29 অক্টোবর কুদানকুলাম পরমাণু কেন্দ্রে (KNPP)-র তরফে জারি করা এক প্রেস বিবৃতিতে বলা হয়, সাইবার হানা প্রসঙ্গে কিছু বিভ্রান্তিকর-ভুল খবর ছড়িয়ে পড়েছিল । কেন্দ্রের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিস্টেমে সাইবার হানা হয়েছে বলে সোশাল মিডিয়াতে যে খবর রটেছিল, তার প্রেক্ষিতেই এই রিপোর্ট ।
কিন্তু, ঠিক তার পর দিনই কার্যত সাইবার হামলার কথা স্বীকার করে নেওয়া হয় । নিউক্লিয়ার পাওয়ার কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (NPCIL) একটি বিবৃতিতে জানায়, ভাইরাস হানার খবরটা সঠিক । কম্পিউটার ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম (সিইআরটি) 4 সেপ্টেম্বর ভাইরাসটিকে চিহ্নিত করে । যদিও, এই সাইবার হামলায় পরমাণু শক্তি কেন্দ্রের মূল সিস্টেম প্রভাবিত হয়নি বলেই জানায় NPCIL । ভাইরাসটিকে চিহ্নিত করার সঙ্গে সঙ্গেই আণবিক শক্তি বিভাগের আধিকারিকরা তদন্তে নেমে পড়েন । তাতে দেখা যায়, যে কম্পিউটার থেকে ভাইরাসটি ছড়িয়েছে তাতে যে ইন্টারনেটের সংযোগ দেওয়া ছিল, তা মূলত প্রশাসনিক কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে । বিবৃতিতে বলা হয়, ‘তড়িঘড়ি ওই কম্পিউটারকে পরমাণু কেন্দ্রের মূল নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় । বর্তমানে পরমাণু কেন্দ্রের সমস্ত নেটওয়ার্কে কড়া নজরদারি চালানো হচ্ছে ।’
যদি এটা মেনেও নেওয়া যায় যে, কুদানকুলানে সাইবার হানা সফল হয়নি, তাও একটা বড় আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে । এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলা যায় । তখন সবে মাত্র বারাক ওবামা অ্যামেরিকার দায়িত্ব গ্রহন করেছেন । 2009 সাল । স্টাক্সনেট নামক কম্পিউটার ভাইরাস ঢুকিয়ে দেওয়া হয় ইরানের পরমাণু প্রোগ্রামের মধ্যে । ক্ষতিগ্রস্ত হয় সমস্ত প্রোগ্রাম । সন্দেহের তির উঠেছিল অ্যামেরিকা, ইজরায়েল ও ব্রিটেনের সাইবার-বিশেষজ্ঞ মহলের দিকে ।
অভিযোগ, ভাইরাসটি তৈরি করেছিলেন মার্কিন বিজ্ঞানীরা । নাতাজ় কন্ট্রোল সিস্টেম একটি অতি আধুনিকমানের-উন্নত এবং কম্পিউটার সিস্টেমকে বিভিন্ন ভাবে ওই ভাইরাস নানা ভাবে আঘাত করতে সক্ষম ।
এই সাইবার হানায় যে বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বপর্ণ তা হল, প্রাথমিক চেষ্টায় অনেকটাই সফল হয়েছিল । খুব সম্ভবত এর প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল 2006 সালে । জাতীয় নিরাপত্তা এজেন্সির কম্পিউটারগুলিতে হামলার বিষয়টিও সামনে এসেছিল । সন্দেহ নেই এভাবে সাইবার হামলার বিষয়টি অত্যন্ত আশঙ্কাজনক, উদ্বেগের । অতি দ্রুত এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা উচিত । আমরা এখনও জানি না, যদি কোনও তথ্য সংক্রমিত কম্পিউটার থেকে চুরি যায়, সেখানে ফের হামলা হতে পারে কি না ।
একটা বাস্তব সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে গোটা বিশ্ব । যেখানে যে কোনও মুহূর্তে যে কোনও দেশের কম্পিউটারে সাইবার হানা হতে পারে । 2018 সালে মার্চে মার্কিন হোমল্যান্ড নিরাপত্তা দপ্তর রাশিয়া সরকারের সাইবার হানার বিষয়ে সতর্ক করেছিল । অ্যামেরিকার জল, পরমাণু সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সাইবার হানার বিষয়ে সতর্কতা করা হয়েছিল । আবার 2019 সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়েছিল, কীভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ভ্লাদিমির পুতিনের প্রশাসন সাইবার হানার বিষয়ে নিজেদেরকে শক্তিশালী করে তুলছে ।
সাইবার হানার অন্যতম বড় এবং মারাত্মক উদাহরণ দেওয়া যায় 2007 সালে এস্তোনিয়ায়, হামলার পিছনে ছিল উত্তর কোরিয়া । আবার সৌদি আরবে মার্কিন ব্যাঙ্কের উপর হামলা চালিয়েছিল ইরান । মার্কিন সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার জন্য চিনা হামলার চেষ্টার কথাও এপ্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় ।
ভয়ঙ্কর সাইবার হামলা রুখতে ভারতকে এখনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ করতে হবে, যা শুরু করতে হবে অতি দ্রুত । তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রের গুরুত্ব বোঝেন প্রতিটি ভারতবাসী । Glenn Greenwald-এর No Place to Hide শীর্ষক বইতে উল্লেখ আছে, সিসকো গ্রুপ NSA কর্মীদের কম্পিউটারে ভাইরাস ঢুকিয়ে তথ্য ফাঁসের চেষ্টা করেছিল ।
এর ফলে অনেক দেশই তাদের গুরুত্বপূর্ণ নেটওয়ার্কে বিদেশি যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা বন্ধ করে দিয়েছে । বেজিং মাইক্রোসফট, অ্যাপেল-র মতো সংস্থার জিনিস ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে বা ব্যবহার করলেও প্রথমে ল্যাবরেটরিতে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে । আবার মার্কিন প্রশাসন চিনে তৈরি বিভিন্ন সফটওয়ারের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দিয়েছে ।
ভারতে আমরা দেশিয় প্রযুক্তিতে তৈরি জিনিসের উপর খুব একটা গুরুত্ব দিই না বা ভরসা করি না বা উৎসাহ দিই না । BSNL-র ব্যবহৃত 60 শতাংশের বেশি সফটওয়ার বা হার্ডওয়ার , যা Huawei বা ZTE-এর । তা সত্ত্বেও BSNL-র নেটওয়ার্ক হ্যাক করার অভিযোগে 2014 সালে Huawei বিরুদ্ধে তদন্ত হয় । 2016 সালে, দা কুইন্টের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সেনাবাহিনীর যোগাযোগের ক্ষেত্রে, ভারতের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সাইবার হামলা কতটা ভয়ংকর, সেই বিষয়টা আমাদের সবার আগে খতিয়ে দেখতে হবে । ভারতীয় সেনাবাহিনী সব সময় আমাদের দেশের নিরাপত্তার বিষয়টি সব সময় নজরদারি চালাচ্ছে । সাইবার হামলার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তারা পর্যবেক্ষণ চালাচ্ছে । বিষয়টির দিকে গুরুত্ব দিয়ে আমরা ইতিমধ্যেই একটি সাইবার প্রতিরক্ষা দপ্তর খুলেছি । তবে এক্ষেত্রে মার্কিন সাইবার দপ্তরের সহযোগিতায় নানা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ করা হচ্ছে ।
সাইবার নিরাপত্তা সংগঠনের রিপোর্ট অনুসারে 2016 থেকে 2018 সালের মধ্যে বিশ্বের মধ্যে ভারত দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে, যারা সাইবার হানার শিকার হয়েছে । হুমকি বাড়ছে । বাড়ছে আশঙ্কাও । পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে আমাদের দ্রুত পদক্ষেপ করতে হবে, যাতে আরও কঠিন কোনও পরস্থিতি এড়ানো সম্ভব হয় ।
Lt Gen (Retd) D S Hooda