আধুনিক রাষ্ট্র যখন তার একনায়কত্ব জাহির করে চলেছে তখন সেই দেশে নাগরিকত্ব পাওয়া এবং তা বজায় রাখা কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে । একটি নির্দিষ্ট আঞ্চলিক কাঠামোর মধ্যে থেকে কিছু প্রচলিত ধারণার বশবর্তী হয়ে পশ্চিমী সভ্যতার প্রভাবে নাগরিকত্ব নিয়ে চলতি দ্বন্দ্ব আরও বড় আকার ধারণ করেছে । নাগরিকত্ব ইশুটি বহু যুগ ধরেই ভারতকে আঁকড়ে রয়েছে । এই সমস্যা আরও জটিল হয়েছে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল (CAB) সংসদে পেশ হওয়ার পর । 2016 সালের 19 জুলাই লোকসভায় প্রথম বারের জন্য পেশ হয় এই CAB । এই বিলটি দ্বিতীয় বারের জন্য লেকসভায় পেশ করা হয় চলতি বছরের 12 ডিসেম্বর । 2019 সালের নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, যা 1955 সালের আইনের সংশোধনী, তাতে মূল আইনের সঙ্গে কয়েকটি অনুবিধি যোগ করা হয়েছে । সেই অনুবিধি অনুযায়ী আফগানিস্তান, বাংলাদেশ অথবা পাকিস্তান থেকে এ দেশে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসিক বা খ্রিস্টানরা, যারা 2014 সালের 31 ডিসেম্বরের আগে এ দেশে এসেছিলেন এবং যারা এ দেশে প্রবেশের পাসপোর্ট আইনের C ধারার দ্বিতীয় উপধারা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকারের অব্যাহতি পেয়েছেন অথবা বিদেশি আইন, 1946 অনুযায়ী কোনও সুবিধা পেয়েছেন তাঁদের অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না ।
CAA জারি হওয়ার পর থেকে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে ভয়ঙ্কর প্রতিবাদ, বিক্ষোভ । এই বিক্ষোভকে আমরা মোটামুটিভাবে দুই ভাগে ভাগ করতে পারি । জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া ও আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির মতো দেশের অন্যতম বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভ এবং উত্তর-পূর্ব, বিশেষত অসমের বিরোধীদের বিক্ষোভ । হিন্দুত্ব ও ইসলাম নিয়ে ভ্রান্ত প্রচার এবং কিছু রাজনৈতিক ফায়দা ছাড়া প্রথম ভাগের বিক্ষোভের তেমন কোনও গুরুত্ব নেই । কিন্তু বিদ্বেষমূলক রাজনীতির দ্বারা প্ররোচিত উত্তর-পূর্ব, বিশেষত অসমজুড়ে বিরোধীদের বিক্ষোভকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করার প্রয়োজন । এই দুই বিক্ষোভ আরও আলাদা বিক্ষোভের মূল ভাবনার দিক থেকেও । প্রথম অংশের বিক্ষোভের যখন দাবি আইনে ধর্মনিরপেক্ষতাকে আরও জোর দেওয়া, মুসলিমদের সঙ্গে কোনও রকম বিদ্বেষের চিহ্ন না রাখা তখন অসমের বিক্ষোভের দাবি, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করা এবং তাদের রাজ্য থেকে বের করে দেওয়া ।
অসমে CAA নিয়ে বিক্ষোভ হল স্থানীয় বাসিন্দাদের ভয় ও উদ্বিগ্নতার সঙ্গে সে রাজ্যের বৈরিতার রাজনীতির মিশ্রণ । এ রাজ্য অতীতে বহু বিক্ষোভ, বহু রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের সাক্ষী থেকেছে । কিন্তু যখন রাজ্যের অন্যতম প্রধান ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হল তখন সামনে এল রাজনৈতিক দলগুলির দৈন্যদশা । বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদ, আন্দোলনের খবর যখন সংবাদপত্রের শিরোনামে থাকছে তখন যেন কিছুটা চোখের আড়ালেই থাকছে অসমের আন্দোলন প্রসঙ্গ । এর জন্য অনেকাংশে দায়ি অসংবেদনশীলতা এবং উত্তর-পূর্বকে সেভাবে গুরুত্ব না দেওয়া । CAA নিয়ে অসমের এই আন্দোলনকে খুবই গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত । গুরুত্ব দেওয়া উচিত রাজনৈতিক দলগুলির এতদিন ধরে জিইয়ে রাখা এই সমস্যার মূলে পৌঁছনোরও । তবে এই সমস্যার মূলে রয়েছে ইতিহাসের কিছু ঘটনাও ।
ইতিহাসের গভীরে
অনুপ্রবেশকারীদের উপস্থিতির জন্য অসমের জনসংখ্যার বিপুল বৃদ্ধির সমস্যার দিকে তাকাতে গেলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে ঔপনিবেশিক আমলে । কংগ্রেসের প্রখ্যাত নেতা গোপীনাথ বরদলই মুসলিম লিগের মহম্মদ সাদউল্লার নেতৃত্বে গঠিত সংখ্যালঘু সরকারকে বাঙালি মুসলমানদের রাজ্যে অতিরিক্ত পরিমাণে প্রবেশ করিয়ে অসমের জনসংখ্যা ও সংস্কৃতি পালটে দেওয়ার জন্য বারবার অভিযুক্ত করেছেন । অসমের দ্রুত বদলে যাওয়া জনসংখ্যার বিষয়টি মাথায় রেখে স্বাধীন অসমের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলই রাজ্যে অভিবাসী আইন 1950 প্রয়োগ করেন । এর একমাত্র লক্ষ্য ছিল বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ)-এ ফেরত পাঠানো । 1951 সালের আদমসুমারি অনুযায়ী জাতীয় নাগরিকপঞ্জী (NRC) তৈরি করার কথা ছিল । কিন্তু 1950 সালে বরদলইয়ের মৃত্যু NRC-র কাজ সাময়িক স্থগিত করে দেয় । 1971 সালে এই বিষয়টি বড় আকারে ফের একবার সামনে আসে । তখন এই আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিল অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (AASU)। অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে AASU-র নেতৃত্বে হওয়া আন্দোলনের জেরে কংগ্রেস সরকারের পতন হয় এবং প্রফুল্ল মহন্তের নেতৃত্বে রাজ্যে ক্ষমতায় আসে অসম গণ পরিষদ (AGP)। কেন্দ্রের রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার এবং AASU-র মধ্যে একটি চুক্তি হয় যেখানে অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে প্রথমে তাঁদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দিয়ে এবং সবশেষে তাঁদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে একমত হয় দুই পক্ষ । কিন্তু, দু’বার ক্ষমতায় থেকেও AGP এই বিষয়ে অসমবাসীর চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয় । এই একই বিষয় হাতিয়ার করে ভারতীয় জনতা পার্টি (BJP) 2016 সালে রাজ্যে ক্ষমতায় আসে ।
অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়টি এখনও অসমবাসীদের সবচেয়ে বড় ক্ষোভের জায়গা রয়ে গিয়েছে আর রাজনৈতিক দলগুলি এর ফায়দা নিয়েই চলেছে । অর্থাৎ ইতিহাসই বলছে, কোনও রাজনৈতিক দলই এই ইশুটির সমাধান চায় না । সব দলই চায় এই বিষয়টিকে জিইয়ে রেখে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে । এর উপর দেশজুড়ে CAA প্রয়োগের ফলে অসমবাসীর ভয় ও উদ্বেগ আরও বেড়েছে ।
ভয়ের জায়গা
অসমবাসীদের ভয় ও উদ্বেগের জায়গাটা বহু স্তরের । এটা একইসঙ্গে তাঁদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ভাষা, রাজনৈতিক পরিচিতি খোয়ানোর মতো বিষয় । অসম, মেঘালয়, মিজোরাম এবং ত্রিপুরার আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে, অর্থাৎ যে সব এলাকা ভারতীয় সংবিধানের ষষ্ঠ তফশিলের আওতায় রয়েছে এবং যে সব এলাকা 1873 সালের বেঙ্গল ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রেগুলেশনের আওতায় 'ইনার লাইন' হিসেবে চিহ্নিত, সে সব জায়গায় CAA প্রয়োগ হবে না । CAA-র এই বিষয়টি নিয়েই অসমবাসীরা সবচেয়ে চিন্তিত । এই সব তফশিলে CAA প্রয়োগ না হওয়ার অর্থ রাজ্যের অন্য প্রান্তের উপর চাপ বাড়বে । এই সব এলাকা, যেগুলি দীর্ঘদিন ধরে অনুপ্রবেশকারীদের বাড়বাড়ন্তের ফলে জন বিস্ফোরণের শিকার সেখানে বৈধ নাগরিকরা সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন । যদিও এ বারের নাগরিকত্ব আইনের মূল লক্ষ্য হল ধর্মীয় বিভাজন— এই অভিযোগ সমাজের বেশ কিছু অংশ থেকে উঠছে । অসমের মতো রাজ্য যেখানে অনুপ্রবেশকারীদের সমস্যাটা দীর্ঘদিনের সেখানে এ বারেও যদি ঠিকমতো নজর না দেওয়া হয়, তাহলে অবহেলিত রাজ্যকে আরও বিপন্ন করে তোলা হবে মাত্র ।