দিল্লি, 10 ডিসেম্বর : ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কার সম্পর্ক সেই রামসেতুর সময় থেকে । দেশের 12 শতাংশ তামিল জনগণ এবং ভারতের শান্তিরক্ষা বাহিনীর বলিদান, দুই সীমান্তবর্তী দেশের ঐক্য ও অখণ্ডতা আরও সুদৃঢ় করেছে । ভারত কয়েক শতক ধরে শ্রীলঙ্কার বড় দাদার ভূমিকা পালন করে আসছে । শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট পদে মাহিন্দ্রা রাজাপক্ষের নির্বাচনের সময় 2005 সালে কলম্বো বেজিংয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল । তামিল টাইগারদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জয়ের ফলে রাজাপক্ষে তাঁর জয় সম্পর্কে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু, 2015 সালে পরাজয়ের পর ভারতের দিকেই আঙুল তুলেছিল শ্রীলঙ্কা ।
সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাহিন্দ্রা রাজাপক্ষের ভাই গোতাবায়া রাজাপক্ষের জয়ের ফলে দিল্লি-কলম্বো সম্পর্ক নিয়ে সন্দেহ নতুন করে জন্ম নিতে শুরু করে । সম্পর্কের জমিটাকে ফের মজবুত করার তাগিদে প্রেসিডেন্ট পদে গোতাবায়ার শপথ নেওয়ার পরদিনই বিদেশমন্ত্রী জয়শংকরকে শ্রীলঙ্কা পাঠান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি । জয়শংকরের মাধ্যমে মোদি শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টকে ভারত সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানান । আমন্ত্রণ রক্ষা করেন সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট । তিনি ভারত সফর করেন । প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার সঙ্গে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী মোদি । গোতাবায়া স্পষ্ট করেন, ভারতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এমন কোনও পদক্ষেপ করবে না শ্রীলঙ্কা। চিনের বিকল্প হিসেবে ভারত এবং অন্যান্য দেশের বিনিয়োগের বিষয়টি নিয়েও কথা হয় । বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ভারত সন্ত্রাসদমনে 360 কোটি এবং অন্যান্য ঋণ হিসেবে 2870 কোটি টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করে, যা দুই দেশের পুরোনো বন্ধুত্বকে আরও মজবুত করল ।
কিছুদিন আগেই শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সে দেশের সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ক তৈরি করেছিল । মৈত্রিপালা সিরিসেনার আমলে যে রাজনৈতিক সংকটের সূচনা হয়েছিল, তা দেশকে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে নিয়ে যায়, সেনা শাসনের পরিস্থিতি তৈরি করে । সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মতো বিক্রমসিংঘে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর পবিত্র দিনে সেই ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ দেশটিকে বিষাদের মধ্যে নিয়ে যায় । ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিস্ফোরণের সতর্কতা দেওয়ার পরও কেন নিরাপত্তা সংস্থা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করল না, তা নিয়ে পার্লামেন্টের সিলেক্ট কমিটি নিরাপত্তা সংস্থার গাফিলতির দিকে আঙুল তোলে । সিংহলির সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মনে করেছেন, সন্ত্রাসবাদের নতুন শক্তি ইসালামিক স্টেটের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ করতে এবং তাদের দমন করতে গোতাবায় হচ্ছেন সঠিক ব্যক্তি । উত্তর এবং পূর্বাঞ্চলের প্রদেশের তামিল এবং মুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বিশ্বাস করেন সন্ত্রাসবাদকে নিয়ন্ত্রণে আনতে, তাকে দমন করতে গোতাবায়ার থেকে উপযুক্ত আরও কেউ হবেন না । সিংহলির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসলেও গোতাবায়া অস্বীকার করতে পারেন না যে, এই জয়ের পিছনে তামিলদের এবং ভারতের একটি বিশেষ অবদান আছে । দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লোকেরা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বেশ খানিকটা দূরে এবং উত্তরাঞ্চল কেন্দ্রীভূত প্রশাসনের বিরোধিতা করে আসেছে । দেশের উত্তর ও পূর্বের জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত অধ্যুষিত এলাকাতে গোতাবায়া তেমন সুবিধে করতে পারেননি। সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে 1993 সালে তামিল জঙ্গিহানায় হত প্রেসিডেন্ট রণসিংহে প্রেমদাসার পুত্র সাজিথ। প্রসঙ্গত, শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যার 75 শতাংশই সিংহলি বংশোদ্ভূত এবং 70 শতাংশই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী । মৈত্রিপালা সব কিছুকে ঠিক করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কিছুই করতে পারেননি । গোতাবায়া স্পষ্ট করেছেন, 1987 সালের সংবিধানের 13 তম ধারা অনুসারে তামিল অধ্যুষিত এলাকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ( সিংহলি) দের থেকে ক্ষমতা হস্তান্তর পুরোপুরি সম্ভব নয়, তবে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের দিকে । গোতাবায়ার সামনে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ এই দীর্ঘকালীন সমস্যা যেন আরও নতুন করে কোনও সমস্যা তৈরি না করে, সেদিকে নজর দেওয়া ।
25 বছর ধরে LTTE-র জঙ্গি কার্যকলাপে ত্রস্ত দেশটার নতুন আতঙ্কের নাম ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ । পবিত্র দিনে ঐতিহাসিক সন্ত্রাসবাদী হামলা দেশের পর্যটন শিল্পকে বড়সড় ধাক্কা দিয়েছে, দেশের জাতীয় আয়ের পাঁচ শতংশ কমে গেছে । বিষয়টি নিয়ে শ্রীলঙ্কা অত্যন্ত সচেতন । মৈত্রীপালার সময় 2016 সালে উন্নয়ণের হার ছিল 4.5 শতাংশ, যা আজ 18 বছরের মধ্যে সব থেকে কম 2.5 শতাংশে নেমে এসেছে । এটাই চিনের শ্রীলঙ্কায় প্রবেশের সব থেকে ভাল সুযোগ, এই সুযোগ কাজে লাগাতে মরিয়া চিন । মাহিন্দ্রা রাজাপক্ষের সময় শ্রীলঙ্কার শক্তি সম্পদ, বন্দর, বিমানবন্দর, রেল, রাস্তার পরিকাঠামো-সহ একাধিক ক্ষেত্রে উত্তর থেকে দক্ষিণে নানা ভাবে বিনিয়োগ করেছে চিন । এখন শ্রীলঙ্কার তীরে ডুবো জাহাজ রাখার দিকে নজর দিয়েছে চিন ।
গোতাবায়া জানিয়েছেন, তিনি ভারত এবং চিন উভয়ের সঙ্গেই সমদূরত্ব বজায় রেখে চলার চেষ্টা করবেন, যতদিন না অন্য কোনও দেশ শ্রীলঙ্কায় বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে এগিয়ে আসছে, ততদিন চিনের প্রবেশের সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি, বিশেষ করে শ্রীলঙ্কার রাস্তা-সহ বিভিন্ন পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিনিয়োগের সম্ভাবনা খুবই বেশি । এই সময় শ্রীলঙ্কায় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে ভারতের । সমস্যা শ্রীলঙ্কাকে সাহায্যের ক্ষেত্রেও । কিন্তু, তামিলদের স্বার্থের কথা ভেবে এবং পরবর্তী সময় শ্রীলঙ্কার সুবিধার কথা ভেবে ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও মজবুত করার দিকে নজর দিয়েছে ।