ETV Bharat / bharat

তাপপ্রবাহের বিরুদ্ধে লড়ছে বিশ্ব

বিশ্ব বর্তমানে বিভিন্ন সমস্যায় ধুঁকছে । এই বিশ্বে বর্তমানে কোথাও না কোথাও, কিছু না কিছু দুর্যোগ ঘটেই চলেছে । লিখছেন ডাঃ কে বাবু রাও (পরিবেশ বিশেষজ্ঞ)

author img

By

Published : Oct 4, 2020, 3:35 PM IST

ছবি
ছবি

বিশ্ব বর্তমানে বিভিন্ন সমস্যায় ধুঁকছে । এই বিশ্বে বর্তমানে কোথাও না কোথাও, কিছু না কিছু দুর্যোগ ঘটেই চলেছে । তা সে দাবানল হোক বা হারিকেন, বন্যা, খরা বা অন্য কিছু, যা মানবজাতির পক্ষে ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে । তীব্র তাপপ্রবাহের জন্য অ্যামেরিকার পশ্চিম উপকূলে 12টি রাজ্য সম্প্রতি দাবানলে বিপর্যস্ত হয়েছে । সেই দাবানলের জেরে অ্যামেরিকার ১২টি রাজ্যের আকাশ এখনও লাল । সেই সমস্ত রাজ্যগুলির দাবানলের ধোঁয়া মাটি থেকে প্রায় 10 কিমি উচ্চতা পর্যন্ত পৌঁছেছে । শুধু তাই নয়, অ্যামেরিকার পশ্চিম উপকূল থেকে দাবানলের সেই ধোঁয়া সেই দেশের পূর্ব উপকলের রাজ্যগুলিতেও পৌঁছে গিয়েছে এবং এইভাবে দেশের একটা বড় অংশে বায়ু দূষণ ঘটিয়েছে সেই ধোঁয়া । এখনও পর্যন্ত অ্যামেরিকার যে পরিমাণ অংশ দাবানলে বিপর্যস্ত তার পরিমাণ হল প্রায় 69 মিলিয়ন একর । সেই সমস্ত বিপর্যস্ত এলাকার মধ্যে প্রায় 33 মিলিয়ন একর শুধু সেই দেশের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের অন্তর্গত । দাবানল এক বিশ্বব্যাপী সমস্যা । বিশ্বের কোনও এলাকাই দাবানলের সেই করাল গ্রাস থেকে মুক্ত নয় । তা সে উত্তর মেরুর আলাস্কা বা সাইবেরিয়া হোক কিংবা দক্ষিণ গোলার্ধের অস্ট্রেলিয়া, পূর্বে এশিয়া বা পশ্চিমে অ্যামেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল ।

সমস্ত দেশের জন্যই বিপদ

ভারতে দাবানলে যে পরিমাণ অরণ্য এলাকা বিপর্যস্ত হয়েছে তার পরিমাণ চিহ্নিত হয়েছে সরকারের তরফে । সেই পরিমাণ হল দেশের মোট অরণ্য এলাকার 21.4 শতাংশ । গত বছর আমাদের দেশে নথিভূক্ত দাবানলের ঘটনার সংখ্যা ছিল 29 হাজার 547 । চলতি বছরের মে মাসে দেশের উত্তরাখণ্ড রাজ্যে ভয়াবহ দাবানল শুরু হয় । অন্যদিকে, 1 সেপ্টেম্বর প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তানে ভয়াবহ বন্যায় 190 জনের মৃত্যু হয় । অন্যদিকে নেপাল, চাদ, সেনেগাল, সুদান, নাইজেরিয়া, কেনায়ি, বুরকিনা ফাসো, ঘানা, পাকিস্তান, ক্যামেরুন, আলজিরিয়া, তিউনিসিয়া, ভিয়েতনাম এবং উগান্ডার বাসিন্দারাও সেই সেপ্টেম্বর মাসেই ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । আমাদের দেশে অর্থাৎ ভারতে অগাস্ট মাসে প্রায় 11টি রাজ্যে ভয়াবহ বন্যায় প্রায় 868 জন লোকের মৃত্যু হয়েছে । এছাড়া দেশের প্রায় এক পঞ্চমাংশ এলাকা খরার কবলে পড়েছে । শুধু তাই নয়, অ্যামেরিকার একদিকে যখন দাবানল, তখন অন্যদিকে দেশের এক তৃতীয়াংশ এলাকা খরার কবলে পড়ে বিপর্যস্ত । সে দেশের প্রায় 5 কোটি 30 মিলিয়ন মানুষ খরার কবলে পড়েছে । এই সমস্থ ঘটনা এটাই ইঙ্গিত দেয় যে, বিশ্বের কোনও দেশই দুর্যোগ থেকে মুক্ত নয় ।

যদিও এই বছর কোভিডের জন্য জনজীবন কিছুটা থমকে গিয়েছে । আর তার জেরে পরিবেশে দূষণের পরিমাণ চলতি বছরের গত কয়েক মাসে কিছুটা কম । তাই আশা করা যাচ্ছে যে, বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ 4 থেকে 7 শতাংশ কমবে । যদিও বিশ্ব উষ্ণায়ন রিপোর্ট অনুসারে 2010 সালের তুলনায় 2030 সালে বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ প্রায় 45 শতাংশ কমবে । কিন্তু বিশ্বে কোথাও সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে তেমন কোনও উদ্যোগ এখনও পর্যন্ত লক্ষ্য করা যাচ্ছে না । সরকার, সাধারণ মানুষ এবং গণমাধ্যম এই গুরুতর সমস্যাটিকে সেভাবে এখনও গুরুত্বই দিচ্ছে না । 2019 সালে ভারতে নির্বাচনের সময় পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে রাখার এই বিষয়টিকে কোনও রাজনৈতিক দলই তাদের ইস্তাহারে কিন্তু উল্লেখ করেনি । বিশ্ব পরিবেশ সংস্থার তরফে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে । এই রিপোর্ট প্রকাশে বিশ্ব পরিবেশ সংস্থাকে সাহায্য করেছে বিজ্ঞান বিষয়ক চর্চার জন্য প্রসিদ্ধ বিশ্বের 6টি অগ্রগণ্য সংস্থা । সেই রিপোর্ট অনুসারে, 2024 সালের মধ্যে বিষ্ণ উষ্ণায়ন আপাতভাবে প্রায় 1.5 ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে । আর এই সম্ভাবনাও যথেষ্ট প্রবল যে, খুব শীঘ্রই উষ্ণায়নের হারের এই বৃদ্ধি স্থায়ী হবে । আর একটি রিপোর্ট সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে প্রকাশিত হয়েছে । সেই রিপোর্ট অনুসারে 2050 সালের মধ্যে পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য বিশ্বের প্রায় 120 মিলিয়ন মানুষ উদ্বাস্তু হবে, যা গোটা বিশ্বের জন্যই একটি বড় বিপদ । নিরক্ষ রেখা প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার যে অংশ দিয়ে গিয়েছে সেখানে ভূমিপৃষ্ঠের তাপমাত্রা যদি স্বাভাবিক তাপমাত্রার থেকে 0.5 ডিগ্রি সেলসিয়াস কম হয় তবে তাকে বলা হয় লা নিনা প্রভাব । আর এই প্রভাবের জেরে বর্তমানে অ্যামেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলবর্তী এলাকায় বায়ুমণ্ডলে তাপপ্রবাহ বেড়ে গিয়েছে এবং সেই দেশের অরণ্য এলাকা দাবানলে বিপর্যস্ত হয়েছে ।

চরম জলবায়ু অবস্থা

স্প্যানিশ ভাষায় ‘লা নিনা’ মানে ছোট বালিকা । আর যে পরিবেশের যে পরিস্থিতিতে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা স্বাভাবিক তাপমাত্রার তুলনায় যদি কমপক্ষে 0.5 ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পায়, তবে পরিবেশে সেই ঘটনার প্রভাবকে বলা হয় এল নিনো । স্প্যানিশ ভাষায় এই শব্দের অর্থ হল ছোট বালক । না নিনার জেরে অ্যামেরিকার দক্ষিণ ও পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে শুষ্ক তাপপ্রবাহ ঘটে এবং উত্তর ও পূর্ব উপকূলে শীতল ও আদ্র বাতাস প্রবাহিত হয় । শুধু তাই নয়, এর জেরে পূর্ব আটলান্টিক উপকূলীয় অঞ্চলে একাধিক শক্তিশালী ঝড়ও হয় । লা নিনা একটা প্রাকৃতিক ঘটনা । কিন্তু বিশিষ্ট আবহাওয়াবিদ মাইকেল ম্যান বলেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে প্যারিসে সাম্প্রতিক কালে তাপপ্রবাহ, দাবানল এবং বড়মাপের ঝড় হয়েছে । তা ছাড়া বিষ্ণ উষ্ণায়নের জেরে লা নিনার জন্য অ্যামেরিকায় সাম্প্রতিক কালে দাবানল এমনভাবে ছড়িয়েছে যে, যা নিয়ন্ত্রণ করা কার্যত দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছিল সেই দেশের সরকারের পক্ষে । 1970 সালের তুলনায় বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ার অরণ্য অঞ্চলে দাবানলের পরিমাণ প্রায় পাঁচগুণ বেড়ে গিয়েছে । শুধু তাই নয়, গ্রীষ্মে ক্যালিফোর্নিয়ায় এই দাবানলের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে আটগুণ । দাবানলের পরিমাণ এতটা বেড়ে যাওয়ার কারণ হল তীব্র তাপপ্রবাহের জেরে গ্রীষ্মে অরণ্যের গাছপালা ও ঘাস শুকিয়ে যাওয়ার জন্য । একদিকে অ্যামেরিকার পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে দাবানল যখন অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়েছে, তখন অন্যদিকে ওই এলাকার কয়েকশো মাইল পূর্বে কলোরেডো, ওয়োমিং সহ বিভিন্ন শহরে তখন উলটো চিত্র । সেখানে তাপমাত্রার পারদ অস্বাভাবিক হারে নেমে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে সাম্প্রতিক কালে । ওই সমস্ত এলাকায় তাপমাত্রা কমার হার স্বাভাবিকের থেকে প্রায় 33 ডিগ্রি সেলসিয়াস । 7 তারিখ সন্ধ্যা থেকে পরের দিন সকাল পর্যন্ত প্রায় 18 ঘণ্টা ধরে তাপমাত্রা কমার এই অস্বাভাবিক হার লক্ষ্য করা গেছে ওই সমস্ত এলাকায় । যার ফলে ওই সমস্ত এলাকায় প্রবল তুষারপাত ঘটেছে । সেই তুষারপাতের পরিমাণ এতটাই বেশি ছিল যে, ভূপৃষ্ঠের উপর প্রায় ২ ফিট পুরু বরফ জমে যায় ওই সমস্ত শহরে । যা এক অভূতপূর্ব ঘটনা । ওই একই সময়ে অ্যামেরিকার আবহাওয়া অফিস দেশের পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় 25টি হারিকেন ঝড়ের পূর্বাভাস দেয় । এই সমস্ত ঘটনাই চরম জলবায়ু পরিবর্তনের লক্ষণ । সাম্প্রতিককালে জলবায়ু পরিবর্তনের এই অস্বাভাবিক হারটাই নব্য স্বাভাবিক জলবায়ুতে পরিণত হয়েছে । পরিস্থিতি এখন এতটাই গুরুতর যে, বিশ্বের ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে প্রায় 4 ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে । যদি এমনটাই ঘটতে থাকে তবে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র 10 শতাংশ সেই পরিবর্তিত জলবায়ুতে টিকে থাকতে পারবে । তাই আমাদের সবার চেষ্টা করা উচিত জলবায়ুর এই অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঠেকাতে কারণ তা যদি না করা যায় তবে আগামী দিনে পরিস্থিতি কোন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছবে তা কল্পনা করাও আমাদের পক্ষে কষ্টকর । আর তাই পরিস্থিতি যাতে সেই পর্যায়ে না পৌঁছয় তার জন্য আমাদের সবার যৌথ প্রচেষ্টা দরকার ।

প্রকৃতির সতর্কবাণীর প্রতি উদাসীনতা…

গত 12 হাজার বছর ধরে যে জলবায়ু মানব সভ্যতার সৃষ্টি ও বিবর্তনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে, তা বর্তমানে কেন মানুষের পক্ষে এতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে ? জলবায়ুর এই অস্বাভাবিক পরিবর্তনের কারণ কী, তা নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই । কারণ বৈজ্ঞানিকরা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন যে, জলবায়ুর এই অস্বাভাবিক পরিবর্তনের জন্য মানবজাতির অবিবেচক কাজকর্মই দায়ী । কয়েকশো বছর আগে আরহেনিয়াসের গবেষণা সতর্ক করে জানিয়ে দিয়েছিল যে, বায়ুমণ্ডলে কার্বনের নিঃসরণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে বিশ্ব উষ্ণায়ন বৃদ্ধি পাবে । কিন্তু তথাকথিত আর্থিক উন্নয়নের পেছনে ছুটতে গিয়ে বিশ্বের কোনও দেশের সরকারই সেই সতর্কবাণীতে কান দেয়নি । সেই 1988 সালে জেমস হানসেন বিষ্ণ উষ্ণায়ন নিয়ে বলেছিলেন । প্রথম IPCC হয় 1990 সালে । যদিও ঠিক হয়েছিল বিশ্ব উষ্ণায়নের বিপদের কথা মাথায় রেখে এবং তা ঠেকাতে রাষ্ট্র সংঘের নজরদারিতে আন্তর্জাতিক সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । কিন্তু তারপরেও গত 30 বছরে মানবজাতির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলে বায়ুমণ্ডলে যে পরিমাণ বিভিন্ন গ্যাসের নিঃসরণ ঘটেছে তার মধ্যে 62 শতাংশই হল কার্বন । তার মানে এটা স্পষ্ট যে, বিশ্ব উষ্ণায়নের পূর্বাভাস ও তার বিপদ সম্পর্কে আন্তর্জাতিকস্তরে আলোচনা শুরু হলেও তার পরবর্তী সময়ে বায়ুমণ্ডলে ওই পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ ঘটেছে । আমাদের কাজকর্মের দ্বারা বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ় গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি করে আমরা আদতে পৃথিবীর শক্তির ভারসাম্যের বিঘ্ন ঘটাচ্ছি । 2015 সালে প্যারিস চুক্তিতে ঠিক হয়েছিল ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃ্দ্ধির পরিমাণ 1.5 থেকে 2 ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে সব দেশ একযোগে প্রচেষ্টা চালাবে । কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত শুধুই কাগজে কলমে রয়ে গেছে, আজও কার্যকরী হয়নি । আর তাই বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণ যেমন বেড়েই চলেছে তেমনি তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিশ্ব উষ্ণায়ন ।

বিশ্ব বর্তমানে বিভিন্ন সমস্যায় ধুঁকছে । এই বিশ্বে বর্তমানে কোথাও না কোথাও, কিছু না কিছু দুর্যোগ ঘটেই চলেছে । তা সে দাবানল হোক বা হারিকেন, বন্যা, খরা বা অন্য কিছু, যা মানবজাতির পক্ষে ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে । তীব্র তাপপ্রবাহের জন্য অ্যামেরিকার পশ্চিম উপকূলে 12টি রাজ্য সম্প্রতি দাবানলে বিপর্যস্ত হয়েছে । সেই দাবানলের জেরে অ্যামেরিকার ১২টি রাজ্যের আকাশ এখনও লাল । সেই সমস্ত রাজ্যগুলির দাবানলের ধোঁয়া মাটি থেকে প্রায় 10 কিমি উচ্চতা পর্যন্ত পৌঁছেছে । শুধু তাই নয়, অ্যামেরিকার পশ্চিম উপকূল থেকে দাবানলের সেই ধোঁয়া সেই দেশের পূর্ব উপকলের রাজ্যগুলিতেও পৌঁছে গিয়েছে এবং এইভাবে দেশের একটা বড় অংশে বায়ু দূষণ ঘটিয়েছে সেই ধোঁয়া । এখনও পর্যন্ত অ্যামেরিকার যে পরিমাণ অংশ দাবানলে বিপর্যস্ত তার পরিমাণ হল প্রায় 69 মিলিয়ন একর । সেই সমস্ত বিপর্যস্ত এলাকার মধ্যে প্রায় 33 মিলিয়ন একর শুধু সেই দেশের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের অন্তর্গত । দাবানল এক বিশ্বব্যাপী সমস্যা । বিশ্বের কোনও এলাকাই দাবানলের সেই করাল গ্রাস থেকে মুক্ত নয় । তা সে উত্তর মেরুর আলাস্কা বা সাইবেরিয়া হোক কিংবা দক্ষিণ গোলার্ধের অস্ট্রেলিয়া, পূর্বে এশিয়া বা পশ্চিমে অ্যামেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল ।

সমস্ত দেশের জন্যই বিপদ

ভারতে দাবানলে যে পরিমাণ অরণ্য এলাকা বিপর্যস্ত হয়েছে তার পরিমাণ চিহ্নিত হয়েছে সরকারের তরফে । সেই পরিমাণ হল দেশের মোট অরণ্য এলাকার 21.4 শতাংশ । গত বছর আমাদের দেশে নথিভূক্ত দাবানলের ঘটনার সংখ্যা ছিল 29 হাজার 547 । চলতি বছরের মে মাসে দেশের উত্তরাখণ্ড রাজ্যে ভয়াবহ দাবানল শুরু হয় । অন্যদিকে, 1 সেপ্টেম্বর প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তানে ভয়াবহ বন্যায় 190 জনের মৃত্যু হয় । অন্যদিকে নেপাল, চাদ, সেনেগাল, সুদান, নাইজেরিয়া, কেনায়ি, বুরকিনা ফাসো, ঘানা, পাকিস্তান, ক্যামেরুন, আলজিরিয়া, তিউনিসিয়া, ভিয়েতনাম এবং উগান্ডার বাসিন্দারাও সেই সেপ্টেম্বর মাসেই ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । আমাদের দেশে অর্থাৎ ভারতে অগাস্ট মাসে প্রায় 11টি রাজ্যে ভয়াবহ বন্যায় প্রায় 868 জন লোকের মৃত্যু হয়েছে । এছাড়া দেশের প্রায় এক পঞ্চমাংশ এলাকা খরার কবলে পড়েছে । শুধু তাই নয়, অ্যামেরিকার একদিকে যখন দাবানল, তখন অন্যদিকে দেশের এক তৃতীয়াংশ এলাকা খরার কবলে পড়ে বিপর্যস্ত । সে দেশের প্রায় 5 কোটি 30 মিলিয়ন মানুষ খরার কবলে পড়েছে । এই সমস্থ ঘটনা এটাই ইঙ্গিত দেয় যে, বিশ্বের কোনও দেশই দুর্যোগ থেকে মুক্ত নয় ।

যদিও এই বছর কোভিডের জন্য জনজীবন কিছুটা থমকে গিয়েছে । আর তার জেরে পরিবেশে দূষণের পরিমাণ চলতি বছরের গত কয়েক মাসে কিছুটা কম । তাই আশা করা যাচ্ছে যে, বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ 4 থেকে 7 শতাংশ কমবে । যদিও বিশ্ব উষ্ণায়ন রিপোর্ট অনুসারে 2010 সালের তুলনায় 2030 সালে বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ প্রায় 45 শতাংশ কমবে । কিন্তু বিশ্বে কোথাও সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে তেমন কোনও উদ্যোগ এখনও পর্যন্ত লক্ষ্য করা যাচ্ছে না । সরকার, সাধারণ মানুষ এবং গণমাধ্যম এই গুরুতর সমস্যাটিকে সেভাবে এখনও গুরুত্বই দিচ্ছে না । 2019 সালে ভারতে নির্বাচনের সময় পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে রাখার এই বিষয়টিকে কোনও রাজনৈতিক দলই তাদের ইস্তাহারে কিন্তু উল্লেখ করেনি । বিশ্ব পরিবেশ সংস্থার তরফে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে । এই রিপোর্ট প্রকাশে বিশ্ব পরিবেশ সংস্থাকে সাহায্য করেছে বিজ্ঞান বিষয়ক চর্চার জন্য প্রসিদ্ধ বিশ্বের 6টি অগ্রগণ্য সংস্থা । সেই রিপোর্ট অনুসারে, 2024 সালের মধ্যে বিষ্ণ উষ্ণায়ন আপাতভাবে প্রায় 1.5 ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে । আর এই সম্ভাবনাও যথেষ্ট প্রবল যে, খুব শীঘ্রই উষ্ণায়নের হারের এই বৃদ্ধি স্থায়ী হবে । আর একটি রিপোর্ট সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে প্রকাশিত হয়েছে । সেই রিপোর্ট অনুসারে 2050 সালের মধ্যে পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য বিশ্বের প্রায় 120 মিলিয়ন মানুষ উদ্বাস্তু হবে, যা গোটা বিশ্বের জন্যই একটি বড় বিপদ । নিরক্ষ রেখা প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার যে অংশ দিয়ে গিয়েছে সেখানে ভূমিপৃষ্ঠের তাপমাত্রা যদি স্বাভাবিক তাপমাত্রার থেকে 0.5 ডিগ্রি সেলসিয়াস কম হয় তবে তাকে বলা হয় লা নিনা প্রভাব । আর এই প্রভাবের জেরে বর্তমানে অ্যামেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলবর্তী এলাকায় বায়ুমণ্ডলে তাপপ্রবাহ বেড়ে গিয়েছে এবং সেই দেশের অরণ্য এলাকা দাবানলে বিপর্যস্ত হয়েছে ।

চরম জলবায়ু অবস্থা

স্প্যানিশ ভাষায় ‘লা নিনা’ মানে ছোট বালিকা । আর যে পরিবেশের যে পরিস্থিতিতে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা স্বাভাবিক তাপমাত্রার তুলনায় যদি কমপক্ষে 0.5 ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পায়, তবে পরিবেশে সেই ঘটনার প্রভাবকে বলা হয় এল নিনো । স্প্যানিশ ভাষায় এই শব্দের অর্থ হল ছোট বালক । না নিনার জেরে অ্যামেরিকার দক্ষিণ ও পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে শুষ্ক তাপপ্রবাহ ঘটে এবং উত্তর ও পূর্ব উপকূলে শীতল ও আদ্র বাতাস প্রবাহিত হয় । শুধু তাই নয়, এর জেরে পূর্ব আটলান্টিক উপকূলীয় অঞ্চলে একাধিক শক্তিশালী ঝড়ও হয় । লা নিনা একটা প্রাকৃতিক ঘটনা । কিন্তু বিশিষ্ট আবহাওয়াবিদ মাইকেল ম্যান বলেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে প্যারিসে সাম্প্রতিক কালে তাপপ্রবাহ, দাবানল এবং বড়মাপের ঝড় হয়েছে । তা ছাড়া বিষ্ণ উষ্ণায়নের জেরে লা নিনার জন্য অ্যামেরিকায় সাম্প্রতিক কালে দাবানল এমনভাবে ছড়িয়েছে যে, যা নিয়ন্ত্রণ করা কার্যত দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছিল সেই দেশের সরকারের পক্ষে । 1970 সালের তুলনায় বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ার অরণ্য অঞ্চলে দাবানলের পরিমাণ প্রায় পাঁচগুণ বেড়ে গিয়েছে । শুধু তাই নয়, গ্রীষ্মে ক্যালিফোর্নিয়ায় এই দাবানলের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে আটগুণ । দাবানলের পরিমাণ এতটা বেড়ে যাওয়ার কারণ হল তীব্র তাপপ্রবাহের জেরে গ্রীষ্মে অরণ্যের গাছপালা ও ঘাস শুকিয়ে যাওয়ার জন্য । একদিকে অ্যামেরিকার পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে দাবানল যখন অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়েছে, তখন অন্যদিকে ওই এলাকার কয়েকশো মাইল পূর্বে কলোরেডো, ওয়োমিং সহ বিভিন্ন শহরে তখন উলটো চিত্র । সেখানে তাপমাত্রার পারদ অস্বাভাবিক হারে নেমে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে সাম্প্রতিক কালে । ওই সমস্ত এলাকায় তাপমাত্রা কমার হার স্বাভাবিকের থেকে প্রায় 33 ডিগ্রি সেলসিয়াস । 7 তারিখ সন্ধ্যা থেকে পরের দিন সকাল পর্যন্ত প্রায় 18 ঘণ্টা ধরে তাপমাত্রা কমার এই অস্বাভাবিক হার লক্ষ্য করা গেছে ওই সমস্ত এলাকায় । যার ফলে ওই সমস্ত এলাকায় প্রবল তুষারপাত ঘটেছে । সেই তুষারপাতের পরিমাণ এতটাই বেশি ছিল যে, ভূপৃষ্ঠের উপর প্রায় ২ ফিট পুরু বরফ জমে যায় ওই সমস্ত শহরে । যা এক অভূতপূর্ব ঘটনা । ওই একই সময়ে অ্যামেরিকার আবহাওয়া অফিস দেশের পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় 25টি হারিকেন ঝড়ের পূর্বাভাস দেয় । এই সমস্ত ঘটনাই চরম জলবায়ু পরিবর্তনের লক্ষণ । সাম্প্রতিককালে জলবায়ু পরিবর্তনের এই অস্বাভাবিক হারটাই নব্য স্বাভাবিক জলবায়ুতে পরিণত হয়েছে । পরিস্থিতি এখন এতটাই গুরুতর যে, বিশ্বের ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে প্রায় 4 ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে । যদি এমনটাই ঘটতে থাকে তবে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র 10 শতাংশ সেই পরিবর্তিত জলবায়ুতে টিকে থাকতে পারবে । তাই আমাদের সবার চেষ্টা করা উচিত জলবায়ুর এই অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঠেকাতে কারণ তা যদি না করা যায় তবে আগামী দিনে পরিস্থিতি কোন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছবে তা কল্পনা করাও আমাদের পক্ষে কষ্টকর । আর তাই পরিস্থিতি যাতে সেই পর্যায়ে না পৌঁছয় তার জন্য আমাদের সবার যৌথ প্রচেষ্টা দরকার ।

প্রকৃতির সতর্কবাণীর প্রতি উদাসীনতা…

গত 12 হাজার বছর ধরে যে জলবায়ু মানব সভ্যতার সৃষ্টি ও বিবর্তনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে, তা বর্তমানে কেন মানুষের পক্ষে এতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে ? জলবায়ুর এই অস্বাভাবিক পরিবর্তনের কারণ কী, তা নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই । কারণ বৈজ্ঞানিকরা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন যে, জলবায়ুর এই অস্বাভাবিক পরিবর্তনের জন্য মানবজাতির অবিবেচক কাজকর্মই দায়ী । কয়েকশো বছর আগে আরহেনিয়াসের গবেষণা সতর্ক করে জানিয়ে দিয়েছিল যে, বায়ুমণ্ডলে কার্বনের নিঃসরণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে বিশ্ব উষ্ণায়ন বৃদ্ধি পাবে । কিন্তু তথাকথিত আর্থিক উন্নয়নের পেছনে ছুটতে গিয়ে বিশ্বের কোনও দেশের সরকারই সেই সতর্কবাণীতে কান দেয়নি । সেই 1988 সালে জেমস হানসেন বিষ্ণ উষ্ণায়ন নিয়ে বলেছিলেন । প্রথম IPCC হয় 1990 সালে । যদিও ঠিক হয়েছিল বিশ্ব উষ্ণায়নের বিপদের কথা মাথায় রেখে এবং তা ঠেকাতে রাষ্ট্র সংঘের নজরদারিতে আন্তর্জাতিক সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । কিন্তু তারপরেও গত 30 বছরে মানবজাতির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলে বায়ুমণ্ডলে যে পরিমাণ বিভিন্ন গ্যাসের নিঃসরণ ঘটেছে তার মধ্যে 62 শতাংশই হল কার্বন । তার মানে এটা স্পষ্ট যে, বিশ্ব উষ্ণায়নের পূর্বাভাস ও তার বিপদ সম্পর্কে আন্তর্জাতিকস্তরে আলোচনা শুরু হলেও তার পরবর্তী সময়ে বায়ুমণ্ডলে ওই পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ ঘটেছে । আমাদের কাজকর্মের দ্বারা বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ় গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি করে আমরা আদতে পৃথিবীর শক্তির ভারসাম্যের বিঘ্ন ঘটাচ্ছি । 2015 সালে প্যারিস চুক্তিতে ঠিক হয়েছিল ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃ্দ্ধির পরিমাণ 1.5 থেকে 2 ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে সব দেশ একযোগে প্রচেষ্টা চালাবে । কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত শুধুই কাগজে কলমে রয়ে গেছে, আজও কার্যকরী হয়নি । আর তাই বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণ যেমন বেড়েই চলেছে তেমনি তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিশ্ব উষ্ণায়ন ।

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.