আমরা কথায় কথায় বলি, এ তো জলের মতো সহজ । যেন খুবই হেলায় উড়িয়ে দেওয়ার মতো একটা ব্যাপার । কিন্তু জল কি আদৌ এতটা সহজ ? যদি বলা হয়, জলের মধ্যেও লুকিয়ে আছে অদ্ভুত এক রহস্য, যাঁর কোনও ঠিকঠাক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আজও পাওয়া যায়নি... ভাবছেন কী এমন রহস্য ? প্রকৃতি কিন্তু সবসময়ই রহস্য পছন্দ করে । বিজ্ঞান হয়ত অনেক দূর এগিয়ে গেছে, কিন্তু আজও এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যা রহস্যই থেকে গেছে ।
ধরুন দু'টি গ্লাস রয়েছে । একটি গ্লাসে ঘরের সাধারণ উষ্ণতায় ঠান্ডা জল রয়েছে । অন্যটিতে রয়েছে ফুটন্ত জল । এবার দু'টি গ্লাসকেই আপনি ফ্রিজ়ে ঢুকিয়ে দিলেন । বলুন তো.., কোন গ্লাসের জল আগে বরফ হবে ? ভাবছেন এ আর এমন কী । সাধারণভাবে ঠান্ডা জলটাই আগে বরফ হওয়ার কথা । এ তো জলের মতো সহজ ব্যাপার । কিন্তু না । সবক্ষেত্রে নয় । গরম জলটিও আগে বরফ হতে পারে । নির্দিষ্ট পরিবেশে, গরম জল তুলনামূলকভাবে আগে গরম হয় । সুতরাং, ব্যাপারটা জলের হলেও সহজ নয় । আর জলের এই অদ্ভুত আচরণের কোনও পরিপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আজও মেলেনি ।
জলের এই অদ্ভুত আচরণের নাম এমপেম্বা এফেক্ট । তানজানিয়ার বছর তেরোর এক স্কুল পড়ুয়া এরাস্তো এমপেম্বা । তার নাম থেকেই এই নামকরণ । এমপেম্বা আইসক্রিম তৈরি করার সময় প্রথম জলের এই অদ্ভুত বিষয়টি খেয়াল করেছিলেন । সঙ্গে সঙ্গে স্কুলে গিয়ে বলেছিলেন ব্যাপারটা । কিন্তু তখন কেউ এই ছোট্ট ছেলেটির কথা বিশ্বাস করেননি । এরপর কেটে যায় বেশ কয়েকবছর । এমপেম্বা বিষয়টি নিয়ে কাউকে আর কিছু বলে না । কিন্তু মনে মনে সর্বক্ষণ ঘুরতে থাকে বিষয়টি । পরে যখন তিনি হাইস্কুলে যান, তখন পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক ডেনিস অসবর্নের সান্নিধ্যে আসেন । তাঁকেও এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেসা করেন এমপেম্বা । অসবর্ন কিন্তু বাকিদের মতো বিষয়টি হেলায় উড়িয়ে দেন না । বরং, নিজের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করেন । দেখেন সত্যি, গরম জলটি আগে বরফ হচ্ছে । এরপর 1969 সালে এমপেম্বাকে সঙ্গে নিয়ে অসবর্ন একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন । তারপর থেকেই বিষয়টি নিয়ে বৈজ্ঞানিকমহলে বেশ সাড়া পড়ে যায় ।
1969 থেকে 2020 । পঞ্চাশ বছর পরেও জলের এই অদ্ভুত আচরণ নিয়ে কোনও পরিপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ধারণা আমাদের সামনে আসেনি । জল বরফে পরিণত হতে গেলে দু'টি ধাপ পার করতে হয় । প্রথমে যে তাপমাত্রায় আছে, সেখান থেকে হিমাঙ্কে নেমে আসা । তারপর অবস্থার পরিবর্তন । অর্থাৎ, জল শূন্য ডিগ্রিতে পৌঁছালেই অবস্থার পরিবর্তন হবে , এমনটা নয় । প্রথমে বরফের ছোটো ছোটো ক্রিস্টাল তৈরি হবে, তারপর সেটিকে কেন্দ্র করে জল জমাট বাঁধবে । কিন্তু এমপেম্বা এফেক্টে বরফ হওয়া বলতে প্রথম ক্রিস্টাল গঠন হওয়া নাকি পুরো জলটাই বরফে পরিণত হওয়া বোঝাচ্ছে, তার কোনও সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি ।
তবে সবথেকে বেশি প্রচলিত যে ধারণাটি রয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, যেহেতু জলটিকে প্রথমে ফোটানো হচ্ছে, তাই তার কিছু পরিমাণ বাষ্পীভূত হয়ে যাচ্ছে । ফলে গরম জলের ভর ঠান্ডা জলের তুলনায় অনেকটাই কমে যাচ্ছে । আর এই কারণেই ওই গরম জলটি ঠান্ডা জলের তুলনায় তাড়াতাড়ি বরফে পরিণত হচ্ছে । এই ধারণার উপর ভিত্তি করে বেশ কিছু পরীক্ষা সফলও হয়েছে । তবে তাত্ত্বিকভাবে এই হিসেব মেলানো সম্ভব নয় । তাই শুধুমাত্র ভর কমে যাওয়াই যে জলের এই অদ্ভুত আচরণের একমাত্র কারণ, না নিশ্চিত করে বলা যায় না ।
অনেকে আবার অন্য একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছেন । তাঁদের কথায়, জল ফোটানোর কারণে, জলের মধ্যে যে গ্যাসীয় পদার্থ থাকে তা ধীরে ধীরে বেরিয়ে যায় । ফলে হিমাঙ্ক বেড়ে যেতে পারে । যেমন ধরা যাক, সাধারণভাবে জলের হিমাঙ্ক শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস । কিন্তু, জলের মধ্যে কার্বন ডাই অক্সাইড দ্রবীভূত থাকলে, তার হিমাঙ্ক -8 ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যায় । ঠিক এইভাবে হিমাঙ্ক পরিবর্তনের কারণে গরম জল তাড়াতাড়ি বরফ হতে পারে বলেও মনে করেন অনেকে ।
2012 সালে রয়াল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রি একটি প্রতিযোগিতা আয়োজন করেছিল । লক্ষ্য এমপেম্বা এফেক্টের ব্যাখা খুঁজে বের করা । প্রায় 22 হাজার প্রতিযোগী সেখানে অংশগ্রহণ করেছিলেন । সেই প্রতিযোগিতায় যে বিষয়টি উঠে এসেছিল, তা হল, গরম জলকে ঠান্ডা পরিবেশে রাখলে পাত্রের কিনারা দ্রুত ঠান্ডা হয়, কিন্তু মাঝের জলের তাপমাত্রা তখনও বেশি থাকে। এর ফলে ভিন্ন তাপমাত্রার জলের একটি স্রোত তৈরি হয় পাত্রে । আর এই ঘটনাই এমপেম্বা ইফেক্টে প্রভাব ফেলে। কিন্তু এই ব্যাখ্যাও সম্পূর্ণ নয় । ফলে জলের এই অদ্ভুত রহস্যের কারণ আজও অজানা ।