ভারতে কোভিড-19 এর আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে চার হাজারের গণ্ডি ছাড়িয়েছে । ভাইরাস যে গতিতে ছড়াচ্ছে, তাতে বোঝাই যাচ্ছে খুব শীঘ্রই এই সংখ্যাটা পাঁচ হাজারের গণ্ডি পেরিয়ে যাবে ।
যেটা সবচেয়ে বেশি চিন্তার তা হল, মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত তবলিঘি জামাত (TJ)-এর ধর্মীয় সভা থেকেই এর প্রায় 30 শতাংশ সংক্রমণ ছড়িয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে । রাজধানীর নিজ়ামউদ্দিনে হওয়া এই বার্ষিক সভায় যোগ দেওয়া সদস্যরা সভা শেষে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিজেদের বাড়ি ফিরে যান । এর পর থেকেই দেশের সেই সব প্রান্ত থেকে কোভিড-19-এ আক্রান্ত মানুষদের খোঁজ মিলতে শুরু করে যাঁদের সঙ্গে সে দিনের TJ-এর সভায় উপস্থিত সদস্যরা সংস্পর্শে এসেছিলেন ।
এর ফলে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে সংক্রমণের ঘটনা যে সব রাজ্যে ঘটেছে সেগুলি হল, তামিলনাডু, দিল্লি, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলাঙ্গানা, উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান, জম্মু-কাশ্মীর, অসম, কর্নাটক, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, উত্তরাখণ্ড, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, হিমাচল প্রদেশ, কেরালা, অরুণাচল প্রদেশ এবং ঝাড়খণ্ড । স্বাস্থ্য মন্ত্রকের আধিকারিকরা মনে করছেন, সংক্রামিতের এই সংখ্যা দ্রুত হারে বাড়বে । এর কারণ হল, সে দিনের সভায় উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে যাদের ক্ষেত্রে রোগের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা গিয়েছে, তাঁদের তা না জানানো, তাঁদের ভ্রমণ সূচি না জানানো এবং তাঁরা কাদের সংস্পর্শে এসেছেন, সে সম্পর্কে সবিস্তার জানানোর অনীহা ।
এই ঘটনার পর থেকে দেশ জুড়ে চলছে ক্ষোভ এবং বিরক্তি । আর এই পরিস্থিতিতেও কিছু একপেশে টিভি চ্যানেল এবং সোশ্যাল মিডিয়ার একাংশ তবলিঘি বিরোধী অবস্থান নিয়ে নাগাড়ে প্রচার করে চলেছে । এই প্রচার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরিণত হচ্ছে মুসলিম বিরোধী প্রচারে । সামাজিক এবং রাজনৈতিক মেরুকরণ এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে যে, মনে হচ্ছে ভারতে কোভিড-19 এর একটা ধর্মীয় DNA রয়েছে । সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত এবং অবধারিত ভাবে নামের মিলের সূত্র ধরে চলে আসছে কোরোনা এবং কোরানকে টেনে আনা । সোশ্যাল মিডিয়ায় অনুমানভিত্তিক প্রচার (যা কিনা ভ্রান্ত খবর এবং ঘৃণা সৃষ্টির আঁতুড়ঘর) এবং রাজনৈতিক বিভেদ দেশ জুড়ে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে জরুরি অবস্থার সময়ে জাত নিয়ে রাজনীতির অভিযোগের আঙুল তুলছে BJP এবং RSS-এর দিকে ।
এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেপি নাড্ডার বক্তব্য অত্যন্ত সদর্থক ও তাৎপর্যপূর্ণ । তিনি তাঁর দলের নেতা কর্মীদের উদ্দেশে অনুরোধ করেন এই কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবে কোনও ভাবেই ধর্মীয় রং না লাগাতে বা কোনও বিভেদ না করতে । 4 এপ্রিল দিল্লিতে BJP-এর প্রবীণ ও প্রথম সারির নেতাদের এক বৈঠকে মিডিয়ার উদ্দেশে বলা হয়েছে, “দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার মহান দায়িত্ব রয়েছে আমাদের কাঁধে । এই ভাইরাস এবং তার থেকে হওয়া রোগ জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে । এই অবস্থায় কারও উচিত নয় কোনও রকম উত্তেজক মন্তব্য করা ।”
নির্দিষ্ট ভাবে TJ-এর নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ওঠা একাধিক অভিযোগ নিয়ে যেন কোনও রকম অতিরঞ্জিত মন্তব্য না করা হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক করে BJP-এর এক নেতা বলেন, “তবলিঘির ঘটনার পর পুরনো একটি কথা ফের মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের একটি নির্দেশিকা রয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে যে, কেউ কোনও ধর্মীয় বিষয়ে মন্তব্য করতে পারবেন না । যদি প্রয়োজন পড়ে বা যদি তাঁরা মনে করেন তবে, এই বিষয়ে মন্তব্য করতে পারবেন শুধুমাত্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ । ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমাদের এক হয়ে লড়তেই হবে ।”
মার্চের মাঝামাঝি সময় জারি হওয়া কোভিড সংক্রান্ত নির্দেশিকা যে TJ নেতৃত্ব মেনে চলেননি, তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে । এটা কী স্রেফ অযোগ্যতা, না কি ধর্মীয় বিশ্বাসকে ইচ্ছাকৃত ভাবে ভুল পথে পরিচালিত করা, তা তথ্য নির্ভর তদন্ত ছাড়া বলা প্রায় অসম্ভব । বিশ্ব জুড়ে ইসলাম, জিহাদ এবং সন্ত্রাস নিয়ে তৈরি হওয়া মনোভাব এবং TJ সংক্রান্ত বিভিন্ন ধারণার আবহে এই তদন্ত যেন কোনও ভাবেই দেরি বা প্রলম্বিত না হয়, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
দুর্ভাগ্যজনক ভাবে যে দিন থেকে নিজ়ামউদ্দিনের ঘটনা সামনে এসেছে, সে দিন থেকে অডিয়ো-ভিসুয়াল মিডিয়ার একাংশ তাদের উগ্র রিপোর্টিং নিয়ে যুদ্ধং দেহী মনোভাবে হাজির হয়েছে। বিনা বাধায় ভ্রান্ত খবর ছড়িয়ে পড়তে থাকে । দিল্লির বিপরীত প্রান্তে হওয়া CAA বিরোধী শাহিনবাগের আন্দোলনের সঙ্গে অযৌক্তিক ভাবে মিলিয়ে দেওয়া হয় নিজামউদ্দিনের সে দিনের ঘটনাকে ।
এই ধারা অতি দ্রুত অঙ্কুরেই বিনাশ হওয়া উচিত ছিল । বিদ্বেষমূলক ভাষণ সংক্রান্ত সরকারের যে নির্দেশিকা রয়েছে তার কঠোর প্রয়োগের প্রয়োজন ছিল । কিন্তু অতীতে এই নির্দেশিকার প্রয়োগ হলেও এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি । আর এই প্রেক্ষিতেই নাড্ডার বক্তব্য আশার আলো দেখাচ্ছে। আশা করা যায় যে এর পর BJP-এর নেতা ও কর্মীরা এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সোশ্যাল মিডিয়ার একাংশ এই নির্দেশিকা মেনে চলবে এবং কোরোনা ভাইরাস ও ধর্ম মিশিয়ে কোনও রকম উত্তেজক মন্তব্য করবে না ।
এই পরিস্থিতিতে বেশ কিছু রাজ্যের জারি করা নির্দেশিকা প্রশংসনীয়, যেখানে বলা হয়েছে যে, দেশের একশো কোটিরও বেশি মানুষ যখন কোভিড চ্যালেঞ্জের জন্য তৈরি হচ্ছেন, তখন কোনও মিডিয়া বা সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভেদ তৈরির চেষ্টা করা মন্তব্য বা আচরণের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে ।
এই প্রেক্ষিতে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরের মন্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ । তিনি যে কোনও রকম ভ্রান্ত ভিডিয়োর ক্ষেত্রে কঠোর ভাবে সতর্কবার্তা দিয়েছেন । 4এপ্রিল ফেসবুকে একটি পোস্টের মাধ্যমে তিনি জানিয়েছেন, এই ধরনের কাজ করলে তা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ ।
মহারাষ্ট্র থেকে তবলিঘির জমায়েতে যাওয়া সদস্যদের প্রত্যেককে চিহ্নিত করে আলাদা রাখা হয়েছে এ কথা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কোরোনা ভাইরাসের মতোই আরও একটি ভাইরাস আমাদের সামাজিক ঐক্য নষ্ট করতে চাইছে । সেটি হল ভ্রান্ত খবর ও ধর্মীয় বিদ্বেষের ভাইরাস । আমরা মহারাষ্ট্রকে এই ভয়ঙ্কর অবস্থা থেকে রক্ষা করবই। কিন্তু কেউ যদি ভ্রান্ত খবর বা ভিডিয়ো ছড়িয়ে দেয়, বা কোনও অতিরঞ্জিত মন্তব্য করে, তা হলে আইন তাকে ঠিক খুঁজে বার করবে । তাদের কোনও অবস্থাতেই ছেড়ে দেওয়া হবে না । তাই মজা করেও এই ধরনের কাজ কেউ যেন না করে ।”
মহারাষ্ট্রের পথে অন্য রাজ্যগুলিও হাঁটবে, এইটুকু আশা আমরা করতেই পারি। ২১ দিনের লকডাউনের শেষে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় পরিস্থিতির বিশ্লেষণ হবে । যে সিদ্ধান্তই তার পর নেওয়া হোক না কেন, ভারতকে ধীরে ধীরে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতেই হবে। আর যে কোনও কার্যকলাপ, যা কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দেশকে ভাগ করার চেষ্টা করবে, তা প্রত্যখ্যান করতে হবে।
প্রতিবেদনটি লিখেছেন সি উদয় ভাস্কর ৷