দিল্লি, 24 জানুয়ারি : ভারতের জনগণের একটা বড় অংশ বাতাসে ভাসমান ক্ষতিকর কণা অর্থাৎ PM 2.5 ও PM 10-এর দূষণে আক্রান্ত । আমাদের দেশের বাতাসে এই ক্ষতিকর কণার পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র বেঁধে দেওয়া সীমার থেকে প্রায় সাতগুণ বেশি । এই ক্ষতিকর কণাগুলি মূলত দু'ধরনের উৎস থেকে ছড়ায় । একটি গৃহস্থলি উৎস । এক্ষেত্রে গৃহস্থলির কাজকর্মের জন্য কঠিন জ্বালানি (কয়লা, কোলবল, ঘুটে ইত্যাদি) পোড়ানোর জেরে এই কণাগুলি বাতাসে মেশে । দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বিভিন্ন কলকারখানা, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়ার মাধ্যমে এই ক্ষতিকর কণাগুলি বাতাসে মেশে । কণাগুলির আয়তন ও আকারের ভিত্তিতে দুটি শ্রেণি - PM 2.5 ও PM 10 । বাতাসে ভাসমান ক্ষতিকর PM 2.5-র পরিমাণের ভিত্তিতে বিশ্বে ভারতের স্থান তৃতীয় । 2018 সালে আমাদের দেশের বাতাসে PM 2.5-র পরিমাণ ছিল 72.5 μg/m³ (মাইক্রোগ্রাম প্রতি কিউবিক মিটার বাতাস)। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত পরিমাণ হল 10 μg/m³ । অর্থাৎ এই পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া মাত্রার থেকে সাতগুণ বেশি । বাতাসে ভাসমান ক্ষতিকর পদার্থের পরিমাণের দিক দিয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের স্থান বিশ্বে যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় । বাংলাদেশে ও পাকিস্তানে এই পরিমাণ যথাক্রমে 97.1 μg/m³ ও ৭৪.৩ μg/m³ ।
PM 2.5-র মান বাতাসে 55.5-150.4 μg/m³ -র মধ্যে থাকলে সেই বাতাস অস্বাস্থ্যকর । সেক্ষেত্রে ফুসফুস ও হৃদযন্ত্রের সমস্যার পাশাপাশি অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে । তাই বলা যেতে পারে, ভারতের অনেক জায়গায় যেখানে বাতাসে PM2.5 এর মান ৭২ μg/m থেকে ১৩৫ μg/m মধ্যে রয়েছে সেখানে বাসিন্দারা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করছে । কলকারখানাগুলি পরিবেশে কীভাবে এবং কতটা দূষণ ছড়াচ্ছে এবং তার জেরে বায়ুতে দূষণের মাত্রা কতটা বাড়ছে, সেই বিষয়ে কড়া আইন ও সঠিক নজরদারির অভাব রয়েছে আমাদের দেশে । দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলির কাজে যথেষ্ট খামতি রয়েছে বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ । আর তার জেরে বায়ু দূষণের মাত্রা ক্রমশ বাড়ছে এবং মানুষ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে এবং নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে । ভারতে এখন বিভিন্ন শহরে বায়ুদূষণের মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে । ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা দূষণের এই মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে পরিস্থিতির হাল ফেরানো কার্যত অসম্ভব ।
বিষয়টি এখানেই শেষ নয় । আরও কিছু পরিসংখ্যান যদি তুলে ধরি, তবে পাঠকরা চমকে যাবেন । যেমন, বিশ্বের প্রথম 50টি সবচেয়ে দূষিত শহরের মধ্যে ভারতেরই 25টি শহর জায়গা পেয়েছে । সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষিত হল গুরুগ্রাম ও গাজ়িয়াবাদ । 2018 সালের দূষণ সূচকের ভিত্তিতে তৈরি তালিকা অনুসারে এই শহর দুটির স্থান যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় । এই শহরগুলির বাতাসে ক্ষতিকর পদার্থ অর্থাৎ PM2.5-র পরিমাণ গড়ে 135 μg/m³ । বাতাসে এই ক্ষতিকর পদার্থের পরিমাণ সাধারণ সহনসীমার থেকে প্রায় 14 গুণ বেশি । ওই তালিকায় দেশের রাজধানী দিল্লির স্থান একাদশ । সেখানে বাতাসে PM2.5-র পরিমাণ 113.5 μg/m³ । ওই তালিকায় থাকা ভারতের প্রতিটি শহরই দূষণের নিরিখে ‘যথেষ্ট অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে বিবেচিত । কারণ ওই শহরগুলির বাতাসে ভেসে থাকা ক্ষতিকর পদার্থ শরীরে নানা রোগ ডেকে আনতে পারে ।
গতবছর HEI (হেলথ এফেক্টস ইনস্টিটিউট)-র সহযোগিতায় IHME (ইন্সটিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড এভালিউয়েশন) ‘বিশ্ব বাতাসের স্বাস্থ্য’ (স্টেট অফ গ্লোবাল এয়ার) শীর্ষক এক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে । এই রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে যে, 2017 সালে সারা বিশ্বে মানুষের মৃত্যু ও বিকলাঙ্গ হওয়ার যে ঘটনাগুলি ঘটেছে, সেজন্য প্রথম পাঁচটি কারণের মধ্যে বায়ুদূষণ অন্যতম । সাধারণত যে কারণগুলিকে আমরা মানুষের অসময়ের মৃত্যুর জন্য দায়ি করে থাকি যেমন, অতিরিক্ত মদ্যপান, অপুষ্টি ও শারীরিক পরিশ্রম বিমুখতা, সেগুলির থেকেও বায়ু দূষণ অনেক বেশি বিপজ্জনক বলে সমীক্ষায় দেখা গেছে । প্রতি বছর বিশ্বে গাড়ি দুর্ঘটনা বা ম্যালেরিয়ায় যত মানুষের মৃত্যু হয়, তার চেয়ে বেশি মৃত্যু হয় বায়ু দূষণ জনিত কারণে । বাতাসে ভাসমান PM2.5 মানুষের ফুসফুসে ঢুকে তার দেওয়ালের ক্ষতি করে এবং তার কার্যকারিতা ক্রমশ কমিয়ে দেয় । বাতাসে ভাসমান এই ক্ষতিকর পদার্থগুলি পালমোনারি এপিথেলিয়াম ভেদ করে শরীরে ঢোকে । তাই PM2.5 হৃদরোগ, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে সংক্রমণ এবং ক্যানসারের অন্যতম কারণ । রিপোর্টে বলা হয়েছে, মানুষের অসময়ে মৃত্যুর প্রথম যে পাঁচটি কারণ রয়েছে তার মধ্যে পঞ্চম কারণটি হল বায়ুদূষণ । 2017 সালে বায়ুদূষণ জনিত কারণে বিশ্বে 4.9 মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং 147 মিলিয়ন বছর স্বাস্থ্যবান জীবন নষ্ট হয়েছে ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বায়ু দূষণকে গুরুতর অসংক্রমিত রোগের শ্রেণীভূক্ত করেছে । সংস্থা জানিয়েছে, বিশ্বে বায়ু দূষণ বিভিন্ন ভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের মৃত্যুর জন্য দায়ি । প্রাপ্তবয়স্কদের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় 24 শতাংশ ক্ষেত্রে দায়ি বায়ু দূষণ । স্ট্রোকের ক্ষেত্রে এই হার 25 শতাংশ, COPD (ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজ়িজ়)- এর ক্ষেত্রে 43 শতাংশ এবং ফুসফুসে ক্যানসারের ক্ষেত্রে এই হার 29 শতাংশ ।
ভারতে বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে কারণ হিসেবে অপুষ্টির পর দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বায়ু দূষণ । আর এই দূষণের জন্য দায়ি বাতাসে বেড়ে চলা পার্টিকুলেট ম্যাটারের (PM2.5)-এর পরিমাণ । 2017 সালে বাতাসে পার্টিকুলেট ম্যাটার ও গৃহস্থালির কাজকর্মে সৃষ্ট দূষণের জেরে 10 লাখেরও বেশি মানুষের বিশ্বে মৃত্যু হয়েছে । IHME তাদের রিপোর্টে জানিয়েছে, ভারতে বাতাসে পার্টিকুলেট ম্যাটারের উপস্থিতি জনসংখ্যার একটা বড় অংশের মধ্যে হৃদরোগ ও শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার অন্যতম কারণ । দেশে 2017 সালে মোট মৃত্যুর 12 শতাংশের পেছনে কারণ ছিল বাতাসে ভাসমান পার্টিকুলেট ম্যাটার । আরও নির্দিষ্ট করে বললে এই 12 শতাংশের মধ্যে 7 শতাংশ ক্ষেত্রে বাতাসে ভাসমান পার্টিকুলেট ম্যাটার এবং 5 শতাংশ ক্ষেত্রে গৃহস্থালির কাজকর্মের জেরে সৃষ্ট দূষণে মানুষের মৃত্যু হয়েছিল । ঘটনাচক্রে এই হার গত দুই দশক ধরে প্রায় একই রয়েছে ।
সাম্প্রতিক কালে ভারতে যাঁদের শ্বাসনালীতে সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে, সমীক্ষায় দেখা গেছে তাঁদের মধ্যে 47 শতাংশের এই সমস্যা হয়েছে বাতাসে ভাসমান ক্ষতিকর কণা PM2.5-র জন্য । পাশাপাশি এটাও দেখা গেছে এই ক্ষতিকর কণার মধ্যে কলকারখানার দূষণ দায়ী 26 শতাংশ ক্ষেত্রে এবং গৃহস্থালির কাজকর্মের জন্য কঠিন জ্বালানি পোড়ানোর জন্য বায়ুতে যে দূষণ হয় তা দায়ী 21 শতাংশ ক্ষেত্রে ।
ভারতের মানুষের ফুসফুস ও হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যার জন্য বায়ু দূষণ বা PM2.5 কতটা দায়ি, তা নিয়ে সমীক্ষা করে দেখা গেছে যে, ইসকেমিক হার্ট (Ischemic heart)অসুখে ভুগছেন যাঁরা তাঁদের মধ্যে 22.17 শতাংশ রোগীদের ক্ষেত্রে এই রোগের জন্য বায়ু দূষণ বা PM2.5 দায়ি । আরও ভেঙে বললে, কলকারখানার ধোঁয়া দায়ি 13.88 শতাংশ ক্ষেত্রে এবং গৃহস্থালির কাজের জন্য পোড়ানো কঠিন জ্বালানি দায়ি 8.29 শতাংশ ক্ষেত্রে । যাঁরা COPD অর্থাৎ ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজ়িজ়-এ ভুগছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে কলকারখানার দূষণ দায়ি 22.48 শতাংশ ক্ষেত্রে এবং গৃহস্থালির কাজকর্মের জন্য সৃষ্ট দূষণ দায়ি 17.62 শতাংশ ক্ষেত্রে ।
ওয়াকিবহাল মহলের একটা অংশের অভিযোগ যে, ভারতে বায়ু দূষণ কমানোর জন্য যে সরকারি বিধিনিষেধ ও পরিকাঠামো রয়েছে, তা বাস্তবে ফলপ্রসূ নয় । উলটে দেশে দিন দিন বায়ু দূষণ বেড়ে চলেছে । এই প্রসঙ্গে রাজধানী দিল্লির উদাহরণ টানা যেতে পারে । সেখানে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কয়েক বছর ধরে সমস্ত গাড়িতে CNG (কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস) ও ক্যাটালিটিক কনভার্টার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে । কিন্তু তা সত্ত্বেও দিল্লিতে দূষণের মাত্রা ‘অস্বাস্থ্যকর’ ও ‘অতি অস্বাস্থ্যকর’ পর্যায়ে রয়ে গেছে । শুধু দিল্লি নয়, দেশের অন্যত্র ছবিটা প্রায় এক । বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী ইতিমধ্যে সমস্ত নতুন গাড়িকে BS IV স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলতে হচ্ছে । কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশে বায়ু দূষণ উল্লেখ্য মাত্রায় কমেনি । এর অন্যতম কারণ, দেশে যত সংখ্যক নতুন গাড়ি BS IV স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলছে, তার চেয়ে অনেক বেশি পুরনো গাড়ি সেই বিধি না মেনেই চলাচল করছে । আর তার জেরেই বায়ু দূষণ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমছে না ।
দেশে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ না করতে পারার অন্যতম কারণ অনেক কলকারখানা দূষণ বিধি মেনে চলছে না । অনেকক্ষেত্রে কলকারখানার পরিচালন কর্তৃপক্ষ দূষণ বিধি লঙ্ঘন করে এবং সেজন্য তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থাও নেওয়া হয় না । দূষণ বিধি মেনে চলার জন্য কলকারখানায় যে সমস্ত প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ব্যবহার করা ও সেগুলি রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন, সেই বাবদ অর্থ খরচ করতে চায় না পরিচালন কর্তৃপক্ষ । তাই শেষ পর্যন্ত যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা থেকে যায় তা হল আমরা কি এভাবেই উদাসীন থাকব এবং দূষণের সঙ্গে ঘর করব ? না কি এই সমস্যার সমাধানের জন্য উদ্যোগী হব ?
বায়ূদূষণের মাত্রা কী হারে বাড়ছে তার উপর নজরদারি চালালেই সমস্যা মিটবে না । যেটা দরকার তা হল যে সমস্ত কলকারখানা দূষণ বিধি মানছে না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং তারা যাতে দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ব্যবহার করে সেই বিষয়ে নজরদারি চালিয়ে যাওয়া । আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই নজরদারির কাজটা যাঁরা করবেন সেই দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কর্মী ও আধিকারিকদের সংশ্লিষ্ট বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন তবেই সমস্যা মেটানোর ক্ষেত্রে সাফল্য আসবে এবং আমরা ভালোভাবে বাঁচতে পারব ।