স্ব-শাসন এবং আত্ম-সংযম । এটাই ছিল মহাত্মা গান্ধির মতে স্বরাজের সত্যিকার অর্থ । মহাত্মা গান্ধির বিশ্বাস ছিল, মুষ্ঠিমেয় মানুষের হাতে ক্ষমতা থাকলে স্বরাজ পাওয়া সম্ভব না । তাহলে স্বরাজ কী করে আসবে ? গান্ধির মতে, ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করা ও কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার মাধ্যমেই স্বরাজ আসতে পারে । আর তার জন্য প্রয়োজন জনগণের ক্ষমতায়ন ।
ভারতের প্রাণ দেশের গ্রামগুলিতে । ভারতের জনসংখ্যার 66.4 শতাংশের বসবাস গ্রামে । এই কারণে ভারতীয়দের মধ্যে স্বরাজবোধ আনতে গেলে তা প্রথমে গ্রামীণ সমাজে আনা দরকার । এমনই মত ছিল গান্ধির । তাই ভারতে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও গ্রামীণ এলাকাগুলোকে অগ্রাধিকার দিতেন তিনি । গান্ধির মতে গ্রাম-স্বরাজ মানে গ্রামগুলির স্বনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি ।
গান্ধির বিশ্বাস ছিল ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের আগে গ্রামগুলির স্বরাজ দরকার । 1942 সালে এক প্রতিবেদনে গান্ধি লেখেন, "অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক শক্তি মুষ্ঠিমেয় মানুষের হাতে কুক্ষিগত থাকলে তা স্বরাজের ধারণাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে । স্বরাজকে সুরক্ষিত করতে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে গ্রামগুলিকে স্বনির্ভর করতে হবে । রাজনৈতিক ভাবে গ্রামের মহিলা সহ সকল বসবাসকারীদের সরাসরি নিজেদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে হবে । সবার জন্য সমান সুযোগ । পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে গ্রাম পঞ্চায়েতের কাজকর্ম করা উচিত । এ ভাবেই গ্রাম অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের প্রাথমিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে ।"
ভারতে আদর্শ গ্রামের যে স্বপ্ন গান্ধি দেখতেন, তা তাঁর এই প্রতিবেদনে ফুটে ওঠে । পাশাপাশি ব্রিটিশরাজের সময়ে চলা শিল্পায়নের ঘোর বিরোধী ছিলেন গান্ধি । তিনি বলতেন, "গণ উৎপাদন নয়, জনগণের দ্বারা উৎপাদন প্রয়োজন ।" এইভাবে তিনি অর্থনৈতিক উন্নয়নের কেন্দ্রস্থলে রেখেছিলেন গ্রাম স্বরাজকে ।
গান্ধি লিখেছিলেন, "প্রতিটি গ্রামের স্বনির্ভর থাকা উচিত । সমস্ত প্রয়োজনীয় বস্তুর উৎপাদন যেন গ্রামেই হয় । যেমন, খাদ্য, পোশাক উৎপাদন, পানীয় জল, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, আবাসন, শিক্ষা সহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পরিষেবা প্রদান এর অন্তর্গত । গ্রামীণ ব্যবস্থায় বিভিন্ন বিষয়ের নিষ্পত্তির জন্য পঞ্চায়েত থাকার পাশাপাশি সকল ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়, সমবায় দুগ্ধ খামার, শিল্প শিক্ষা প্রদানকারী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় থাকা দরকার ।"
1942 সালে গান্ধি যে আদর্শ গ্রামের কথা লিখেছিলেন, তা তাঁর মৃত্যুর দীর্ঘ 71 বছর পর আজ বাস্তবায়িত হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে । জম্মু ও কাশ্মীরের কুপওয়াড়া জেলার ত্রেহ্গাম ব্লকের লেদারওয়ান গ্রাম হোক বা ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূমের দুর্গম ও প্রত্যন্ত গ্রামগুলি এর উদাহরণ । গান্ধির স্বপ্ন ফুটে উঠছে এরকম বহু গ্রামের স্বনির্ভর হওয়ার মধ্য দিয়ে । আর সেটাই হল তাঁর 150তম জন্মজয়ন্তীতে গান্ধির প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদান ।