‘লৌহমানবী’ অ্যাঞ্জেলা মর্কেল গত ১৫ বছর ধরে জার্মানির চ্যান্সেলর পদে রয়েছেন ৷ ওই পদে থাকাকালীন এই প্রথম তিনি কোনও আগাম ঘোষণা ছাড়াই জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন ৷ সেখানে কোনও ভূমিকা না রেখেই তিনি বলেন, ‘‘পরিস্থিতি গুরুতর ৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা জার্মানি এক যাওয়ার পর একসঙ্গে লড়াই করার জন্য এতবড় সংকট এর আগে কখনও আসেনি ৷’’ এবং অবশ্যই তিনি Covid19 করোনা ভাইরাসকে ‘Made-in-China’ বলেও উল্লেখ করেছেন ৷ ২১ মার্চ পর্যন্ত জার্মানিতে ২২৩৬৪টি করোনা ভাইরাসের ঘটনা সামনে এসেছে ৷ এর মধ্যে ৮৪ জনের প্রাণ গিয়েছে ৷ মৃত্যুর হার ০.৩৭ শতাংশ ৷ সেখানে গোটা বিশ্বে মৃত্যুর হার ৪.২৬ শতাংশ ৷
অন্যদিকে ইতালিতে ৪৮২৫ (৫৩৫৭৮ ঘটনা) জনের মৃত্যু হয়েছে ৷ বিশ্বের মধ্যে যা সর্বোচ্চ ৷ সেই দেশে মৃত্যুর হার ৯ শতাংশ ৷ জার্মানি এমন কী করল, যা ইতালি করতে পারেনি ? এর মধ্যে ভারতের কি কিছু শেখার আছে ? এখন ভারতের অবস্থা ঠিক কোথায় ? এই দিকগুলিতে নজর দেওয়া খুবই প্রাসঙ্গিক ৷
১৬ মার্চ জেনেভায় এক সাংবাদিক বৈঠকে WHO (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)-এর প্রধান Tedros Adhanom Ghebreyesus বলেন, ‘‘প্রতিটি দেশের জন্য আমাদের একটাই ছোট্ট বার্তা - পরীক্ষা, পরীক্ষা, পরীক্ষা.... প্রতিটি সন্দেহজনক ঘটনাকে পরীক্ষা করুন.... এই প্যানডেমিকের বিরুদ্ধে অন্ধের মতো লড়াই করা সম্ভব নয় ৷’’ এই বার্তাটিকেই হৃদয়ঙ্গম করে জার্মানি ৷ আর প্রায় সমস্ত ছোটখাটো ঘটনাকেই পরীক্ষা করে দেখে ৷ ভারতের মতোই সেখানে স্কুল ও জনসাধারণ যেতে পারে এমন জায়গা বন্ধ করে দেওয়া হয় ৷ জন সমাগমে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় ৷ এমনকী খুব তাড়াতাড়ি লক ডাউনও করা হতে পারে ৷ অন্য দেশগুলির মতো এই দেশটিকেও লড়াই করছে ৷ হু হু করে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা ৷ ১০ মার্চ যেখানে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩৪১, সেখানে ২০ মার্চ ওই সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৫২৮ জনে ৷
ভারত বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের মধ্যে অন্যতম যারা এই চ্যালেঞ্জের গভীরতা অনুবাধন করতে পেরেছে এবং দ্রুত সাবধানতা অবলম্বনের ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছে ৷ দুঃস্বপ্নের বিষয়টি থাকা সত্ত্বেও ১ ফেব্রুয়ারি থেকে নয়াদিল্লি উহান (চিন) থেকে নাগরিকদের উদ্ধারের কাজ শুরু করে ৷ ৪ ফেব্রুয়ারি চিনে যাওয়া বা আসার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় ৷ চিনে নাগরিকদের দেওয়া ভিসাও বাতিল করা হয় ৷ এই নিষেধাজ্ঞা ক্রমশ বাড়তে বাড়তে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইউরোপ, মালেশিয়া, ইরান, উপসাগরীয় অঞ্চল এবং অন্য দেশগুলির উপর আরোপিত হতে থাকে ৷ ভারত এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ২২ থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত বিমান পরিবহণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ৷
সবচেয়ে বড় বিষয় হল মার্চের ৯ তারিখ থেকে ১.১ বিলিয়ন মোবাইল ব্যবহারকারী ভারতীয়র মোবাইলে Covid19 ঠেকাতে সরকার স্বীকৃত সতর্কবার্তা শোনানো হয়, ‘‘নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলুন এবং নিজের চোখ, মুখ বা নাক স্পর্শ করা এড়িয়ে যান ৷ বিশাল মহাদেশের আকারের এই দেশের প্রতিটি কোনে কোনে এই কর্মসূচি খুবই কার্যকরী হয়ে ওঠে ৷
তখন থেকেই সামাজিক দূরত্ব তৈরির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয় এবং রোগ সংক্রমণ আটকানো যায় ৷ ১৮ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী মোদি ‘সংকল্প এবং সংযমের’ উপরই জোর দেন ৷ তিনি অতিরক্ত পরিমাণে আতঙ্ক বা নিশ্চিন্ত হওয়া থেকেও বিরত হতে বলেন ৷ ২২ মার্চ ‘জনতা কারফিউ’-এর কথা বলে তিনি আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে লক ডাউনের জন্য দেশবাসীকে প্রস্তুত করার কাজ করেন ৷ এটা অনেকটা যুদ্ধের আগে রিহার্সালের মতো ৷ আর এই যুদ্ধে কোনও জটিলতা বাড়ালে চলবে না ৷ কারণ, শত্রু খুবই শক্তিশালী, অজানা এবং অদৃশ্য ৷
ভারত Covid19-এ আক্রান্তদের খুঁজতে স্ক্রিনিং ও টেস্টিংয়ে আরও জোর দিতে শুরু করেছে ৷ ২০ মার্চ পর্যন্ত ১৪৫১৪ জনের পরীক্ষা করা সম্ভব হয়েছ ৷ যদিও এই সংখ্যাটা বেশ কম ৷ উদাহরণ স্বরূপ দক্ষিণ কোরিয়ার (জনসংখ্যা ৫১ মিলিয়ন) কথা বলা যেতে পারে, যারা এই রোগের প্রকোপ আটকাতে ৩১৬৬৬৪ জনকে পরীক্ষা করে ৷ অতিরিক্ত ১ মিলিয়ন টেস্টি কিট বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে এবং দেশেও এই ধরনের টেস্ট তৈরির কাজ শুরু হয়েছে ৷
এটাই ভারতের দায়িত্ববোধ এবং দেশীয় ভাবে এই সংকট মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী মোদির চিন্তাভাবনার পরিচয় তুলে ধরছে ৷ ভারত প্রতিবেশীদের সঙ্গেও এই সংকট মোকাবিলায় তাদের ক্ষমতা অনুযায়ী সম্পদ ভাগাভাগি করতে প্রস্তুত রয়েছে ৷ গত মাসে ১৫ টন মাস্ক, গ্লাভস এবং অন্য সামগ্রী চিনে পাঠানো হয় ৷ সাহায্যের আবেদন করা হয় মলদ্বীপ, বাংলাদেশ ও ভুটানের তরফেও ৷ সেই সাহায্যও করা হয়েছে ৷ প্রধানমন্ত্রী মোদীর উদ্যোগে গত ১৫ মার্চ SAARC গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির মধ্যে ভিডিও কনফারেন্স হয় ৷ সেখানে করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় SAARC জরুরি তহবিল গঠনের প্রস্তাব দেন তিনি ৷ প্রাথমিকভাবে ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন ৷ তাঁর পরামর্শে সৌদি আরবের যুবরাজ (বর্তমান চেয়ারম্যান) এ নিয়ে একটি G20 গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির মধ্যে ভিডিও সামিটের ডাক দিতে চলেছেন ৷
এটা অনুমান করা সম্ভব নয় যে এই প্যানডেমিক আটকাতে ঠিক কতটা সময় লাগবে ৷ মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি এটা যে অর্থনৈতিক ভাবেও একটা বড় ধাক্কা দিতে চলেছে, এটা অন্তত স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে ৷ গোটা বিশ্বের মতো ভারতও অর্থনৈতিক ধাক্কা অনুভব করছে ৷ একটা অনুমান করা হচ্ছে যে বিশ্বব্যাপী GDP ০.৫ থেকে ১ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে ৷ তবে কত বড় সময় ধরে এই সংকট চলবে, তার উপরও অনেক কিছু নির্ভর করছে ৷ এখন বিশ্বব্যাপী GDP হল ৮৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ৷ তা ৫০০ বিলিয়ন থেকে ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার কমে অর্থনৈতিক মন্দার দিকে এগিয়ে যেতে পারে ৷ এখন সব দেশই মানুষের জীবন বাঁচাতে এবং এই ভাইরাসের ট্রান্সমিশন সাইকেল ভাঙতে লড়াই করছে ৷ এর পর অর্থনীতিকে ঘোরানোর ব্যবস্থা করার প্রস্তুতি শুরু করতে হবে ৷
এই নজিরবিহীন সংকট সামলাতে দেশ যেভাবে রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে একজোট হয়েছে, তা যথেষ্ট উৎসাহব্যাঞ্জক ৷ তৃতীয় স্তরে পৌঁছানো আটকাতে নজরদারি, সামাজিক দূরত্ব বজায় এবং বৃহত্তর সংযম বজায় রাখাই আসল ৷ AIIMS এর এক বিশিষ্ট চিকিৎসক বলেছেন, ‘‘এই ভাইরাস খুবই অহঙ্কারী ৷ এটা আপনার বাড়িতে কখনই আসবে না, যতক্ষণ না আপনি বাড়ির বাইরে যাচ্ছেন, এবং এটাকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসছেন ৷’’
(রাষ্ট্রদূত বিষ্ণু প্রকাশ - দক্ষিণ কোরিয়া ও কানাডার প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত এবং বিদেশমন্ত্রকের সরকারি মুখপাত্র - একজন বিদেশ বিষয়ক বিশ্লেষক এবং লেখক)