ওয়াশিংটন, 4 এপ্রিল : অ্যামেরিকায় থাবা বসানো কোরোনা ভাইরাসের মোকাবিলায় এগিয়ে এসেছে ভারতীয়-অ্যামেরিকান সমাজ । স্থানীয়দের সাহায্যের পাশাপাশি ভারতীয় পড়ুয়া এবং ফেরার বিমান না পেয়ে আটকে পড়া পর্যটকদের পাশেও দাঁড়িয়েছে তারা । ভারতীয়-অ্যামেরিকান ডাক্তার ও হোটেল ব্যবসায়ীরা বিনামূল্যে চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ এবং ঘর দিতে চেয়েছেন । কমিউনিটির নেতারা অনেকক্ষেত্রেই পড়ুয়াদের দরজায় মুদিখানার সামগ্রী রেখে এসেছেন, আর যাঁরা বিপদে পড়েছেন, তাঁদের নিজেদের বাড়িতেও থাকার প্রস্তাব দিয়েছেন । নিকটজনরা যখন রোজ অ্যামেরিকা সম্পর্কিত শিরোনামগুলি দেখেন, তখন তাঁদের ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে, কারণ আমেরিকায় কোরোনার ধাক্কা সবচেয়ে প্রবল । 50টি স্টেটে সংক্রমণ ছড়িয়েছে, আর নিউইয়র্ক হয়ে উঠেছে ভরকেন্দ্র । সব মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত 216768 জন আক্রান্ত হয়েছেন এবং 5137 জনের মৃত্যু হয়েছে ।
কোনও সন্দেহ নেই যে সংখ্যাটা উদ্বেগের, আর হাজার হাজার মাইল দূরে বসে থাকা পরিবারগুলির উদ্বেগও সহজেই অনুমেয় । কিন্তু বহু সংস্থা এগিয়ে আসছে, আর এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মোকাবিলায় রাতারাতি তাঁদের নিয়মও পাল্টে দিচ্ছে ।
স্বাস্থ্যবিধি এবং হেলথ গাইডলাইন এখনও দেশ ছাড়ার অনুমতি দিচ্ছে না, যেটা অনেকই চাইছেন । কোরোনা ভাইরাস কোনও নির্দিষ্ট নাগরিককে বিশেষ ছাড় দেয় না । দিনের শেষে, গুজব ও হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ বিশ্বাস করার থেকে, সরকারি ওয়েবসাইটগুলিতে প্রতিদিন আপডেট হতে থাকা সরকারি বিধিনিষেধ এবং নির্দেশিকা অনুসরণ করাই সবথেকে ভালো । আসলে, সীমিত ক্ষমতা ও লোকবল নিয়ে ভারতীয় নাগরিকদের সাহায্য করতে চাইছেন যে আধিকারিকরা, তাঁদের পক্ষে অতিরিক্ত মাথাব্যাথার কারণ হচ্ছে এইসব গুজব ।
একটা টুইটার অ্যাকাউন্ট খুলে মনোযোগ আকর্ষণের জন্য অভিযোগ করা কাজের কথা নয় । রাজনীতিবিদদেরও উচিত নয়, কোনও জনপ্রতিনিধির তরফে চিঠি লিখে কারও ছেলে বা মেয়েকে এয়ারলিফট করতে বলে আরও বোঝা বাড়ানো । এটা সেইসব ভারতীয় পরিযায়ী শ্রমিকের পক্ষে মর্মান্তিক, যাঁরা কয়েকশো কিলোমিটার হেঁটে ঘরে ফিরছেন, আর যাঁদের কোনও টুইটার অ্যাকাউন্ট নেই । এয়ার ইন্ডিয়া অ্যামেরিকার নাগরিকদের দেশে ফেরাচ্ছে, আর রিটার্ন ফ্লাইটে ভারতীয়দেরও নিয়ে আসতে পারে, এই খবর সত্যি নয়, হোয়াটসঅ্যাপের গুজব মাত্র । অ্যামেরিকার দূতাবাস তাঁদের নিজেদের ক্ষমতা ব্যবহার করছে, আর অ্যামেরিকার বিমানেই ভারত থেকে নাগরিকদের দেশে ফেরানো হচ্ছে । এক্ষেত্রে ডেল্টা এয়ারলাইন্সকে ব্যবহার করা হচ্ছে, এয়ার ইন্ডিয়াকে নয় ।
হোয়াটসঅ্যাপের ফরওয়ার্ড করা মেসেজের ভিত্তিতে ভুল তথ্য ও অনুরোধ শুধুই বিভ্রান্তি বাড়াচ্ছে । আধিকারিকরা বলছেন, তথ্যের ওপর নির্ভর করাই ভালো । এখন সবথেকে ভালো পরামর্শ, যেখানে আছেন সেখানেই আশ্রয় নেওয়া । ভারতীয় দূতাবাস কম সংখ্যায় কর্মীদের নিয়ে, প্রচুর সতর্কবার্তা সহ কাজ করছে । সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে, এবং অযথা ঝুঁকি কমাতে অফিসারদের মাত্র এক তৃতীয়াংশ অফিসে আসছেন, আর বাকিরা বাড়ি থেকে কাজ করছেন । দূতাবাস ও তার পাঁচটি কনস্যুলেট ক্রমশ বদলাতে থাকা পরিস্থিতির মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে । সাহায্যের আবেদন জানানো ভারতীয়দের পাশাপাশি, প্রবল চাপে থাকা অ্যামেরিকা সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির সঙ্গেও যোগাযোগ রাখা হচ্ছে ।
মার্কিন সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলি-স্টেট ডিপার্টমেন্ট, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি, সিটিজ়েনশিপ অ্যান্ড ইমিগ্রেশন সার্ভিসেস (USCIS) ভারতীয় দূতাবাসকে আশ্বস্ত করে জানিয়েছে, যে তারা ভারতীয় পড়ুয়া, H1B ভিসাধারক, যাঁদের ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে, এবং দেখা করতে আসা পরিবারের সদস্যদের সমসাগুলি সম্পর্কে অবহিত । অন্যান্য দেশগুলিও একই নৌকায় সওয়ার । আশা করা হচ্ছে, যে USCIS এই ভাইরাসের ফলে তৈরি হওয়া পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করবে এবং যাঁদের ভিসা ফুরিয়ে এসেছে, অথবা মেয়াদবৃদ্ধি হবে না, তাঁদের ব্যাপারে নমনীয় হবে । রেকর্ড রাখার জন্য ভারতীয় নাগরিকদের উচিত অনলাইনে ভিসার মেয়াদবৃদ্ধির আবেদন করা ।
বহু অ্যামেরিকার বিশ্ববিদ্যালয় অন্তত একটা করে ডর্মিটরি খোলা রেখেছেন, এবং অনেক ভারতীয় পড়ুয়া এখনও তাঁদের ঘরেই রয়েছেন । এটা একটা উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ, কারণ এর অর্থ যে তাহলে সেখানকার কর্মীদেরও কাজে আসতে হবে । কিছু বিশ্ববিদ্যালয় বিদেশি পড়ুয়াদের সামান্য বৃত্তিও দিয়েছে, কারণ খরচ চালাতে ক্যাম্পাসে কাজ করার উপায় এখন নেই । ভারত আন্তর্জাতিক উড়ান বন্ধ করার আগেই বহু ভারতীয় পড়ুয়া শুরুর দিকেই আমেরিকা ছেড়েছেন । দূতাবাস কর্মীরা দেশের ফিরত চাওয়া OCI কার্ডধারীদের জন্য একটা আলাদা পদ্ধতিও তৈরি করেছে । বিভ্রান্তির ফলে অনেকেই দুবাই ও আবু ধাবির বিমানবন্দরে আটকে পড়েছেন, কারণ বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলি ভারতে শাটডাউনের সময়সীমা বুঝতে ভুল করে, অনেক যাত্রীকে তুলতে চায়নি ।
দুই লাখেরও বেশি ভারতীয় পড়ুয়া বর্তমানে অ্যামেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন, এবং তাঁদের বেশিরভাগই রয়ে গেছেন । এই ভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর কয়েকদিনের মধ্যেই ভারতীয় দূতাবাস পড়ুয়াদের জন্য একটি চব্বিশ ঘণ্টার হেল্পলাইন চালু করেছে । প্রথম সপ্তাহেই প্রশিক্ষিত পড়ুয়া স্বেচ্ছ্বাসেবকরা 200 টি কল পেয়েছেন, যার 75 শতাংশই দেশে ফেরার ব্যাপারে তথ্য জানতে, এবং ভিসা সম্পর্কিত । আধিকারিকদের হিসেব অনুযায়ী, স্টুডেন্ট হাব ক্যাম্পাস লিডসের মাধ্যমে, 45 জন "পড়ুয়া রাষ্ট্রদূত" এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অফিসের মাধ্যমে ভারতীয় দূতাবাস 50 হাজারেরও বেশি ভারতীয় পড়ুয়ার কাছে পৌঁছতে পেরেছে, তাঁদের সর্বশেষ তথ্য দিয়েছে ৷ এই কঠিন সময়ে তাদের মনোবল বাড়িয়েছে ।
ভিসা নিয়ে সাধারণ প্রশ্ন, সাময়িক স্টুডেন্ট ভিসার আওতায় অপশনাল প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিং এবং অন্যান্য বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ছাত্র-স্বেচ্ছাসেবকরা । আধিকারিকদের কথায়, যেহেতু স্বেচ্ছাসেবকরাও একই নৌকায় সওয়ার, তাই বার্তা পৌঁছে দেওয়া গেছে । এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে, অ্যামেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অফ ফিজিশিয়ানস অফ ইন্ডিয়ান ওরিজিন বা AAPI, আমেরিকায় আটকে পড়া ভারতীয় পর্যটকদের এবং যাঁদের ওষুধ ফুরিয়ে যেতে পারে তাঁদের বিনামূল্যে ডাক্তারি পরামর্শ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে । এশিয়ান অ্যামেরিকান হোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সেইসব পড়ুয়াকে বিনামূল্যে ঘর দিয়েছে, যাঁদের ক্যাম্পাস পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে । কেউ কেউ খাবারও দিচ্ছে । সঙ্কট যখন ভারত ও অ্যামেরিকা-সহ গোটা বিশ্বকে গ্রাস করেছে, তখন সবাইকেই এগিয়ে এসে তাঁদের ভূমিকা পালন করতে হবে । এটাই শেষ কথা ৷