ETV Bharat / bharat

আস্থা বনাম বিভ্রান্তি : কৃতিত্ব তুলে ধরবে এলডিএফ; ইউডিএফ-এর ইশু শবরীমালা - Confidence vs confusion

মঙ্গলবার, কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ক্যাম্পাস পরিদর্শনের তাঁর যাত্রার সূচনা করেছেন । লক্ষ্য, রাজ্যে উচ্চশিক্ষার ছবিটা ঠিক কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে পড়ুয়াদের মতামত জানা । রাজ্যের প্রধান প্রধান কিছু বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ঘুরে দেখবেন তিনি এবং পড়ুয়াদের সঙ্গে কথাও বলবেন । তাঁর উদ্দেশ্য হল এমন একটি উচ্চশিক্ষা পরিকল্পনা তৈরি করা যা তারা আসন্ন বিধানসভা ভোটে লেফ্ট ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (এলডিএফ) নির্বাচনী ইস্তেহারের অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে । অন্যদিকে, কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন প্রধান বিরোধী জোট, ইউনাইটেড ডেমোক্র‌্যাটিক ফ্রন্ট (ইউডিএফ) শবরীমালায় মহিলাদের প্রবেশের বিষয়টিকে নির্বাচনে ইশু করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে । এই বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই বহুবার বিতর্ক ছড়িয়েছে এবং বর্তমানে এটি আদালতের বিচারাধীন বিষয় । কিন্তু এটিই হল ইউডিএফ-র নির্বাচনী প্রচারের প্রধান বিষয়বস্তু । এনিয়ে লিখেছেন কে প্রবীণ কুমার ।

আস্থা বনাম বিভ্রান্তি
আস্থা বনাম বিভ্রান্তি
author img

By

Published : Feb 4, 2021, 12:51 PM IST

ইউডিএফ ঠেকে শিখেছে যে এলডিএফ সরকারের বিরুদ্ধে সোনা পাচার, লাইফ মিশনে দুর্নীতি এবং আইটি দপ্তরে অনিয়ম প্রভৃতি বিষয় তুলে স্থানীয় নির্বাচনে তারা বিশেষ সাফল্য পায়নি । আর তাই তারা নির্বাচনের প্রধান বিষয়বস্তু হিসাবে সেই শবরীমালাতেই ফিরে এসেছে ।

ক্ষমতায় এলে বিরোধী জোট কী করতে পারে আর তাদের বিরুদ্ধে তোলা রাজনৈতিক অভিযোগ এই দুই বিষয়ে নির্বাচনী প্রচার চালানোর সাধারণ কৌশল অনুসরণ করার পরিবর্তে এলডিএফ মূলত নির্বাচনী ট্র‌্যাকে হাঁটছে গত পাঁচ বছরে তারা কী কী করতে পেরেছে এবং যে সব উদ্যোগ ইতিমধ্যেই গৃহীত হয়েছে, পরবর্তীকালে তাতে আরও কীভাবে উন্নতি করা যায়, তা নিয়ে প্রচার চালিয়ে । আসন্ন বিধানসভা ভোটে দ্বিতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় আসার লক্ষ্যে এলডিএফের মূল স্লোগান হতে চলেছে ‘বিকাশের জন্য ভোটদান’ ।

সম্প্রতি স্থানীয় ভোটে এই একই নির্বাচনী প্রচার মডেল অনুসরণ করেই এলডিএফ বিপুল জয় হাসিল করেছে । এই সরকার বিরোধীদের তোলা অভিযোগের ফাঁদে পড়েনি অথচ ভোটারদের যা বোঝাতে চেয়েছিল, তা করতে পেরেছে এই বার্তা দিয়ে যে নিজের চারপাশে তাকিয়ে পরিবর্তন দেখুন । ভোটাররা যারা ইতিমধ্যেই কোভিড প্যানডেমিকের সময় এবং বন্যার সময় গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে বিনামূল্যে ‘প্রভিশন কিট’ পেয়েছে, তাদের আর আলাদা করে সরকারের উদ্যোগ নিয়ে বোঝাতে লাগেনি ।

স্থানীয় নির্বাচনের পরে একটি সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন বলেছিলেন, “সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা বলে এবং ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে বিদ্বেষমূলক প্রচার চালানো হয়েছিল । কিন্তু মানুষ এতে কান দেয়নি । তারা সরকার পরিচালিত কল্যাণমূলক এবং বিকাশমূলক কার্যকলাপকে সমর্থন করেছে । তারা চেয়েছে, সরকার এই ভালো কাজের ধারা অব্যাহত রাখুক ।”

সুতরাং এই বার্তা এখন জোরালো এবং স্পষ্ট যে এলডিএফ তাদের নির্বাচনী প্রচার, সরকারের বিরুদ্ধে তোলা বিরোধীদের অভিযোগের উপর ভিত্তি করে করবে না বরং গত পাঁচ বছরে একের পর এক প্রতিবন্ধকতা যেমন নিপ্পা, দু’টি বড়োসড় বন্যা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন ভূমিধস এবং তারপর কোভিড প্যানডেমিকের বিরুদ্ধে লড়েও সরকার কী কী পেতে পেরেছে তার উপরই মনোনিবেশ করবে । স্থানীয় ভোটে যখন মানুষ শাসক ফ্রন্টের বিকাশের দাবিদাওয়া বিবেচনা করে, তাদের স্বপক্ষেই ভোট দিয়েছে, তাই শাসক ফ্রন্ট এখন জানে যে বিরোধীদের পক্ষে এখন বিধানসভা ভোটে সরকারের বিরুদ্ধে সেই একই অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করে ভোটারদের আস্থা অর্জন করা কঠিন হবে ।

গত মাসে যখন পিনারাই বিজয়ন তাঁর জনসংযোগ কর্মসূচি শুরু করেছিলেন, তিনি জনগণকে বলেছিলেন যে 2016 সালের তাঁদের নির্বাচনী ইস্তেহারের মধ্যে যে 600 টি প্রকল্প এবং পরিকল্পনার উল্লেখ করা হয়েছিল, তার মধ্যে কেবল 30টিই বাকি রয়েছে এবং বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে তাও শেষ হয়ে যাবে ।

এলডিএফ সরকারের কাছে এমন অনেক প্রকল্প আছে, যা তারা আসন্ন বিধানসভা ভোটের প্রচারে ইশু হিসাবে সামনে রাখতে পারে । যেমন আর্দ্রম মিশন, যা রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবায় বিপ্লব এনে দিয়েছে । লাইফ মিশন, যার মাধ্যমে রাজ্যে চলতি বছরের 18 জানুয়ারি পর্যন্ত গৃহহারাদের জন্য 2,51,046 টি বাড়ির বন্দোবস্ত করা হয়েছে । হরিথা কেরলম মিশন, যা রাজ্যের জলপথ, পরিবেশরক্ষা এবং বর্জ্য পদার্থের সক্রিয় রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তৈরি করা হয়েছিল । পাবলিক এডুকেশন রিজুভিনেশন মিশন, যার আওতায় কেরালায় গণশিক্ষায় আক্ষরিক অর্থেই পুনরুজ্জীবন এসেছে । তাছাড়াও মহিলাদের ক্ষমতায়ন, রূপান্তরকামী সম্প্রদায়ের জন্য উদ্যোগ প্রভৃতিও উল্লেখ্য । রূপান্তরকামীদের জন্য অন্যান্য নানা ধরনের উদ্ভাবনীমূলক, সামাজিক কল্যাণমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি সম্ভবত দেশের মধ্যে কেরালাই প্রথম রাজ্য যারা তাদের জন্য পাবলিক সারভিস কমিশনের মাধ্যমে চাকরি দেওয়ার বন্দোবস্ত করেছে । কেরালা ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট বোর্ড (কেআইআইএফবি)-র মাধ্যমে রাজ্যের সমস্ত নাগরিকদের জন্য বিনামূল্যে কে ফোন, সাশ্রয়ী দামে ইনটারনেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং গৃহীত হয়েছে বিবিধ পরিকাঠামোর উন্নয়নমূলক প্রকল্পও ।

কর্পোরেট বডি হিসাবে কেআইআইএফবিকে কংগ্রেস এবং বিজেপি সমালোচনা করেছে । কারণ বিদেশি মূলধনে এর পরিচালিত হওয়া । কিন্তু এটিই বর্তমানে রাজ্যের বেশিরভাগ পরিকাঠামোমূলক প্রকল্পের আর্থিক মদতদাতা । বিধানসভাকেও কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনেরালের রিপোর্টের বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব অবস্থান নিতে হয়েছে কারণ এটি কেআইআইএফবিকে অসাংবিধানিক বলে গণ্য করেছিল । সেই ক্যাগ রিপোর্টের আপত্তিকর অংশগুলিকে বাদ দিতে বিধানসভাকে একটি প্রস্তাব পাশ করাতে হয়েছিল । বলাই বাহুল্য, ইউডিএফের ঘোর বিরোধিতা করেছিল ।

এখানে আস্থার সঙ্গে লড়াইয়ে নেমেছে বিভ্রান্তি এবং মনোযোগ ক্ষুণ্ণ করার প্রবৃত্তি । ইউডিএফ যারা ইতিমধ্যেই প্রবল আন্তঃদলীয় স্বার্থের সংঘাতের জেরে (রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওম্মান চাণ্ডি, বর্তমানে বিরোধী দলনেতা রমেশ চেন্নিথালা এবং কেপিসিসি সভাপতি মুলাপল্লি রামচন্দ্রন, প্রত্যেকেরই পাখির চোখ মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি) দুর্বল হয়ে পড়েছে, বাধ্য হয়ে শেষপর্যন্ত নির্বাচনী প্রচারের ইশু হিসাবে সেই শবরীমালাকেই বেছে নিয়েছে । বিরোধীদের উত্থান সম্ভবত সেই নিয়ামক নয়, যার উপর নির্বাচনী প্রচারের জন্য ইউডিএফ নির্ভর করতে চায়, বিশেষ করে স্থানীয় ভোটে যে পটভূমিকায় শাসক ফ্রন্ট জিতে এসেছে, তা বিচার করে । এমনকী, ইউনিয়ন মুসলিম লিগ, যারা ইউডিএফের বিশ্বস্ত সঙ্গী, তারাও স্থানীয় ভোট পরবর্তী সময়ে ইউডিএফের অন্দরে শাসকের সুরে কথা বলতে শুরু করেছে । নিজেদের শক্ত ভিতে কংগ্রেসের শোচনীয় ব্যর্থতার পর তাদের স্থানীয় ভোটের ফলে আইইউএমএলের উপরই অনেকটা নির্ভর করতে হয়েছে কারণ আইইউএমএল সেই ভোটে তাদের বেশিরভাগ আসনেই জিতেছিল ।

কাজেই, যে ইশুটি তাদের গতবছর পার্লামেন্ট ভোটে জয় হাসিল করতে সাহায্য করেছিল, সেই শবরীমালা ইশুতেই তারা ফিরে এসেছে । যদিও এ নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই যে শবরীমালা পার্লামেন্ট নির্বাচনের সময় সিপিএমের ভোটব্যাঙ্কে চিড় ধরাতে সক্ষম হয়েছিল, তবুও ইউডিএফের জয়ে (20টি পার্লামেন্ট কেন্দ্রের মধ্যে 19টিতেই জয়) সবচেয়ে বড় নিয়ামক বিষয় ছিল কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপির বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া আবেগ । কেন্দ্রে বিজেপির বিকল্প হিসাবে ভোটাররা কংগ্রেসকে বেছে নিয়েছিল ।

বাম সচিবালয়ের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই তাদের নেতাদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে বিজেপি এবং ইউডিএফের তোলা শবরীমালা ইশু সংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া না দিতে । এলডিএফ জোটের অন্যতম বড় শরিক, সিপিআই–এর সচিব কনম রাজেন্দ্রন ইতিমধ্যেই বিরোধীদের শবরীমালা ইশুতে মনোনিবেশের সিদ্ধান্ত উড়িয়ে দিয়েছেন । সাংবাদিকদের কনম বলেছেন, “শবরীমালা আদালতের বিচারাধীন বিষয় । তা সত্ত্বেও বার বার এই নিয়ে চর্চা করা যে নির্বাচনী স্টান্ট, তা জনগণ জানে ।” ফের যখন শবরীমালাকে মনোযোগের কেন্দ্রে নিয়ে আসা হল, পার্লামেন্ট ভোটের পর এ নিয়ে কিছু না বললেও পরবর্তীকালে ভোট প্রচারে বিরোধীদের কাছে যে সত্যিই তোলার মতো ইশুর ঘাটতি হচ্ছে, তা বোঝা যাবে ।

ভোটমুখী দেশের অন্যান্য রাজ্য যেমন পশ্চিবঙ্গ এবং তামিলনাড়ুর সঙ্গে তুলনা টানলে (যেখানকার সরকার বিরোধী–উত্থানের বড় ঢেউয়ের সম্মুখীন) দেখা যাবে, কেরালা সরকার নির্বাচনী আসরে নামতে চলেছে গত পাঁচ বছরে তাদের কৃতিত্বকে মূলধন করে । এবার দেখার বিষয় হল, ক্ষমতায় ফিরতে ইউডিএফ কি শবরীমালা ইশুকেই প্রচারের হাতিয়ার করবে, না নিজেদের হিন্দু ভোটব্যাঙ্কের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে বিজেপি বা এলডিএফের হয়ে ভোট দিতে ছেড়ে দেবে, কট্টরপন্থী মুসলিম সংগঠন, এসডিপিআইয়ের সঙ্গে জোট বাধার মাধ্যমে ।

ইউডিএফ ঠেকে শিখেছে যে এলডিএফ সরকারের বিরুদ্ধে সোনা পাচার, লাইফ মিশনে দুর্নীতি এবং আইটি দপ্তরে অনিয়ম প্রভৃতি বিষয় তুলে স্থানীয় নির্বাচনে তারা বিশেষ সাফল্য পায়নি । আর তাই তারা নির্বাচনের প্রধান বিষয়বস্তু হিসাবে সেই শবরীমালাতেই ফিরে এসেছে ।

ক্ষমতায় এলে বিরোধী জোট কী করতে পারে আর তাদের বিরুদ্ধে তোলা রাজনৈতিক অভিযোগ এই দুই বিষয়ে নির্বাচনী প্রচার চালানোর সাধারণ কৌশল অনুসরণ করার পরিবর্তে এলডিএফ মূলত নির্বাচনী ট্র‌্যাকে হাঁটছে গত পাঁচ বছরে তারা কী কী করতে পেরেছে এবং যে সব উদ্যোগ ইতিমধ্যেই গৃহীত হয়েছে, পরবর্তীকালে তাতে আরও কীভাবে উন্নতি করা যায়, তা নিয়ে প্রচার চালিয়ে । আসন্ন বিধানসভা ভোটে দ্বিতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় আসার লক্ষ্যে এলডিএফের মূল স্লোগান হতে চলেছে ‘বিকাশের জন্য ভোটদান’ ।

সম্প্রতি স্থানীয় ভোটে এই একই নির্বাচনী প্রচার মডেল অনুসরণ করেই এলডিএফ বিপুল জয় হাসিল করেছে । এই সরকার বিরোধীদের তোলা অভিযোগের ফাঁদে পড়েনি অথচ ভোটারদের যা বোঝাতে চেয়েছিল, তা করতে পেরেছে এই বার্তা দিয়ে যে নিজের চারপাশে তাকিয়ে পরিবর্তন দেখুন । ভোটাররা যারা ইতিমধ্যেই কোভিড প্যানডেমিকের সময় এবং বন্যার সময় গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে বিনামূল্যে ‘প্রভিশন কিট’ পেয়েছে, তাদের আর আলাদা করে সরকারের উদ্যোগ নিয়ে বোঝাতে লাগেনি ।

স্থানীয় নির্বাচনের পরে একটি সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন বলেছিলেন, “সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা বলে এবং ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে বিদ্বেষমূলক প্রচার চালানো হয়েছিল । কিন্তু মানুষ এতে কান দেয়নি । তারা সরকার পরিচালিত কল্যাণমূলক এবং বিকাশমূলক কার্যকলাপকে সমর্থন করেছে । তারা চেয়েছে, সরকার এই ভালো কাজের ধারা অব্যাহত রাখুক ।”

সুতরাং এই বার্তা এখন জোরালো এবং স্পষ্ট যে এলডিএফ তাদের নির্বাচনী প্রচার, সরকারের বিরুদ্ধে তোলা বিরোধীদের অভিযোগের উপর ভিত্তি করে করবে না বরং গত পাঁচ বছরে একের পর এক প্রতিবন্ধকতা যেমন নিপ্পা, দু’টি বড়োসড় বন্যা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন ভূমিধস এবং তারপর কোভিড প্যানডেমিকের বিরুদ্ধে লড়েও সরকার কী কী পেতে পেরেছে তার উপরই মনোনিবেশ করবে । স্থানীয় ভোটে যখন মানুষ শাসক ফ্রন্টের বিকাশের দাবিদাওয়া বিবেচনা করে, তাদের স্বপক্ষেই ভোট দিয়েছে, তাই শাসক ফ্রন্ট এখন জানে যে বিরোধীদের পক্ষে এখন বিধানসভা ভোটে সরকারের বিরুদ্ধে সেই একই অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করে ভোটারদের আস্থা অর্জন করা কঠিন হবে ।

গত মাসে যখন পিনারাই বিজয়ন তাঁর জনসংযোগ কর্মসূচি শুরু করেছিলেন, তিনি জনগণকে বলেছিলেন যে 2016 সালের তাঁদের নির্বাচনী ইস্তেহারের মধ্যে যে 600 টি প্রকল্প এবং পরিকল্পনার উল্লেখ করা হয়েছিল, তার মধ্যে কেবল 30টিই বাকি রয়েছে এবং বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে তাও শেষ হয়ে যাবে ।

এলডিএফ সরকারের কাছে এমন অনেক প্রকল্প আছে, যা তারা আসন্ন বিধানসভা ভোটের প্রচারে ইশু হিসাবে সামনে রাখতে পারে । যেমন আর্দ্রম মিশন, যা রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবায় বিপ্লব এনে দিয়েছে । লাইফ মিশন, যার মাধ্যমে রাজ্যে চলতি বছরের 18 জানুয়ারি পর্যন্ত গৃহহারাদের জন্য 2,51,046 টি বাড়ির বন্দোবস্ত করা হয়েছে । হরিথা কেরলম মিশন, যা রাজ্যের জলপথ, পরিবেশরক্ষা এবং বর্জ্য পদার্থের সক্রিয় রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তৈরি করা হয়েছিল । পাবলিক এডুকেশন রিজুভিনেশন মিশন, যার আওতায় কেরালায় গণশিক্ষায় আক্ষরিক অর্থেই পুনরুজ্জীবন এসেছে । তাছাড়াও মহিলাদের ক্ষমতায়ন, রূপান্তরকামী সম্প্রদায়ের জন্য উদ্যোগ প্রভৃতিও উল্লেখ্য । রূপান্তরকামীদের জন্য অন্যান্য নানা ধরনের উদ্ভাবনীমূলক, সামাজিক কল্যাণমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি সম্ভবত দেশের মধ্যে কেরালাই প্রথম রাজ্য যারা তাদের জন্য পাবলিক সারভিস কমিশনের মাধ্যমে চাকরি দেওয়ার বন্দোবস্ত করেছে । কেরালা ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট বোর্ড (কেআইআইএফবি)-র মাধ্যমে রাজ্যের সমস্ত নাগরিকদের জন্য বিনামূল্যে কে ফোন, সাশ্রয়ী দামে ইনটারনেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং গৃহীত হয়েছে বিবিধ পরিকাঠামোর উন্নয়নমূলক প্রকল্পও ।

কর্পোরেট বডি হিসাবে কেআইআইএফবিকে কংগ্রেস এবং বিজেপি সমালোচনা করেছে । কারণ বিদেশি মূলধনে এর পরিচালিত হওয়া । কিন্তু এটিই বর্তমানে রাজ্যের বেশিরভাগ পরিকাঠামোমূলক প্রকল্পের আর্থিক মদতদাতা । বিধানসভাকেও কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনেরালের রিপোর্টের বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব অবস্থান নিতে হয়েছে কারণ এটি কেআইআইএফবিকে অসাংবিধানিক বলে গণ্য করেছিল । সেই ক্যাগ রিপোর্টের আপত্তিকর অংশগুলিকে বাদ দিতে বিধানসভাকে একটি প্রস্তাব পাশ করাতে হয়েছিল । বলাই বাহুল্য, ইউডিএফের ঘোর বিরোধিতা করেছিল ।

এখানে আস্থার সঙ্গে লড়াইয়ে নেমেছে বিভ্রান্তি এবং মনোযোগ ক্ষুণ্ণ করার প্রবৃত্তি । ইউডিএফ যারা ইতিমধ্যেই প্রবল আন্তঃদলীয় স্বার্থের সংঘাতের জেরে (রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওম্মান চাণ্ডি, বর্তমানে বিরোধী দলনেতা রমেশ চেন্নিথালা এবং কেপিসিসি সভাপতি মুলাপল্লি রামচন্দ্রন, প্রত্যেকেরই পাখির চোখ মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি) দুর্বল হয়ে পড়েছে, বাধ্য হয়ে শেষপর্যন্ত নির্বাচনী প্রচারের ইশু হিসাবে সেই শবরীমালাকেই বেছে নিয়েছে । বিরোধীদের উত্থান সম্ভবত সেই নিয়ামক নয়, যার উপর নির্বাচনী প্রচারের জন্য ইউডিএফ নির্ভর করতে চায়, বিশেষ করে স্থানীয় ভোটে যে পটভূমিকায় শাসক ফ্রন্ট জিতে এসেছে, তা বিচার করে । এমনকী, ইউনিয়ন মুসলিম লিগ, যারা ইউডিএফের বিশ্বস্ত সঙ্গী, তারাও স্থানীয় ভোট পরবর্তী সময়ে ইউডিএফের অন্দরে শাসকের সুরে কথা বলতে শুরু করেছে । নিজেদের শক্ত ভিতে কংগ্রেসের শোচনীয় ব্যর্থতার পর তাদের স্থানীয় ভোটের ফলে আইইউএমএলের উপরই অনেকটা নির্ভর করতে হয়েছে কারণ আইইউএমএল সেই ভোটে তাদের বেশিরভাগ আসনেই জিতেছিল ।

কাজেই, যে ইশুটি তাদের গতবছর পার্লামেন্ট ভোটে জয় হাসিল করতে সাহায্য করেছিল, সেই শবরীমালা ইশুতেই তারা ফিরে এসেছে । যদিও এ নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই যে শবরীমালা পার্লামেন্ট নির্বাচনের সময় সিপিএমের ভোটব্যাঙ্কে চিড় ধরাতে সক্ষম হয়েছিল, তবুও ইউডিএফের জয়ে (20টি পার্লামেন্ট কেন্দ্রের মধ্যে 19টিতেই জয়) সবচেয়ে বড় নিয়ামক বিষয় ছিল কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপির বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া আবেগ । কেন্দ্রে বিজেপির বিকল্প হিসাবে ভোটাররা কংগ্রেসকে বেছে নিয়েছিল ।

বাম সচিবালয়ের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই তাদের নেতাদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে বিজেপি এবং ইউডিএফের তোলা শবরীমালা ইশু সংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া না দিতে । এলডিএফ জোটের অন্যতম বড় শরিক, সিপিআই–এর সচিব কনম রাজেন্দ্রন ইতিমধ্যেই বিরোধীদের শবরীমালা ইশুতে মনোনিবেশের সিদ্ধান্ত উড়িয়ে দিয়েছেন । সাংবাদিকদের কনম বলেছেন, “শবরীমালা আদালতের বিচারাধীন বিষয় । তা সত্ত্বেও বার বার এই নিয়ে চর্চা করা যে নির্বাচনী স্টান্ট, তা জনগণ জানে ।” ফের যখন শবরীমালাকে মনোযোগের কেন্দ্রে নিয়ে আসা হল, পার্লামেন্ট ভোটের পর এ নিয়ে কিছু না বললেও পরবর্তীকালে ভোট প্রচারে বিরোধীদের কাছে যে সত্যিই তোলার মতো ইশুর ঘাটতি হচ্ছে, তা বোঝা যাবে ।

ভোটমুখী দেশের অন্যান্য রাজ্য যেমন পশ্চিবঙ্গ এবং তামিলনাড়ুর সঙ্গে তুলনা টানলে (যেখানকার সরকার বিরোধী–উত্থানের বড় ঢেউয়ের সম্মুখীন) দেখা যাবে, কেরালা সরকার নির্বাচনী আসরে নামতে চলেছে গত পাঁচ বছরে তাদের কৃতিত্বকে মূলধন করে । এবার দেখার বিষয় হল, ক্ষমতায় ফিরতে ইউডিএফ কি শবরীমালা ইশুকেই প্রচারের হাতিয়ার করবে, না নিজেদের হিন্দু ভোটব্যাঙ্কের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে বিজেপি বা এলডিএফের হয়ে ভোট দিতে ছেড়ে দেবে, কট্টরপন্থী মুসলিম সংগঠন, এসডিপিআইয়ের সঙ্গে জোট বাধার মাধ্যমে ।

ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.