দিল্লি, 1 ফেব্রুয়ারি : চ্যালেঞ্জ ছিল ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিকে নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর ওষুধ দেওয়ার ৷ দ্বিতীয়বার সাধারণ বাজেট পেশ করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন চাকরিজীবীদের মুখে হাসি ফোটানোর ইঙ্গিত দিলেন বটে, কিন্তু দিনের শেষে একটা খোঁচা থেকেই গেল ৷ করছাড়ের উর্ধ্বসীমা কমিয়ে একদিকে সাহসী পদক্ষেপের ইঙ্গিত দিলেন, অন্যদিকে নতুন কর কাঠামো ঘোষণা করে বুঝিয়ে দিলেন কেন্দ্রীয় সরকার সাধারণ মানুষের উপর থেকে চাপ কমানোর মতো 'বৈপ্লবিক' সিদ্ধান্ত নিতে এখনও সাবধানী ৷
বাজেটে রেলের আধুনিকীকরণ, ইন্টারনেট পরিষেবার সম্প্রসারণ, গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার পাশাপাশি রেলের অব্যবহৃত জমিতে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু করার প্রস্তাব রয়েছে ৷ এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ রেল স্টেশনে ওয়াইফাই ব্যবস্থা, স্মার্ট সিটি তৈরি, জাতীয় সড়কের সম্প্রসারণ, দ্রুতগতির ট্রেন চালুর ঘোষণাও করেছেন অর্থমন্ত্রী, যা মোদির ডিজ়িটাল ইন্ডিয়ার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার উদ্যোগ বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল ৷ কিন্তু মধ্যবিত্তের নজর সবচেয়ে বেশি যেদিকে থাকে, সেই কর কাঠামোর ক্ষেত্রে এক মধ্যপন্থা নীতি নিলেন তিনি ৷ আয়কর কাঠামোর ক্ষেত্রে দু'রকম পথ বেছে নিলেন অর্থমন্ত্রী ৷ যেভাবে প্রধানমন্ত্রী সংসদে বসে নির্মলার কর কাঠামোর প্রশংসায় টেবিল চাপড়ে অভিনন্দন জানালেন, তাতে বোঝা গেল চাপে থাকা প্রধানমন্ত্রীও এমনই একটা 'মধ্যপন্থা'-র আশা করেছিলেন ৷
বছরে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ক্ষেত্রে কোনও কর দিতে হবে না ৷ কিন্তু, তার পর কর প্রদানের ক্ষেত্রে বেশ কিছু পরিবর্তন করা হল ৷ যেমন 5 থেকে 10 লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ে এত দিন 20 শতাংশ আয়কর দিতে হত ৷ এই বারের বাজেটে এই ধাপকে দুটি ভাগে ভাগ করা হল ৷ 5 থেকে 7.5 লাখ টাকা পর্যন্ত 10 শতাংশ এবং 7.5 থেকে 10 লাখ টাকা পর্যন্ত বছরে আয়ে দিতে 15 শতাংশ হারে আয়কর দিতে হবে । 10 লাখ থেকে 12.5 লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ক্ষেত্রে 20 শতাংশ হারে, 12 লাখ থেকে 15 লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ক্ষেত্রে আয়করের হারটা হবে 25 শতাংশ । কিন্তু 15 লাখ টাকার বেশি হলে আয়করের হার থাকবে আগের মতোই ৷ অর্থাৎ, 30 শতাংশ হারে ৷
নতুন কর নীতিতে কেউ চাইলে পুরোনো বা নতুন পদ্ধতিতে কর প্রদান করতে পারবেন ৷ এতদিন 100টি ক্ষেত্রে করছাড়ের সুবিধা ছিল ৷ এর মধ্যে 70টি বিষয়কে তুলে দেওয়া হল ৷ অর্থাৎ যে করদাতারা নতুন হারে কর দেবেন, তাঁরা এই 70টি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করলে আর কোনও ছাড়ের সুবিধা পাবেন না ৷ তবে, নতুন আয়কর নীতিতে গ্রাহকদের মোট আয় ও বিনিয়োগের উপর নির্ভর করবে কোন কর কাঠামো কাদের জন্য উপযুক্ত ৷ যাঁদের বিনিয়োগ বেশি, তাঁদের পুরোনো হারে কর দেওয়া সুবিধাজনক হলেও নতুন কর কাঠামোয় কম বিনিয়োগকারীরা বিশেষ সুবিধা পাবেন বলেই অনুমান ৷ পুরোনো হারে কর দিলে জীবন বিমা, গৃহ ঋণ সব ক্ষেত্রেই ছাড় মিলবে ৷ নতুন ক্ষেত্রে এমন অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন সাধারণ মানুষ ৷
এবারের বাজেটে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে বিলগ্নিকরণ ৷ সরকার বিভিন্ন সংস্থায় থাকা তাদের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করছে ৷ বিরোধীরা বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছে ৷ সেই পদক্ষেপ থেকে যে কেন্দ্রীয় সরকার বিন্দুমাত্র সরে আসছে না তা বুঝিয়ে দিলেন অর্থমন্ত্রী ৷ জীবন বিমা নিগমের যে শেয়ার সরকারের হাতে ছিল, তা বিক্রি করে দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে বাজেটে ৷ পাশাপাশি ব্যাঙ্ক লাটে উঠলে গ্রাহকরা যাতে কোনও সমস্যায় না পড়েন, তার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ ঘোষণা করা হল ৷ এতদিন কোনও ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে গেলে গ্রাহকরা এক লাখ টাকা পেতেন ৷ সেই উর্ধ্বসীমা বাড়িয়ে পাঁচ লাখ টাকা করা হল ৷ পাশাপাশি, ধুঁকতে থাকা ব্যাঙ্কগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করতে 3 লাখ 50 হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করা হল ৷
আবার, গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে দিশা দেখাতে ও কৃষকদের মানোন্নয়ন ঘটাতে বিশেষ প্যাকেজের প্রস্তাব দেওয়া হল বাজেটে ৷ প্রতি ঘরে বিদ্যুৎ - এই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে জোর দেওয়া হল সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে ৷ নতুন রেললাইন চালু বা রেলের পড়ে থাকা জমিতে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প চালুর উদ্যোগ, কৃষি উন্নয়নে 16 দফা অ্যাকশন প্ল্যান ইত্যাদি পদক্ষেপ ঘোষণা করে সরকার বিরোধীদের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করেছে ৷ এছাড়া যেভাবে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে 100টি বিমানবন্দর চালুর ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে বিমান শিল্পকে চাঙ্গা করার দাওয়াই হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা ৷ কিন্তু, যখন দেশের অসামরিক বিমান পরিবহন অনেক সমস্যার সামনে, তখন অর্থমন্ত্রীর এহেন পদক্ষেপ কতটা যুক্তিসঙ্গত, সেই প্রশ্নই উঠছে ৷
প্রধানমন্ত্রী মোদির ঘোষণা ছিল, শিল্পের পাশাপাশি কৃষিক্ষেত্রকেও গুরুত্ব দিচ্ছে তাঁর সরকার ৷ কিন্তু, বাস্তব পরিস্থিতি অন্য কথাই বলছিল ৷ নিজের প্রয়োজনের ন্যূনতম চাহিদা পূরণের দাবি নিয়ে মুম্বইয়ে কৃষকদের লং মার্চ মোদি সরকারের দিকে বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল ৷ কেন্দ্রীয় সরকারের উপর সেই পদযাত্রা কতটা চাপ তৈরি করেছিল, আজ বাজেটে কৃষকদের জন্য একাধিক পদক্ষেপ ঘোষণা যেন সেই কথাই প্রমাণ করল ৷ 2022 সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণার পাশাপাশি কিষান রেল চালুর সিদ্ধান্ত আসলে কৃষি ব্যবস্থা তথা কৃষকদের উৎসাহিত করার চেষ্টা ৷ গ্রামে গ্রামে ইন্টারনেট পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিশেষ অপটিক ফাইবারের সাহায্য নেওয়ারও প্রস্তাব রয়েছে বাজেটে ৷
আজ বাজেট পেশের সময় একাধিক শায়েরি পড়েন নির্মলা সীতারমন ৷ শায়েরির মাধ্যমে কখনও দেশের যুব সম্প্রদায়কে চাঙ্গা করার চেষ্টা করলেন, কখনও আবার বর্তমান সরকারের দিশা তুলে ধরার চেষ্টা করলেন ৷ প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের 'সব কা সাথ, সব কা বিকাশ' পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে শহরের পাশাপাশি গ্রামের প্রতিটি মানুষের উন্নয়নে একাধিক পদক্ষেপ ঘোষণা করলেন ৷ কিন্তু, এত কিছুর পরেও চাকরির সুযোগ কতটা বাড়ল, সেই দিশা কি দেখাতে পারলেন অর্থমন্ত্রী - প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা ৷ আবার জম্মু-কাশ্মীরের ও লাদাখের জন্য বিপুল বরাদ্দ ঘোষণা কি আসলে মোদি-নীতিরই নামান্তর? সেই প্রশ্নও তুলছেন বিরোধীরা ৷