ষা বলছে, শুধুমাত্র চিকিৎসার খরচ বহন করতে না পেরে দেশের অন্তত 7 শতাংশ পরিবার প্রতি বছর দারিদ্রের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। আগামী এক দশকে চিকিৎসা খরচ গড়ে 5.5 শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে ।
দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ
1. আধুনিককালে হার্ট অ্যাটাক, ক্যানসারের মতো ভয়ঙ্কর রোগের প্রকোপ বেড়ে চলেছে বিশ্বজুড়ে । চিন্তার বিষয় হল এর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বয়স কোনও বাধাই হচ্ছে না ।
2. আধুনিক থেরাপিটিক চিকিৎসার খরচ খুবই বেশি ।
3. ওষুধের দাম এবং পরীক্ষার খরচ প্রতি বছর বেড়েই চলেছে । শুধু ওষুধের খরচেই 52 শতাংশ চিকিৎসা খরচ বেড়ে যায় ।
4. প্রবীণদের প্রতিদিনের ওষুধের খরচ বাড়ার সঙ্গে চিকিৎসা খরচও ক্রমেই বেড়ে চলেছে ।
যতক্ষণ পর্যন্ত একজন মানুষ সুস্থ ও সবল থাকছেন সবকিছুই ঠিক থাকে । কিন্তু যে মুহূর্তে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন, সমস্যার শুরু হয় । চিকিৎসকের ফি, পরীক্ষার খরচ, চিকিৎসার খরচ, ওষুধের খরচ... সব মিলিয়ে পুরো পরিবার ঋণের জালে জর্জরিত হয়ে পড়ে । চিকিৎসার খরচ জোগাতে 20 শতাংশ পরিবারকে তাঁদের সম্পত্তির একাংশ বিক্রি করে দিতে হয় । আসন্ন দশকে এই ছবিটাই আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে চলেছে । কতটা সহজে এই ভয়ঙ্কর বিপর্যয় সামলানো যায়, আজকের প্রজন্মের কাছে সেটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ।
ভারত থেকে ব্রিটেনে কাজে ফেরার পর এক চিকিৎসককে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, দুই দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রধান পার্থক্য কোথায়, তখন তিনি খুবই চমকে দেওয়া উত্তর দেন । তিনি বলেন, "ব্রিটেনে যখন কোনও রোগী চিকিৎসকের কাছে উপস্থিত হন তখন চিকিৎসকের প্রধান লক্ষ্য থাকে রোগটাকে চিহ্নিত করা, ঠিক কোন পদ্ধতিতে চিকিৎসা করলে দ্রুত আরোগ্য সম্ভব তা দেখা এবং রোগটি সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে সঠিক পরীক্ষা দেওয়া । একইরকম অবস্থায়, ভারতে কোনও রোগী গেলে চিকিৎসককে প্রথমেই তাঁর আর্থিক অবস্থার বিষয়টি দেখতে হয় । দেখতে হয়, যে পরীক্ষাগুলির প্রয়োজন, সেগুলি তিনি আদৌ করাতে পারবেন কি না এবং তিনি সরকারি কোনও সুবিধা পাওয়ার উপযুক্ত কি না । এটাই দুই দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে আমার দেখা সবচেয়ে বড় পার্থক্য ।" শুধুমাত্র এই একটি মন্তব্য থেকেই দেশের সাধারণ মানুষের চিকিৎসার ভয়ঙ্কর ছবিটা ধরা পড়ে । দেশের 70 শতাংশ মানুষকে ওষুধের জন্য বেসরকারি ক্ষেত্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় এবং এদের বেশিরভাগেরই কোনও চিকিৎসা বিমা থাকে না । ডেঙ্গির মতো জ্বরের ক্ষেত্রেও পরিবারের হাসপাতালের খরচ চালাবার ক্ষমতা থাকে না এবং তাঁরা ঋণ নিতে বাধ্য হন ।
আমরা কী করতে পারি?
বেড়ে চলা চিকিৎসা খরচ মোকাবিলা করা দেশের উচ্চবিত্তের কাছে তেমন সমস্যার নয় । গরিবদের চিকিৎসার খরচের জন্য সরকারি প্রকল্প, যেমন আরোগ্যশ্রী বা আয়ুস্মান ভারতের মতো ব্যবস্থা রয়েছে । সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থায় যারা চাকরি করেন তাঁদের রয়েছে চিকিৎসা বিমা এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত টাকা পাওয়ার ব্যবস্থা । পড়ে থাকে শুধু মধ্যবিত্ত সেই শ্রেণি যাদের না আছে কোনও বিমা, না আছে সরকারি কোনও প্রকল্প । এই অবস্থায়, বেড়ে চলা চিকিৎসা খরচ মোকাবিলা করার জন্য আমাদের তৈরি থাকতেই হবে ।
স্বাস্থ্য সচেতনতা
স্বাস্থ্য সচেতনতা যত বাড়বে রোগের আশঙ্কাও ততই কমবে । তাই সবাইকে বুঝতে হবে, স্বাস্থ্য ভালো রাখা, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, নিয়মিত শরীরচর্চা, পরিচ্ছন্নতা সুস্থ থাকতে কতটা জরুরি । এই সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে ছোটোবেলা থেকেই ।
আগাম স্বাস্থ্য পরীক্ষা
রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগে সামান্য কয়েকটি পরীক্ষার মাধ্যমে আগাম সতর্ক থাকার থেকে ভালো কিছু হয় না । এই আগাম পরীক্ষাগুলো বহু জটিল রোগ, এমনকী ক্যানসারও সারিয়ে তুলতে পারে । এই ধরনের আগাম পরীক্ষা করানোর বিষয়টি এখনও পর্যন্ত শুধুমাত্র উচ্চবিত্তদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ । এটিকে মধ্যবিত্ত ও গরিবদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে হবে ।
স্বাস্থ্য বিমা
বেড়ে চলা চিকিৎসা খরচ মোকাবিলায় সবচেয়ে বড় অস্ত্র হতে পারে স্বাস্থ্য বিমা । এই মুহূর্তে সারা দেশে মোট চিকিৎসা বিমার পরিমাণ 2 কোটি 7 লাখ, সুবিধাভোগীর পরিমাণ 47 কোটি 20 লাখ । অর্থাৎ বাকি বহু কোটি মানুষের কোনও স্বাস্থ্য বিমা নেই । এদের মধ্যে অনেকে 2-3 বছর বিমার টাকা দিয়েও তা আর সম্পূর্ণ করেন না । ফলে অসুস্থ হলে চিকিৎসার বিপুল খরচ দিতে হয় নিজের পকেট থেকে । কিন্তু এই বিষয়টা সব সময় মনে রাখতে হবে যে, বিমার প্রিমিয়ামের পরিমাণ সব সময়ই চিকিৎসার খরচের থেকে কম হয় ।
- আমাদের বর্তমান অবস্থা (বিভিন্ন সমীক্ষার উপর ভিত্তি করে)
- 2000 সাল থেকে 2014 সালের মধ্যে চিকিৎসা খরচ বেড়েছে 370 শতাংশ
- পরবর্তী দশকে এর ঠিক কত গুণ খরচ বৃদ্ধি পাবে, তা ভাবাই অসম্ভব ।
- বিভিন্ন দেশে সরকার যে পরিমাণে চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করে : ব্রিটেন 83 শতাংশ, চিন 56 শতাংশ, অ্যামেরিকা 48 শতাংশ, ব্রাজিল 46 শতাংশ, ইন্দোনেশিয়া 39 শতাংশ, ভারত 30 শতাংশ । বাকি খরচের পুরোটাই রোগীকে বহন করতে হয় ।
- নিজেদের চিকিৎসার খরচ নিজেরাই বহন করতে পারেন : অ্যামেরিকা 13.4 শতাংশ, ব্রিটেন 10 শতাংশ, চিন 13.4 শতাংশ এবং ভারতে 62 শতাংশ ।
- স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সরকার গত বছর খরচ করেছে 1657 কোটি টাকা ।
- গত বছর বেসরকারি ক্ষেত্রে গড়ে প্রতি রোগীর খরচ 31 হাজার 845 টাকা ।