জনগণনার জন্য সব প্রস্তুতি শেষ
প্রতি 10 বছর অন্তর দেশের জনগণনা হয় । এই বছর জনগণনা 1 এপ্রিল থেকে শুরু হওয়ার কথা ৷ স্বাধীনতার পর থেকে ছয় বার জনসংখ্যা গণনার কাজ করা হয়েছে ৷ এই বছর জাত অনুযায়ী তথ্য সংগ্রহের দাবি আরও জোরালো হয়েছে ৷ কোনও দেশের মানবসম্পদের দক্ষতার মাধ্যমে অর্জিত অর্থনৈতিক বিকাশকে তার 'জনসংখ্যাতাত্ত্বিক লভ্যাংশ' হিসেবে বিবেচনা করা হয় । সাম্প্রতিককালে জাতীয় এবং রাজ্যস্তরের দলগুলি অনেক বেশি কল্যাণমূলক প্রকল্পের ঘোষণা করেছে ৷ এই প্রকল্পগুলি নিয়ে কাজ করতে হলে জনসংখ্যার তথ্য থাকা খুবই জরুরি ৷ এই তথ্য সংরক্ষণ দেওয়ার ক্ষেত্রেও খুব গুরুত্বপূর্ণ ৷ সমাজিক পরিবর্তনের জন্য ভালো মানের শিক্ষার ব্যবস্থা করাও অপরিহার্য ৷ তাহলেই দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হবে ৷ যদি অসঙ্গত রিপোর্ট তৈরি করা হয়, তাহলে এই জনসংখ্যাই দেশের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনবে ৷ রাষ্ট্রসংঘের বিশ্ব জনগণনা রিপোর্ট (2019) অনুযায়ী ভারতের জনসংখ্যা 2027 সালের মধ্যে চিনকে অতিক্রম করে যাবে এবং তখন ভারত জনসংখ্যা নিরিখে বিশ্বের এক নম্বর দেশ হয়ে উঠবে ৷
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে গত 50 বছর ধরে ভারত পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি লাগু করতে চাইছে ৷ কিন্তু জনসংখ্যার বৃদ্ধিতে ঠিক কী ধরনের আর্থিক ও সামাজিক দিক কাজ করছে তা শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে এই পদক্ষেপগুলি ৷ জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে যে বাধাগুলি তৈরি হয়েছে তা নির্ণয় করতে নতুন করে ভাবনাচিন্তা করা প্রয়োজন ৷ সাধারণত মনে করা হয় যে, যদি জনসংখ্যা বাড়ে তাহলে মাথাপিছু রোজগার কমে যাবে এবং দেশ আরও গরিব হয়ে যাবে ৷ একবিংশ শতকে মানুষের ব্যবহার এবং চাহিদা বদলে গিয়েছে ৷ অভিভাবকরা সন্তানকে ভবিষ্যতের উপার্জনকারী এবং বৃদ্ধ বয়সের সাহায্যকারী হিসেবে দেখছেন ৷ ফলে সন্তানের প্রতি নির্ভরতা বাড়তে শুরু করেছে ৷ চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য মৃত্যুর হারও ক্রমশ কমতে শুরু করেছে ৷ নিরক্ষরতা এবং জনসংখ্যা নিয়ে পুরানো ধ্যানধারণা জনসংখ্যাকে বাড়িয়ে চলেছে ৷ বিভিন্ন জাতি, ধর্ম এবং সংস্কৃতি জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে ৷
জনসংখ্যার বৃদ্ধির দিক থেকে এশিয়া মহাদেশে ভারতের স্থান সবচেয়ে নিচে ৷ 1951 সাল থেকে 1971 সালের মধ্যে ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল 2.1 শতাংশ ৷ 1971 সাল থেকে 1991 সালের মধ্যে এই বৃদ্ধির হার 2.2 শতাংশ ৷ 1991 সাল থেকে 2011 সালের মধ্যে এই হার নেমে এসেছে 1.8 শতাংশে ৷ 2011 সাল থেকে 2016 সালের মধ্যে এই বৃদ্ধির হার আরও কমে হয়েছে 1.3 শতাংশ ৷ অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী (2019), 2011-12-তে জনসংখ্যার বার্ষিক বৃদ্ধির হার ছিল 1.1 শতাংশ ৷ 2021-2031 সালের মধ্যে এটা 0.7 শতাংশ এবং 2031-41 সালের মধ্যে 0.5 শতাংশ হবে বলে ধরা হয়েছে ৷ এটা সর্বজনবিদিত যে, এই দেশের পুরুষদের তুলনায় শতাংশের হারে মহিলাদের সংখ্যা কম ৷ দেশে তরুণ-তরুণীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে ৷ আগামী দশকের মধ্যে 20 থেকে 59 বছর বয়সি জনসংখ্যার বেশিরভাগটাই দেশের শ্রমশক্তি তৈরি করবে ৷ 2041 সালের মধ্যে গড় বয়স গিয়ে দাঁড়াবে 59 বছর ৷ ‘স্যাম্পেল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম ডেটা বলছে’ যে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড এবং ছত্তিশগড়কে জনসংখ্যা কমাতে এবং নিয়ন্ত্রণে রাখতে পদক্ষেপ করতে হবে ৷ জীবনযাত্রার মান, জনসংখ্যাতাত্ত্বিক লভ্যাংশ, শহুরে জনসংখ্যার বৃদ্ধি, রোজগারের বৈষম্য, আগামী দিনে সবচেয়ে বড় বাধা হতে চলেছে ৷ 'ইন্ডিয়া এজিং'-এর একটি সমীক্ষা রিপোর্ট (2017) অনুযায়ী 2015 সালে 60 বছর বয়সের মানুষের সংখ্যা ছিল 8 শতাংশ ৷ এই সংখ্যা 2050 সালে 19 শতাংশে পৌঁছে যাবে ৷
মানুষকে নিজেদের দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে হবে ৷ এর জন্য প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষায় একটা বড়সড় সংস্কার প্রয়োজন ৷ ছাত্রদের গবেষণায় আরও উৎসাহিত করা উচিত ৷ ‘স্কিল ইন্ডিয়া’র মতো কর্মসূচি তরুণ-তরুণীদের দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে ৷ এই পদ্ধতি লাগাতার চালিয়ে যেতে হবে ৷ গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হলে বৃত্তিমূলক শিক্ষার দক্ষতাকে আরও বাড়াতে হবে ৷ একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়ে গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থাকেও আরও উন্নত করতে হবে ৷ শেষপর্যন্ত দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করে তাঁদের সম্পদের উৎপাদক হিসেবে তুলে ধরতে হবে ৷ কিছু সময় ধরেই দেশ অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি হয়েছে ৷ তবে, বিদেশে কর্মরত কর্মী থেকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়রদের মাধ্যমে বৈদশিক মুদ্রার আদানপ্রদান বন্ধ হয়ে যায়নি ৷ এই সময় এর থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে, দক্ষ মানবসম্পদ একটা দেশের অর্থনীতির জন্য কতটা জরুরি ৷ চিন জনসংখ্যার নিরিখে বিশ্বের সর্ববৃহৎ দেশ ৷ তার পরও সেখানকার মানুষ প্রায় সব ক্ষেত্রে নিজেদের দক্ষতাকে বাড়িয়ে দেশকে বিশ্বের অন্যতম বড় শক্তিতে পরিণত করতে পেরেছে ৷ তারা এখন অ্যামেরিকাকেও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে ৷ জনসংখ্যা মারাত্মকভাবে বেড়ে গেলেও, যদি সেই দেশ দক্ষ হয়, তাহলে তা দেশের অগ্রগতির কাজেই আসে ৷ চিন এই উদাহরণই তুলে ধরছে ৷ উলটোদিকে দক্ষতা এবং সম্পদের অভাবে অতিরিক্ত জনসংখ্যা যেকোনও দেশের কাছে অভিশাপ হয়ে উঠতে পারে ৷ ভারতের এই বিষয়ে সতর্ক হওয়া উচিত ৷ এটা সর্বজনবিদিত যে, যদি একজন মহিলা শিক্ষিত হয় তাহলে পুরো পরিবারই শিক্ষিত হবে ৷ ‘বেটি পড়াও, বেটি বাঁচাও’ প্রকল্পের মাধ্যমে মেয়েরা মানবসম্পদ তৈরিতে বড় ভূমিকা নিতে পারে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে অবদান রাখতে পারে ৷ এই ধরনের প্রকল্পগুলি দেশকে 'জনসংখ্যাতাত্ত্বিক লভ্যাংশ' দেয় ৷ কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পায় এবং বেকারত্ব কমতে থাকে ৷ দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হলেই দেশের অর্থনৈতিক শক্তির বৃদ্ধি ঘটবে ৷ একমাত্র তখনই জনসংখ্যার বৃদ্ধি দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে ৷