দিল্লি, 18 নভেম্বর : দেশের মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেন যাঁরা, দুর্ভাগ্যের বিষয় তাঁরাই খাদ্য নিরাপত্তার অভাবে ভুগছেন ৷ আশাহত হয়ে মৃত্যুকে বেছে নিচ্ছেন ৷ কারণ গত 25 বছর ধরে সরকার কৃষকদের সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ ৷ সম্প্রতি জাতীয় অপরাধ পরিসংখ্যানের তথ্যানুসারে, 2016 সালে গোটা দেশে 11,379 জন কৃষক এবং খামার শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন । NCRB (ন্যাশানাল ক্রাইম রেকর্ড বিওরো ) রিপোর্টে কৃষক আত্মহত্যার কারণ কী তা বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হয়েছে ।
NCRB-র রিপোর্ট অনুযায়ী গড় হিসেব বলছে প্রতিদিন 31 জন এবং প্রতিমাসে 948 জন কৃষক আত্মহত্যা করছেন । আত্মহত্যার হার 2014 সালে 12,360 জন থেকে বেড়ে 2015 সালে পৌঁছেছিল 12,602 জনে । শেষ কয়েক বছর ধরে কৃষক মৃত্যুর হিসেবে সবার শীর্ষে রয়েছে মহারাষ্ট্র ৷ সেখানে 2016 সালে আত্মহত্যা করেছিল 3661 জন । এর পরেই রয়েছে কর্নাটক - 2078 জন, মধ্যপ্রদেশ - 1321 জন, এবং অন্ধ্রপ্রদেশ - 804 জন । রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে কৃষক মৃত্যুর হার 21 শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ খামার শ্রমিকের মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পেয়েছে 10 শতাংশ ।
NCRB-র রিপোর্টে কৃষক আত্মহত্যার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে- শস্যহানি, রোজগার নেই, রোজগার কমে যাওয়া, ঋণ, পারিবারিক সমস্যা এবং শারীরিক অসুস্থতাকে ৷ ঋণ পরিশোধ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যখন কৃষকদের আর্থসামাজিক কাঠামো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে । এই রিপোর্টে পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে ৷ বাকি রাজ্যগুলিতে 6270 জন কৃষক এবং 5109 খামার শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন ।
NCRB-র প্রকাশিত রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে, 1995 থেকে 2016 সালের মধ্যে 3 লাখ 30 হাজার 407 জন কৃষক আত্মহত্যা করেছে । এ প্রসঙ্গে IAS অফিসার P C বোধ তাঁর পর্যবেক্ষণ এবং অনুমানের প্রেক্ষিতে জানিয়েছেন, এই হারে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটতে থাকলে 2020 সালের মধ্যে সংখ্যাটা চার লাখে পৌঁছে যাবে । বৃষ্টিপাতের স্বল্পতা, জলের অভাব, বর্ষাকালে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ার মতো ঘটনা কৃষকদের সমস্যা প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে চলেছে । ঠিক মতো ফসল উৎপাদন করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণে তারা নিজেদের জীবন শেষ করে দিতে বাধ্য হয় । ফসল ঠিক মতো উৎপাদিত না হলে ব্যাঙ্কের ঋণের বোঝা ক্রমশ বাড়তে থাকে ৷ জমানো টাকা প্রতি মুহূর্তে কমতে থাকে ৷ ফসল মজুত রাখার ক্ষেত্রেও সমস্যা তৈরি হয় ৷ যার ফলে ফসল নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয় ৷ এ রকম একাধিক সমস্যার সামনে পড়তে হয় কৃষকদের । 2013 থেকে 2018 সালের মধ্যে মহারাষ্ট্রে 15,356 জন কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৷ তিনমাস আগে ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ বহু কৃষকের প্রাণ কেড়েছিল । এখন আবার মারাত্মক বন্যার কবলে । শুধুমাত্র মহারাষ্ট্র নয়, গোটা দেশের কৃষকরাই এ রকম সমস্যার সামনে ।
এ বছরে 280 জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন ৷ এই খবর প্রকাশিত হওয়ায় তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল কৃষক সংগঠন ৷ কারণ প্রতি বছর কমপক্ষে হাজার কৃষকের আত্যহত্যার ঘটনা ঘটে থাকে । 17 টি রাজ্যে খামার শ্রমিকের আত্মহত্যার ঘটনা কৃষক মৃত্যুর থেকেও বেশ কিছুটা বেশি, যা তুলে ধরে গ্রামীণ কৃষি ব্যবস্থার ভয়ঙ্কর অবস্থা । এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, এ ক্ষেত্র সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত জরুরি ৷ পাশাপাশি একদম নিচুতলার কৃষক এবং খামার শ্রমিকদের আর্থিক সাহায্যের জন্য কিছু পদক্ষেপ যেমন বিমা করা উচিত । এমন কিছু বিমা কার্যকর করা উচিত যাতে 2022 সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার ক্ষেত্রে তা কার্যকর হতে পারে ।
কেন্দ্রীয় সরকার কৃষকদের প্রতিবছর আর্থিক সাহায্যের জন্য বিশেষ প্রকল্প আনছে ৷ এতে তাঁরা বছরে 6000 টাকা ভর্তুকি পেতে পারেন । ব্যক্তিগত বিনিয়োগ, কৃষি চুক্তি, কৃষি উৎপাদন, বিক্রির জন্য বাজারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির দিকে নজর দেওয়া এবং কৃষকদের উন্নতির কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে । মাস চারেক আগে মহারাষ্ট্রে যখন দেবেন্দ্র ফড়নবিশ মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, সে সময় একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়েছিল ৷ যদিও তার ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত । এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয়, কৃষক সম্প্রদায়ের সহায়তার জন্য সংসদে পরিকল্পিত ভাবে কোনও অধিবেশন ডাকা হয়নি ৷ যেখানে কৃষকদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা হতে পারে ৷ পরিসংখ্যান বলছে, 2015 সালে 80 শতাংশ কৃষক ঋণ নিয়েছিল ব্যাঙ্ক বা ছোটো বিনিয়োগকারী সংস্থার কাছ থেকে । বর্তমান সমবায় ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা আসল সমস্যা সমাধানের থেকে অনেকটাই দূরে । আবহাওয়ার পরিবর্তনগত সমস্যাও একটি জটিল সমস্যা তৈরি করেছে । আবহাওয়ার পরিবর্তনগত সমস্যার হাত থেকে কৃষকরা কী ভাবে নিজেদের ফসল রক্ষা করবেন, সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য মুম্বই IIT-র গবেষকরা বিভিন্ন রাজ্যে আঞ্চলিক স্তর থেকে শুরু করে বিভিন্ন জেলায় সফর করেছেন । এ প্রসঙ্গে কেরলের পোক্কালি মডেল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং আবশ্যক বলে বিজ্ঞানীরা পরামর্শ দিয়েছেন । এখন সময় এসেছে কৃষির সঙ্গে বিজ্ঞানের মেলবন্ধন ঘটানোর ৷ কৃষকদের জীবনকে সুরক্ষিত করা, যাতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত থাকে ।