ETV Bharat / bharat

হোঁচট খেয়েছে ব্র্যান্ড ইন্ডিয়ার ভাবমূর্তি; সত্যিই কি CAA-র খুব দরকার ছিল?

এটা অবশ্যই অনস্বীকার্য যে, CAA-র জন্য বিশ্বের নজরে ভারতের ভাবমূর্তি বড় রকম হোঁচট খেয়েছে । গত পাঁচ বছরে বিদেশনীতির দৌলতে প্রধানমন্ত্রী যতটুকু লাভ করতে পেরেছিলেন, সে সব কিছুই বর্তমানে খড়কুটোর মতো ভেসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সমাজকর্মী জাকিয়া সোমান ৷

CAA has dented brand India and domestic peace: is it worth it?
হোঁচট খেয়েছে ব্র্যান্ড ইন্ডিয়ার ভাবমূর্তি; সত্যিই কি CAA-র খুব দরকার ছিল?
author img

By

Published : Mar 14, 2020, 2:52 PM IST

সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) পাশ হওয়ার পর থেকে ভারত প্রচুর টালমাটাল পরিস্থিতির সাক্ষী থেকেছে। আইন পাশ হওয়া আটকাতে পড়ুয়াদের একজোট হয়ে প্রতিবাদ আখেরে একটি শক্তিশালী ছবি তুলে ধরেছে। মুসলিম মহিলাদের প্রস্তাবনা পাঠ, গণতন্ত্রের দাবিতে আম্বেদকর এবং গান্ধির বাণী ও ছবি হাতে করা আন্দোলন এক ঐতিহাসিক বার্তা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের কাছে দেশের এই প্রতিবাদ আন্দোলন এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে হওয়া দিল্লির সাম্প্রতিক হিংসার ছবি চর্চার প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে বর্ণাঢ্য গণতন্ত্র হিসাবে পরিচিত ভারত, যা একইসঙ্গে প্রাচীন সভ্যতা হিসাবেও পরিগণিত, তার ইতিবাচক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলিতে তুলে ধরা হয়েছে কীভাবে রাষ্ট্রপতি ভবনে তখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য ব্যাঙ্কোয়েটের আয়োজন চলছিল যখন উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে অশান্তির আগুন জ্বলছিল। রাষ্ট্রসংঘ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার এ নিয়ে আলোচনা করেছে। ভারতের পরিস্থিতি দেখে প্রকাশ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মালয়েশিয়া, টার্কি, ইরান এবং কানাডার মতো দেশ। আরও কিছু দেশ মুখে সংযত থাকার বার্তা দিলেও এ কথা স্বীকার করেছে, CAA ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আন্তর্জাতিক কিছু নাগরিক সমাজ সংগঠনের তরফে সরকারিভাবে বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে কড়া ভাষায় হিংসার নিন্দা করার পাশাপাশি অবিলম্বে CAA-র প্রত্যাহারের দাবিও জানানো হয়েছে। প্রভাবশালী বেশ কিছু বই-পত্রের উপ-সম্পাদকীয়তে এই আইনের বৈষম্যমূলক দিক এবং মুসলিমদের নিশানা করার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী বিজ়নেস ম্যাগাজিন ‘দা ইকোনমিস্ট’-এ দেশের আর্থিক শ্লথগতি নিয়ন্ত্রণ এবং হিংসার সময় নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে সরকারের ব্যর্থতার প্রকাশ্যে সমালোচনা করা হয়েছে। পাশাপাশি এই প্রশ্নও তোলা হয়েছে যে এই পরিস্থিতিতে ভারতে লগ্নি করতে কে চাইবে?

এটা অবশ্যই অনস্বীকার্য যে, CAA-র জন্য বিশ্বের নজরে ভারতের ভাবমূর্তি বড় রকম হোঁচট খেয়েছে । গত পাঁচ বছরে বিদেশনীতির দৌলতে প্রধানমন্ত্রী যতটুকু লাভ করতে পেরেছিলেন, সে সব কিছুই বর্তমানে খড়কুটোর মতো ভেসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এখন প্রশ্ন এটাই যে, কেন সরকার নিজে এই সমস্যার ছবিটা দেখতে পারছে না? কেন সরকার দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি ক্ষুণ্ণ করে এবং বিশ্বের কাছে দেশের ভাবমূর্তি বিসর্জন দিয়ে, বিদেশিদের নাগরিকত্ব দিতে উঠে-পড়ে লেগেছে?

এই আইনের লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য হল, এটি তিন প্রতিবেশী দেশ-পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের নিগৃহীতদের শর্তসাপেক্ষে ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করে। আর শর্তটি হল, নিগৃহীতরা যেন কোনওমতেই মুসলিম না হন। CAA-র আগেই অসমে ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার অফ সিটিজেন্স (NRC) লাগু হয়েছিল। যার জেরে ১৯ লাখ মানুষকে অ-নাগরিক সাব্যস্ত করে ‘ডিটেনশন সেন্টারে’ পাঠানো হয়। সেই NRC-র পর CAA-র আবির্ভাব তাই যথেষ্টই সমস্যাদায়ক। এর ফলে সাধারণ ভারতীয়দের মনে নিদারুণ আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে কারণ তাঁরা জানেন, তাঁদের নাগরিকত্ব বর্তমানে প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে। এই পরিস্থিতিতে BJP নেতাদের মন্তব্য, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি যে CAA-NPR-NRC বিদেশি অনুপ্রবেশকারীদের দেশছাড়া করবে, আতঙ্ক আরও বাড়িয়েছে। পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া "কোনও NRC-র পরিকল্পনা হয়নি" আশ্বাসেও কিছু কাজ হচ্ছে না কারণ সরকারের প্রতি নাগরিকদের ইতিমধ্যেই বিশ্বাস ভঙ্গ হয়ে গিয়েছে। উত্তরপ্রদেশের মতো জায়গায় গোরক্ষকদের নজরদারি সংক্রান্ত হিংসা, গণপিটুনি, বর্ষীয়ান নেতাদের বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, প্রকাশ্যে পুলিশি বৈষম্যের মতো ঘটনা দেশবাসীকে সরকারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আরও সন্দিগ্ধ করে তুলেছে। তার উপর CAA থেকে মুসলিমদের বঞ্চিত রাখার ঘটনায় প্রচুর মানুষের ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে। স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা রাস্তায় নেমে এই অবিচার এবং বৈষম্যমূলক আইনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করেছেন এবং সাংবিধানিক অধিকারের দাবিতে লড়াই করেছেন।

বেশ কিছু বড় ধরনের বৈষম্য রয়েছে CAA-তে। নিগ্রহের অবাধ ছাড় রয়েছে এই আইনে। হ্যাঁ, প্রতিবেশী দেশে নিগৃহীতদের আশ্রয় এবং নাগরিকত্ব দেওয়া মহৎ উদ্দেশ্য বটে ৷ আর এর বিরোধিতাও কেউ করছেন না। কিন্তু অন্য একটি নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের তুলনায় যখন সেই নিগৃহীতরা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছেন কিংবা ধর্মের উপর ভিত্তি করে কাউকে নাগরিক তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে, তখন সেই আইন বৈষম্যমূলক হয়ে পড়ছে। সাংবিধানিক নিয়মনীতি কখনওই কাউকে ধর্মের উপর ভিত্তি করে পৃথক করার পথ দেখায় না।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের অধিকাংশ প্রতিবেশী দেশই বাস্তবে দিব্যতান্ত্রিক, অর্থাৎ এমন দেশ, যা ধর্মের নামে চলে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা হয় এবং ভিন্ন মত পোষণকারীদের দমিয়ে রাখা হয়। এই মুহূর্তে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কথা ভুলে যান, ভুলে যান মুসলিমদের মধ্যে সংখ্যালঘু, শিয়া বা আহমেদিয়া কিংবা হাজারাদের কথাও—যারা নিগৃহীত হন, তাদের অধিকাংশই সুন্নি মুসলমান। বরং সেই দৃষ্টান্ত মনে করুন, যেখানে পাকিস্তানে খুনোখুনির মাধ্যমে ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস ছড়ানোর সমালোচনাকারীদের মুখবন্ধ করতে, তাদের উপর স্বৈরাচারী ধর্মদ্রোহিতা আইন লাগু করা হয়। শাস্তি একটাই, ফাঁসি। প্রাণ বাঁচাতে তাই অনেকেই দেশ থেকে পালিয়ে যান এবং বিশ্বের নানা দেশে শরণার্থী হিসাবে থাকতে শুরু করেন। আরও একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হল বাংলাদেশে সেই সব ধর্মনিরপেক্ষ সমাজকর্মী এবং ব্লগারদের নৃশংস হত্যা, যাঁরা ইসলাম–নির্ভর রাজনীতি এবং সমাজের উপর তার প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এঁরা কিন্তু কোনওভাবেই ভারতে আশ্রয় পাওয়ার যোগ্য নন, আর তাঁদের এই তালিকা থেকে বাদ পড়ার কারণ, তাঁরা মুসলিম।

আরও যে একটি বৈষম্য CAA-কে কোণঠাসা করে রেখেছে, তা হল এটি কেবলমাত্র ভারতের তিনটি প্রতিবেশী দেশের জন্যই প্রযোজ্য। অথচ সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত হয়েছেন শ্রীলঙ্কার তামিলভাষী মানুষজন। LTTE এবং সেনার লড়াইয়ে হাজার হাজার নিরীহ ভারতীয় বংশোদ্ভূত তামিলদের প্রাণহানি হয়েছে । সরকারের বোঝা উচিত যে আদপে CAA-যে একটি বিশেষ মতাদর্শ মেনে চলা আইন, যার সৃষ্টিই হয়েছে হিন্দু জাতীয়তাবাদ থেকে, আর এই প্রত্যয় ধীরে ধীরে মানুষের মনে বদ্ধমূল হচ্ছে । প্রধানমন্ত্রীর উচিত, এই আইনে সংশোধনী এনে একে ভারতের সমস্ত প্রতিবেশী দেশের সমস্ত নিগৃহীত মানুষদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য করে তোলা, আর এই মর্মে জনমানসে বিশ্বাস অর্জনের জন্য উদ্যোগী হয়ে আলোচনায় বসা।

সর্বশেষ অথচ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, সরকারপক্ষ যখন নিজের দেশের মানুষেরই উদ্বেগ, বিভ্রান্তি দূর করতে ব্যর্থ হচ্ছে, তখন কী করে তারা বিদেশিদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যাপারে এতটা উৎসাহ দেখাতে পারছে? জবাবে আদপে এই সমালোচনাই বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছে যে পশ্চিমবঙ্গ এবং অন্যান্য কিছু রাজ্যে নির্বাচনে সাফল্য পেতেই সরকারপক্ষের এই পদক্ষেপ।

সরকারের উচিত, CAA-র মতো অপ্রয়োজনীয় আইনকে গুরুত্ব না দিয়ে সেই গুরুত্ব বরং অর্থনীতির উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির উপর আরোপ করা । সাম্প্রতিককালের অর্থনৈতিক সংকট দেশের ইতিহাসে অন্যতম খারাপ দশার মধ্যে পড়ে। উৎপাদন ক্ষেত্রের অধোগতি অব্যাহত আর বেকারত্বের হার চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। কৃষিকাজের ক্রমবর্ধমান খরচ এবং জলবায়ুর খামখেয়ালিপনার জেরে দেশের সর্বত্র চাষিরা অভূতপূর্ব সংকটে পড়েছেন। দেশের যুবসমাজের কর্মসংস্থানের জন্য আমাদের আরও পঠনপাঠনগত এবং কারিগরি শিক্ষার পাঠ্যক্রম প্রয়োজন। মহিলাদের নিরাপত্তায় অনেক কিছুই এখনও করা বাকি। যে সরকার বৃদ্ধি এবং বিকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, তাদের এমন অপ্রয়োজনীয় আইন কামড়ে পড়ে থেকে, উদ্দেশ্যহীনভাবে বিচরণ করা উচিত নয়। সামাজিক সম্প্রীতির অভাবে, সাম্প্রদায়িক হিংসার প্রাবল্য যখন বহুমাত্রায় দৃশ্যমান, তখন মেক ইন ইন্ডিয়া কোনওভাবেই বিদেশি লগ্নি টেনে আনতে পারবে না। সরকারকে ন্যায়বিচার, সমতা এবং পক্ষপাতহীনতা না করার নিজের সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি পালন তো করতেই হবে। এই সরকারকে CAA নিয়ে নিজের অবস্থান পুর্নবিবেচনা করতেই হবে, কারণ তা ছাড়া নানা ভাষা-নানা মত-নানা সাংস্কৃতিক বিশ্বাসে ভর করে বেড়ে ওঠা ভারতের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তিতে এমন চিড় ধরবে, যা কোনওদিন সারানো যাবে না।

সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) পাশ হওয়ার পর থেকে ভারত প্রচুর টালমাটাল পরিস্থিতির সাক্ষী থেকেছে। আইন পাশ হওয়া আটকাতে পড়ুয়াদের একজোট হয়ে প্রতিবাদ আখেরে একটি শক্তিশালী ছবি তুলে ধরেছে। মুসলিম মহিলাদের প্রস্তাবনা পাঠ, গণতন্ত্রের দাবিতে আম্বেদকর এবং গান্ধির বাণী ও ছবি হাতে করা আন্দোলন এক ঐতিহাসিক বার্তা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের কাছে দেশের এই প্রতিবাদ আন্দোলন এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে হওয়া দিল্লির সাম্প্রতিক হিংসার ছবি চর্চার প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে বর্ণাঢ্য গণতন্ত্র হিসাবে পরিচিত ভারত, যা একইসঙ্গে প্রাচীন সভ্যতা হিসাবেও পরিগণিত, তার ইতিবাচক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলিতে তুলে ধরা হয়েছে কীভাবে রাষ্ট্রপতি ভবনে তখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য ব্যাঙ্কোয়েটের আয়োজন চলছিল যখন উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে অশান্তির আগুন জ্বলছিল। রাষ্ট্রসংঘ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার এ নিয়ে আলোচনা করেছে। ভারতের পরিস্থিতি দেখে প্রকাশ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মালয়েশিয়া, টার্কি, ইরান এবং কানাডার মতো দেশ। আরও কিছু দেশ মুখে সংযত থাকার বার্তা দিলেও এ কথা স্বীকার করেছে, CAA ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আন্তর্জাতিক কিছু নাগরিক সমাজ সংগঠনের তরফে সরকারিভাবে বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে কড়া ভাষায় হিংসার নিন্দা করার পাশাপাশি অবিলম্বে CAA-র প্রত্যাহারের দাবিও জানানো হয়েছে। প্রভাবশালী বেশ কিছু বই-পত্রের উপ-সম্পাদকীয়তে এই আইনের বৈষম্যমূলক দিক এবং মুসলিমদের নিশানা করার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী বিজ়নেস ম্যাগাজিন ‘দা ইকোনমিস্ট’-এ দেশের আর্থিক শ্লথগতি নিয়ন্ত্রণ এবং হিংসার সময় নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে সরকারের ব্যর্থতার প্রকাশ্যে সমালোচনা করা হয়েছে। পাশাপাশি এই প্রশ্নও তোলা হয়েছে যে এই পরিস্থিতিতে ভারতে লগ্নি করতে কে চাইবে?

এটা অবশ্যই অনস্বীকার্য যে, CAA-র জন্য বিশ্বের নজরে ভারতের ভাবমূর্তি বড় রকম হোঁচট খেয়েছে । গত পাঁচ বছরে বিদেশনীতির দৌলতে প্রধানমন্ত্রী যতটুকু লাভ করতে পেরেছিলেন, সে সব কিছুই বর্তমানে খড়কুটোর মতো ভেসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এখন প্রশ্ন এটাই যে, কেন সরকার নিজে এই সমস্যার ছবিটা দেখতে পারছে না? কেন সরকার দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি ক্ষুণ্ণ করে এবং বিশ্বের কাছে দেশের ভাবমূর্তি বিসর্জন দিয়ে, বিদেশিদের নাগরিকত্ব দিতে উঠে-পড়ে লেগেছে?

এই আইনের লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য হল, এটি তিন প্রতিবেশী দেশ-পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের নিগৃহীতদের শর্তসাপেক্ষে ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করে। আর শর্তটি হল, নিগৃহীতরা যেন কোনওমতেই মুসলিম না হন। CAA-র আগেই অসমে ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার অফ সিটিজেন্স (NRC) লাগু হয়েছিল। যার জেরে ১৯ লাখ মানুষকে অ-নাগরিক সাব্যস্ত করে ‘ডিটেনশন সেন্টারে’ পাঠানো হয়। সেই NRC-র পর CAA-র আবির্ভাব তাই যথেষ্টই সমস্যাদায়ক। এর ফলে সাধারণ ভারতীয়দের মনে নিদারুণ আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে কারণ তাঁরা জানেন, তাঁদের নাগরিকত্ব বর্তমানে প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে। এই পরিস্থিতিতে BJP নেতাদের মন্তব্য, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি যে CAA-NPR-NRC বিদেশি অনুপ্রবেশকারীদের দেশছাড়া করবে, আতঙ্ক আরও বাড়িয়েছে। পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া "কোনও NRC-র পরিকল্পনা হয়নি" আশ্বাসেও কিছু কাজ হচ্ছে না কারণ সরকারের প্রতি নাগরিকদের ইতিমধ্যেই বিশ্বাস ভঙ্গ হয়ে গিয়েছে। উত্তরপ্রদেশের মতো জায়গায় গোরক্ষকদের নজরদারি সংক্রান্ত হিংসা, গণপিটুনি, বর্ষীয়ান নেতাদের বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, প্রকাশ্যে পুলিশি বৈষম্যের মতো ঘটনা দেশবাসীকে সরকারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আরও সন্দিগ্ধ করে তুলেছে। তার উপর CAA থেকে মুসলিমদের বঞ্চিত রাখার ঘটনায় প্রচুর মানুষের ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে। স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা রাস্তায় নেমে এই অবিচার এবং বৈষম্যমূলক আইনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করেছেন এবং সাংবিধানিক অধিকারের দাবিতে লড়াই করেছেন।

বেশ কিছু বড় ধরনের বৈষম্য রয়েছে CAA-তে। নিগ্রহের অবাধ ছাড় রয়েছে এই আইনে। হ্যাঁ, প্রতিবেশী দেশে নিগৃহীতদের আশ্রয় এবং নাগরিকত্ব দেওয়া মহৎ উদ্দেশ্য বটে ৷ আর এর বিরোধিতাও কেউ করছেন না। কিন্তু অন্য একটি নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের তুলনায় যখন সেই নিগৃহীতরা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছেন কিংবা ধর্মের উপর ভিত্তি করে কাউকে নাগরিক তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে, তখন সেই আইন বৈষম্যমূলক হয়ে পড়ছে। সাংবিধানিক নিয়মনীতি কখনওই কাউকে ধর্মের উপর ভিত্তি করে পৃথক করার পথ দেখায় না।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের অধিকাংশ প্রতিবেশী দেশই বাস্তবে দিব্যতান্ত্রিক, অর্থাৎ এমন দেশ, যা ধর্মের নামে চলে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা হয় এবং ভিন্ন মত পোষণকারীদের দমিয়ে রাখা হয়। এই মুহূর্তে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কথা ভুলে যান, ভুলে যান মুসলিমদের মধ্যে সংখ্যালঘু, শিয়া বা আহমেদিয়া কিংবা হাজারাদের কথাও—যারা নিগৃহীত হন, তাদের অধিকাংশই সুন্নি মুসলমান। বরং সেই দৃষ্টান্ত মনে করুন, যেখানে পাকিস্তানে খুনোখুনির মাধ্যমে ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস ছড়ানোর সমালোচনাকারীদের মুখবন্ধ করতে, তাদের উপর স্বৈরাচারী ধর্মদ্রোহিতা আইন লাগু করা হয়। শাস্তি একটাই, ফাঁসি। প্রাণ বাঁচাতে তাই অনেকেই দেশ থেকে পালিয়ে যান এবং বিশ্বের নানা দেশে শরণার্থী হিসাবে থাকতে শুরু করেন। আরও একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হল বাংলাদেশে সেই সব ধর্মনিরপেক্ষ সমাজকর্মী এবং ব্লগারদের নৃশংস হত্যা, যাঁরা ইসলাম–নির্ভর রাজনীতি এবং সমাজের উপর তার প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এঁরা কিন্তু কোনওভাবেই ভারতে আশ্রয় পাওয়ার যোগ্য নন, আর তাঁদের এই তালিকা থেকে বাদ পড়ার কারণ, তাঁরা মুসলিম।

আরও যে একটি বৈষম্য CAA-কে কোণঠাসা করে রেখেছে, তা হল এটি কেবলমাত্র ভারতের তিনটি প্রতিবেশী দেশের জন্যই প্রযোজ্য। অথচ সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত হয়েছেন শ্রীলঙ্কার তামিলভাষী মানুষজন। LTTE এবং সেনার লড়াইয়ে হাজার হাজার নিরীহ ভারতীয় বংশোদ্ভূত তামিলদের প্রাণহানি হয়েছে । সরকারের বোঝা উচিত যে আদপে CAA-যে একটি বিশেষ মতাদর্শ মেনে চলা আইন, যার সৃষ্টিই হয়েছে হিন্দু জাতীয়তাবাদ থেকে, আর এই প্রত্যয় ধীরে ধীরে মানুষের মনে বদ্ধমূল হচ্ছে । প্রধানমন্ত্রীর উচিত, এই আইনে সংশোধনী এনে একে ভারতের সমস্ত প্রতিবেশী দেশের সমস্ত নিগৃহীত মানুষদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য করে তোলা, আর এই মর্মে জনমানসে বিশ্বাস অর্জনের জন্য উদ্যোগী হয়ে আলোচনায় বসা।

সর্বশেষ অথচ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, সরকারপক্ষ যখন নিজের দেশের মানুষেরই উদ্বেগ, বিভ্রান্তি দূর করতে ব্যর্থ হচ্ছে, তখন কী করে তারা বিদেশিদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যাপারে এতটা উৎসাহ দেখাতে পারছে? জবাবে আদপে এই সমালোচনাই বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছে যে পশ্চিমবঙ্গ এবং অন্যান্য কিছু রাজ্যে নির্বাচনে সাফল্য পেতেই সরকারপক্ষের এই পদক্ষেপ।

সরকারের উচিত, CAA-র মতো অপ্রয়োজনীয় আইনকে গুরুত্ব না দিয়ে সেই গুরুত্ব বরং অর্থনীতির উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির উপর আরোপ করা । সাম্প্রতিককালের অর্থনৈতিক সংকট দেশের ইতিহাসে অন্যতম খারাপ দশার মধ্যে পড়ে। উৎপাদন ক্ষেত্রের অধোগতি অব্যাহত আর বেকারত্বের হার চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। কৃষিকাজের ক্রমবর্ধমান খরচ এবং জলবায়ুর খামখেয়ালিপনার জেরে দেশের সর্বত্র চাষিরা অভূতপূর্ব সংকটে পড়েছেন। দেশের যুবসমাজের কর্মসংস্থানের জন্য আমাদের আরও পঠনপাঠনগত এবং কারিগরি শিক্ষার পাঠ্যক্রম প্রয়োজন। মহিলাদের নিরাপত্তায় অনেক কিছুই এখনও করা বাকি। যে সরকার বৃদ্ধি এবং বিকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, তাদের এমন অপ্রয়োজনীয় আইন কামড়ে পড়ে থেকে, উদ্দেশ্যহীনভাবে বিচরণ করা উচিত নয়। সামাজিক সম্প্রীতির অভাবে, সাম্প্রদায়িক হিংসার প্রাবল্য যখন বহুমাত্রায় দৃশ্যমান, তখন মেক ইন ইন্ডিয়া কোনওভাবেই বিদেশি লগ্নি টেনে আনতে পারবে না। সরকারকে ন্যায়বিচার, সমতা এবং পক্ষপাতহীনতা না করার নিজের সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি পালন তো করতেই হবে। এই সরকারকে CAA নিয়ে নিজের অবস্থান পুর্নবিবেচনা করতেই হবে, কারণ তা ছাড়া নানা ভাষা-নানা মত-নানা সাংস্কৃতিক বিশ্বাসে ভর করে বেড়ে ওঠা ভারতের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তিতে এমন চিড় ধরবে, যা কোনওদিন সারানো যাবে না।

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.