দেশের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে উচ্চশিক্ষা, শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা শেখানো হয়, সেখানকার কিছু শিক্ষকের আচরণ যথেষ্ট চিন্তা ও ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে । যে পেশার মূল নীতি হল আদর্শ এবং নীতি, সেই পেশায় থেকেও কিছু শিক্ষক ছাত্রছাত্রী এবং রিসার্চ স্কলারদের নির্যাতন করছেন বলে অভিযোগ । এঁদের মধ্যে কেউ আবার ছাত্রছাত্রীদের যৌন নির্যাতন করার দায়ে জেল পর্যন্ত খেটেছেন । দিন দশেক হল অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ সামনে এসেছে । বিষয়টি রাজ্যে প্রবল আলোড়ন ফেলেছে। অভিযুক্তদের মধ্যে দু’জনকে চার দিন সমন করা হয়েছিল, কাউন্সেলিং সেশনে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এবং তারপর শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেওয়া হয়েছে । তাঁদের সাবধান করে দিয়ে বলা হয়েছে যে, এই ধরনের অভিযোগ ভবিষ্যতে আবার তাঁদের বিরুদ্ধে এলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে । এই বিষয়টি তখন সামনে আসে, যখন নির্যাতিতাদের সামনে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে অভিযোগ দায়ের করা ছাড়া আর কোনও রাস্তা খোলা ছিল না ।
এই সমস্যাটা কিন্তু শুধুমাত্র অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের একার নয় । দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা এই ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হতে বাধ্য হচ্ছেন । এঁদের মধ্যে কাউকে আর্থিক বিষয়ে হয়রান করা হয়, তো কাউকে যৌন নির্যাতনের শিকার করা হয় । মেডিক্যাল কলেজগুলিও এই সমস্যার বাইরে নয় । নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অনেকে আত্মহত্যাও করেন । ছাত্রছাত্রীদের প্রতি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে ১৯৮৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (UGC) একটি রূপরেখা তৈরি করে । এই বিষয়টি দেখভালের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে UGC একটি টাস্কফোর্স গঠন করে, কার্যক্ষেত্রে ব্যবহার কেমন হওয়া উচিত, তা নির্দিষ্ট করে । কাজ করতে আসা শিক্ষকদের এই রূপরেখা মনে গেঁথে রাখা উচিত । কিন্তু, দুঃখের ব্যাপার হল, বহু ক্ষেত্রে এই সচেতনতার অভাব ঘটছে । অনেকে আবার এই রূপরেখা সম্বন্ধে ওয়াকিবহালই নন । যার ফলে, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যেন, যেমন খুশি ব্যবহার করার ‘অধিকার’ জন্মে গিয়েছে । যেহেতু এই রূপরেখা না মানলে শাস্তির কোনও নির্দিষ্ট বিধান নেই, তাই নির্দেশগুলি সে ভাবে কার্যকর হচ্ছে না । যে সকল শিক্ষক অনৈতিক কাজ করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারের তরফে তেমন কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না । এর ফলে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাজনীতি ও জাতিগত মতপার্থক্যের কেন্দ্র হয়ে উঠছে।
এখন কলেজ শিক্ষকদের মধ্যে ভাইস চ্যান্সেলর, রেজিস্ট্রার বা ডিন হওয়ার আগ্রহ বেড়ে গিয়েছে । ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নিয়মানুবর্তিতা, শিষ্টাচার শেখানোর বদলে শিক্ষকরাই এখন দলবাজিতে ব্যস্ত । কখনও সে সব গোষ্ঠি তৈরি হচ্ছে সম্প্রদায়ের ভিত্তিতেও । দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে গবেষণার মানের উন্নতিতে সরকারকে ব্যবস্থা নিতেই হবে । আর তা সম্ভব হবে যদি ছাত্রছাত্রীদের মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয় । প্রফেসররা নিয়মিত ক্লাসে না এলেও রিসার্চ স্কলাররা তাঁদের কোনও প্রশ্ন করতে পারেন না । যদি কেউ অভিযোগ করেন, তা হলে তাঁদের PhD করার আশা ছাড়তে হবে । তাঁদের রিসার্চের সঙ্গে যুক্ত সব প্রফেসরদের বাধ্যতামূলক ভাবে ছাত্রছাত্রীদের সুনাম করতেই হবে । গাইড পরিবর্তন করতে চাইলে ছাত্রছাত্রীদের তাঁদের বর্তমান গাইডের থেকে অনুমতি নিতে হবে । ছাত্রছাত্রীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া এই সব অলিখিত নিয়মের জন্যই শিক্ষকরা যা খুশি করার লাইসেন্স পেয়ে যাচ্ছেন । নিয়োগে অস্বচ্ছতা থাকার জন্য বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে । স্বচ্ছতা আনার জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়ার দায়িত্ব অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হলেও তাঁদের মধ্যে অনেকে দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ায় সমগ্র প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে । চ্যান্সেলরদের কাছে শিক্ষকদের খারাপ ব্যবহার নিয়ে অভিযোগ যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে । খোদ রাজ্যপালের অফিস থেকে এ সব বিষয়ে তদন্তের সুস্পষ্ট নির্দেশিকা থাকলেও শিক্ষকরা বিষয়টি নিয়ে একেবারেই চিন্তিত নন । বহু ক্ষেত্রেই অভিযোগগুলিকে স্রেফ উপেক্ষা করা হয়েছে এবং অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি ।
মহিলাদের বিরুদ্ধে নির্যাতন বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ে অভ্যন্তরীণ কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেই সব কমিটিতে কম সদস্য থাকায় অভিযোগ এলেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, বা বহু ক্ষেত্রে দেখাই হচ্ছে না । বহু ক্ষেত্রে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ সামনে এসেছে । এ সবই গোটা প্রক্রিয়ায় সমস্যার ছিদ্রপথ যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে । এর একমাত্র সমাধান, প্রাচীন ও বস্তাপচা নিয়মকানুনের সংস্কার । এই পরিস্থিতির পরিবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ করলেই হবে না, উপযুক্ত পরিবেশেরও ব্যবস্থা করতে হবে।