দিল্লি : "পরিবেশ হল যেখানে আমরা সবাই একসঙ্গে মিলিত হই, যেখানে আমাদের সবার একটা পারস্পরিক বন্ধনে জড়িত । এটা হল এমন একটা জিনিস, যা আমাদের সবার ।" -- লেডি বার্ড জনসন (অ্যামেরিকার বিশিষ্ট পরিবেশবিদ)
পরিবেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্কের দিক থেকে দেখতে গেলে 1972 সালটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ে এই প্রথম আন্তর্জাতিক স্তরে এত বড় সম্মেলন । সম্মেলনের আহ্বায়ক ছিল রাষ্ট্রপুঞ্জ । সুইডেনের স্টকহোম শহর । 5 জুন থেকে শুরু করে 16 জুন । কনফারেন্স অন হিউম্যান এনভার্নমেন্ট বা স্টকহোম কনফারেন্স নামেই এটি বেশি পরিচিত । সম্মেলনের মূল লক্ষ্য ছিল, পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য যেসব বাধা বিপত্তিগুলি রয়েছে সেগুলির দূর করতে একটি সাধারণ ধারণা তুলে ধরা ।
সেই বছরেরই শেষের দিকে, 15 ডিসেম্বর রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভা 5 জুন দিনটিকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে । পরে 1974 সালে প্রথমবার পালিত হয় বিশ্ব পরিবেশ দিবস । স্লোগান ছিল, "একটিই পৃথিবী" ।
"আমাদের সন্তানদের জন্য যাতে আমরা একটি বসবাসযোগ্য করে রেখে যেতে পারি, তা নিশ্চিত করা আমাদের ও আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের দায়িত্ব ।" -- ওয়াঙ্গারি মাথি ( কেনিয়ার বিশিষ্ট পরিবেশবিদ)
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দিনটি বিশ্বের আঙিনায় বিশেষ জায়গা পেয়েছে । পরিবেশ সংক্রান্ত একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও নীতি গ্রহণ করা হয় বিশেষ দিনে । বিগত বছরগুলিতে লাখ লাখ মানুষ নিজেদের অভ্যেস বদলেছে । শুধু তাই নয়, পরিবেশ সচেতনতা নিয়ে জাতীয় স্তরে ও আন্তর্জাতিক স্তরেও বহু নীতি পরিবর্তন হয়েছে । ইউনাইটেড নেশনস এনভার্নমেন্ট প্রোগ্রাম পরিবেশ সংক্রান্ত সচেতনতা বাড়াতে ও কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়তে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে । ওজোন স্তর, বিষাক্ত রাসায়নিক, বৃক্ষচ্ছেদ ও বিশ্বায়ন সংক্রান্ত একাধিক আলোচনা হয়েছে ইউনাইটেড নেশনস এনভার্নমেন্ট প্রোগ্রামের বৈঠকে ।
2020 সালের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের থিম
এবছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসের থিম হল জীববৈচিত্র । বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জীববৈচিত্র বলতে শুধুমাত্র গাছপালা, জীবজন্তু ও অনুজীবকেই বুঝি । কিন্তু জীববৈচিত্র মানে শুধু এগুলিই নয়, জীববৈচিত্রের মধ্যে রয়েছে প্রতিটি প্রজাতির মধ্যে আলাদা আলাদা জিনগত পার্থক্য । অর্থাৎ, কোনও শস্যের বিভিন্ন ধরন বা কোনও প্রাণীর বিভিন্ন ধরন, এইসবই রয়েছে জীববৈচিত্রের মধ্যে । পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বাস্তুতন্ত্র যেমন, জলাশয়, জঙ্গল, মরুভূমি বা চাষের জমি; এগুলিও জীববৈচিত্রের অন্তর্গত । প্রতিটি বাস্তুতন্ত্রে মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদের মধ্যে এক পারস্পরিক সংযোগ রয়েছে ।
সম্প্রতি ব্রাজ়িল, অ্যামেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার দাবানল থেকে শুরু করে পূর্ব আফ্রিকার বিস্তীর্ণ এলাকায় পঙ্গপালের হানা, এবং তারপর বিশ্বজুড়ে প্যানডেমিক । এই ছবিগুলিই স্পষ্ট করে দেয় মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীকূলের সঙ্গে যে বাস্তুতন্ত্রে আমরা বাস করি, তার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে ।
আমরা আমাদের স্বাচ্ছন্দের জন্য অনবরত যে গাছপালা কেটে চলেছি, পরিবেশ ধ্বংস করে চলেছি তার জন্য প্রতি মুহূর্তে আমরা নিজেদের ক্ষতি ডেকে আনছি । আমরা এমন কিছু প্রাণী ও গাছের সংস্পর্শে চলে আসছি, যা ক্ষতিকারক রোগ বহন করে ।
আয়োজক দেশ
প্রতিবছরই বিশ্ব পরিবেশ দিবস আলাদা আলাদা দেশে আয়োজিত হয় । এই বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসের আয়োজক কলোম্বিয়া । এই দশকে দু'বার ভারত বিশ্ব পরিবেশ দিবসের আয়োজন করেছিল । 2011 সাল ও 2018 সাল । আয়োজক শহর ছিল দিল্লি । 2011 সালে থিম ছিল বনভূমি (ফরেস্টস : নেচার অ্যাট ইওর সারভিস) । 2018 সালের থিম ছিল প্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণ (বিট প্লাস্টিক পলিউশন) ।
পরিবেশের উপর COVID-19 লকডাউনের প্রভাব
বাতাসের গুণগত মান
লকডাউনের আগে যা ছিল, তার তুলনায় প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে PM 10 ও PM 2.5 । বাতাসে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড ও কার্বন মনো অক্সাইডের পরিমানও কমেছে । যেসব এলাকায় খুব বেশি যানবাহন চলাচল করে, বা যেসব জায়গায় শিল্পক্ষেত্র অনেক বেশি, সেইসব এলাকায় বাতাসের গুণগত মান প্রায় 60 শতাংশ ভালো হয়েছে । বাতাসের গুণগত মানের উন্নতি সবথেকে বেশি চোখে পড়েছে মধ্য ও পূর্ব দিল্লি এলাকায় ।
জলের গুনগত মান
25 মার্চ থেকে দেশে লকডাউন শুরু হয়েছিল । আর এই লকডাউন শুরুর মাত্র দশদিনের মধ্যেই জলের গুণগত মানের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় । গঙ্গার জলের গুণগত মান পরীক্ষা করার জন্য CPCB গঙ্গার উপর মোট 36 টি পর্যবেক্ষণের যন্ত্র বসিয়ে রেখেছে । এর মধ্যে 27 টি পর্যবেক্ষণ যন্ত্রই দেখিয়েছে, গঙ্গার জল স্নান করার ও মৎস প্রতিপালনের যোগ্য ।
বন্যপ্রাণ
কোরোনার আতঙ্কে দেশে যে লকডাউন চলছে, তার জেরে এ যাত্রায় রক্ষা পেয়েছে লাখ লাখ অলিভ রিডল টার্টেল । প্রতিবছর ওড়িশায় রাশিকুল্যায় ঘর বাঁধার সময়ে পর্যটকদের ভিড়ে প্রচুর অলিভ রিডল টার্টেল প্রাণ হারায় । লকডাউনের ফলে এবার কর্তৃপক্ষ টার্টেলগুলির দিকে বাড়তি নজর দিতে পেরেছে ।
মানব সভ্যতার ব্যতিচার, পরিবেশ ও প্যানডেমিক
পরিবেশবিদরা সতর্ক করেছেন, অবলীলায় পরিবেশ ধ্বংস ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পশুদ্বারা বাহিত রোগের সংক্রমণের সম্ভাবনা আরও বেড়ে যাচ্ছে । জলবায়ু এভাবে পরিবর্তন হতে থাকলে আগামী দিনে আরও ঘন ঘন এমন এপিডেমিক রোগের সংক্রমণ দেখা যাবে । আমরা যেভাবে পরিবেশের পরিবর্তন করছি, তাতে যেভাবে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা পালটাচ্ছে তাতে জীববৈচিত্র নষ্ট হচ্ছে । তৈরি হচ্ছে নতুন এক পরিবেশ, যাতে রোগের বাহক, ভেক্টর ও প্যাথোজেনের সংখ্যা বাড়ছে ।
মানুষের শরীরে যতধরনের রোগের সংক্রমণ হয়, তার মধ্যে 60 শতাংশই জ়ুনোটিক । পশুর শরীর থেকে মানুষের শরীরে আসে এমন রোগ রয়েছে প্রায় 75 শতাংশ । এরমধ্যে রয়েছে ইবোলা, বার্ড ফ্লু, মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (MERS), নিপা ভাইরাস, রিফট ভ্যালি জ্বর, সাডেন অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (SARS), পশ্চিম নীল ভাইরাস, জ়িকা ভাইরাস এবং সর্বশেষ সংযোজন কোরোনা ভাইরাস । এইসব সংক্রমণের পিছনেই রয়েছে প্রকৃতির প্রতি মানুষের বেপরোয়া মনোভাব ।
পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ ছিল, বনভূমি ফাঁকা হয়ে যাওয়া । এর কারণে বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে মানুষের বিভাজন কমে যায় এবং ছড়িয়ে পড়ে সংক্রমণ । ঠিক একইভাবে অ্যাভিয়ান ইনফ্লুয়েনজ়ার কারণ ছিল পোলট্রি ফার্মিং । নিপা ভাইরাসের কারণ ছিল শূকর পালন ও মালয়েশিয়ার ফল উৎপাদন ।
বাস্তুতন্ত্র অখণ্ডতা এই ধরনের রোগের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া অনেকটাই আটকাতে পারবে । জীববৈচিত্র ও বনভূমি ধ্বংস, বিশ্বায়ন ও দূষণের কারণে প্রকৃতি এখন এক অভূতপূর্ব সংকটের মুখোমুখি । এইসময়ে কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকা মানে তা মানবতার পরাজয় । কোরোনার কারণে উদ্ভূত এই পরিস্থিতির পরে, আগামীদিনে আরও কোনও বড়সড় সংকট যাতে আমাদের উপর না আসে, তা নিশ্চিত করতে ওষুধজাত বর্জ্য ও কেমিকেলজাত বর্জ্য মুক্ত পৃথিবী গড়ার দিকে আমাদের নজর দিতে হবে ।