সুশান্ত সিং রাজপুতের জীবনের দিকে তাকালেই একটা আভাস খুব স্পষ্টভাবে মেলে । তা হল এই অভিনেতা জীবদ্দশাতেই একের পর এক মৃত্যুর পূর্বাভাস দিয়েছিলেন । উদাহরণ হিসেবে টুইটারে ওঁর ডিসপ্লে পিকচারটাই একবার দেখুন । দা স্টারি নাইট । 1889 সালে শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের আঁকা সেই ছবি । ঠিক তার আগের বছরই শিল্পী নিজেই নিজের কান কেটে ফেলেছিলেন । কিংবা একবার ইনস্টাগ্রামে সুশান্তর শেষ পোস্টটার দিকে চোখ রাখুন । 3 জুনের পোস্ট ৷ যেখানে প্রয়াত মা’য়ের ছবি দিয়ে তাঁকে স্মরণ করেছেন সুশান্ত । সঙ্গে লিখেছেন, "চোখের জলে বাষ্প হয়ে যাচ্ছে ধূসর অতীত ৷ না শেষ হওয়া স্বপ্নগুলো হাসির রেখা এঁকে যাচ্ছে ৷ হাত থেকে একটু একটু করে সরতে থাকা জীবন ৷ এই দুইয়ের মধ্যে যোগসূত্র রেখে চলছি ।"
34 বছর বয়সি সব মানুষের বাকেট লিস্ট তৈরি থাকে না । কিন্তু সপ্তাহের গোড়াতেই আত্মঘাতী হওয়া সুশান্তের তালিকা ছিল প্রস্তুত । আর শুধু তাই নয়, 2013 সালে ‘কাই পো চে’র মতো অসাধারণ একটি ছবি দিয়ে যাঁর বড় পর্দায় আত্মপ্রকাশ সেই সুশান্ত যে 11টি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তার মধ্যে 5টিতেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে । মনে করুন, ছবির সেই সহজাত প্রতিভাধর ইশানের কথা । ছবির সেই দৃশ্য যেখানে সূর্যাস্তের দিকে মুখ করে ইশানরূপী সুশান্ত এগিয়ে যাচ্ছেন আর তাঁর পিঠে এসে লাগছে অস্তগামী সূর্যের আলো । সেই সুশান্ত খুশি কারণ তাঁর ছাত্র আলি হাশমি অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ভারতীয় ক্রিকেট দলের হয়ে অভিষেকেই দারুণ খেলেছে । ছবিতে ইশানের চরিত্রকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত পরিচালক অভিষেক কাপুর ভেবেচিন্তেই নিয়েছিলেন ৷ কারণ চেতন ভগতের গল্প, "দা থ্রি মিসটেকস অফ মাই লাইফ" যাকে অবলম্বন করে তাঁর ছবি তৈরি হয়েছিল সেখানে ইশানের মৃত্যু হয়নি । গোধরা ট্রেন বিপর্যয়ের দুঃখ এবং বিভীষিকাকে নিজের ভাবনার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার জন্য পরিকল্পিতভাবে ছবির সবচেয়ে প্রিয় চরিত্রের মৃত্যু দেখিয়েছিলেন কাপুর ।
"রাবতা" (2017) ছবিতে পুনর্জীবনের আখ্যান তুলে ধরেছিলেন পরিচালক দীনেশ ভিজন । এই ছবিতেও সুশান্ত অভিনীত একটি চরিত্রের মৃত্যু হয় ৷ আর অন্যটি (শিব কক্কর) বেঁচে যায় ছবির নায়িকার হাত ধরে । কেদারনাথ (2018), যা 2013 সালের উত্তরাখণ্ডে ভয়াবহ বন্যার প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছিল ৷ সুশান্ত ছিলেন একজন মুসলিম গাইডের ভূমিকায় ৷ যে মন্দিরের এক পূজারীর মেয়ের প্রেমে পড়ে যায় । ছবির শেষ দৃশ্যে সেই মেয়েটিকে বাঁচাতে গিয়েই সে হেলিকপ্টারে নিজের আসন তাঁকে দিয়ে দেয় । ছবির সেই অন্তিম দৃশ্যে অনেকটা তাঁর প্রিয় অভিনেতা শাহরুখ খানের মতো দু’হাত প্রসারিত করে পিছনে ঘোরার পরই ভূগর্ভে তলিয়ে যান সুশান্ত । তাঁর মৃত্যুর পর সেই দৃশ্য দেখা এখন অনেকের পক্ষেই দুরূহ বিষয় ।
অভিষেক চৌবে পরিচালিত ডাকাতির ছবি "সোনচিড়িয়া"-য় (2019) সুশান্তের চরিত্র লাখনার মৃত্যুও কম নায়কোচিত নয় । ছবিতে লাখনার মৃত্যু হয় তাঁর চিরশত্রুর হাতে ৷ যে ভূমিকায় ছিলেন আশুতোষ রানা । গাছের পিছনে যে ডেরায় লাখনা লুকিয়েছিলSV সেখান থেকে বেপরোয়াভাবে বেরোনোর পরই তাঁর মৃত্যু ঘটে ৷ সুশান্তের মৃত্যুর পর দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে চৌবে বলেছিলেন, "ছবির সেই দৃশ্যে যেখানে লাখনা মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে দেখতে পাচ্ছে তা আমার মাথায় সম্পূর্ণ আলাদা ছবি করে নিয়েছে । নিজের মতো করেই নিজের জীবনের অর্থ খুঁজে নিয়েছে ।" মুক্তি পাওয়া শেষ ছবি "ছিঁছোরে"তে পর্দায় সুশান্তের ছেলে একটুর জন্য মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল । সেই ছবির দৃশ্য যেখানে বাবারূপী সুশান্ত নিজের ছেলেকে বলছে, "হামারা রেজ়াল্ট নেহি ডিসাইড করতা কি তুম লুজ়ার হো কি নহি, তুমহারি কোশিস ডিসাইড করতা হ্যায় ।" (তোমার ফলাফল নির্ধারণ করে না তুমি হেরে গেছ কি না, কিন্তু তোমার চেষ্টা তা নির্ধারণ করে ) ৷ বর্তমানে সেই ডায়লগ সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল ।
যারা ছবিতে ‘হ্যাপি এন্ডিং’ দেখতে ভালবাসেন সুশান্ত অভিনীত শেষ ছবি দেখলে তাঁরা ফের হতাশ হবেন । "দা ফল্ট ইন আওয়ার স্টারস"-এর অফিসিয়াল রিমেক "দিল বেচারা"য় অভিনয় করেছিলেন সুশান্ত ৷ যা অনলাইনে স্ট্রিমিংয়ে মুক্তি পাবে ৷ ছবিতেও একই পরিণতি দেখা যাবে । যদিও ছবির নায়ক-নায়িকা দু’জনেই ক্যানসার আক্রান্ত ৷ কিন্তু গোটা ছবিজুড়ে নায়িকা গুরুতর অসুস্থ থাকলেও খানিকটা অভাবনীয়ভাবেই মৃত্যু হবে নায়কের ।
পর্দায় নায়কের মৃত্যু হলে অবধারিতভাবেই তা দর্শকদের বেশি প্রভাবিত করে। শাহরুখ খান এবং অমিতাভ বচ্চনের ক্যারিয়ারই তার প্রমাণ । একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শাহরুখ খান তাঁর অভিনীত 17টি ছবিতে পর্দায় মারা গেছেন ৷ আর অমিতাভ বচ্চনের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা 27 । মৃত্যুর দৃশ্যের জন্য দু’জনেই দর্শকদের প্রিয় । তা সে "দিওয়ার" (1975) ছবিতে মায়ের কোলে অমিতাভ বচ্চনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগই হোক কিংবা "দেবদাস" (2002) ছবিতে শাহরুখ খানের শৈল্পিক মৃত্যু ৷ যেখানে পারো রূপী ঐশ্বর্যা রাই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে হাভেলির সিংহদ্বারের দিকে ছুটে যেতে গিয়ে ব্যর্থ হচ্ছেন ৷ তাঁর শাড়ির আঁচল খুলে মাটিতে লুটোচ্ছে আর দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ।
নিঃসন্দেহে সুশান্ত সিং রাজপুত প্রতিভাধর ছিলেন ৷ যিনি সহজাত দক্ষতায় স্বামী বিবেকানন্দের বাণীও যেমন বলতে পারতেন তেমনই আওড়াতে পারতেন অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের তত্ত্বও । শামক দাভরের ট্রুপে ব্যাক আপ ডান্সার হিসেবে কেরিয়ার শুরু করা সুশান্ত পরিশ্রম আর সংগ্রামের সংজ্ঞা ভালোই জানতেন । 2019 সালের অক্টোবরে যেমনটা তিনি টুইট করেছিলেন, "পশ্চিমে বলে, আমরা মন্দকে জয় করে তার ক্ষমতা খর্ব করে ফেলি । আর ভারত বলে আমরা মন্দকে ভোগ করে তাকে ধ্বংস করি, যতক্ষণ না তা ইতিবাচক উদযাপনে পরিণত হচ্ছে । লক্ষ্যটা সেই এক ৷ তা সে আদল যতই অন্যরকম হোক না কেন । জীবনের বিভ্রান্তিকর মতাদর্শের মধ্য দিয়ে যেভাবে রাস্তা খুঁজে নিয়ে আমরা এগোই, চলো আমরা একে অন্যকে এগোনোর জন্য ঈশ্বরপ্রদত্ত গতি কামনা করি ।"
একইরকমভাবে, জীবন এবং খ্যাতির অস্থায়িত্ব সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল ছিলেন সুশান্ত । 2018 সালের ডিসেম্বরে রুমিকে উদ্ধৃত করে করা তাঁর টুইট, "ছায়ার মতো আমি আছি, আবার নেই-ও ৷" আভাস দেয় সেই সময়ের যখন খ্যাতির আলো থেকে ফিরে আবার নিজের পথ খুঁজে পাবেন সুশান্ত ৷
কাভেরী বামজাই