আজ, ২৮ জুন প্রয়াত পিভি নরসিমা রাওয়ের জন্মদিন। উচ্চশিক্ষিত নরসিমা রাও ছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্র গঠন, জননীতি এবং প্রশাসনে তাঁর অসামান্য পারদর্শিতার জন্য তাঁকে অনেকেই আধুনিক চাণক্য বলে অভিহিত করেন। শুধু এই কারণেই নয়, ‘চাণক্য’-এর অন্যতম কৃতিত্ব একটি সংখ্যালঘু সরকারকে সফল ভাবে পাঁচ বছরের মেয়াদ উত্তীর্ণ করানো। এটি তাঁর রাজনৈতিক চাতুর্যের অন্যতম উদাহরণ। সেই সংস্কারক, শিক্ষাবিদ, ভাষাবিদ এবং বাগ্মী পণ্ডিতকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম। ভারতীয় অর্থনীতিতে তাঁর এবং মনমোহন সিংহের অবদান ভোলার নয়। ভারতীয় অর্থনীতির উদারীকরণ, লাইসেন্স-পারমিট রাজের থাবা থেকে দেশের অর্থনীতিকে মুক্ত করে আন্তর্জাতিক মানের গড়ে তোলার পিছনে তাঁর অবদান নিয়ে বহু বার বহু কথা অসংখ্য বক্তৃতায় বলা হয়েছে। আমি তাই সে বিষয়ে আবার আলোচনা করতে চাইছি না। আমি শুধু একটা কথা বলতে চাই, তিনি খোঁড়াতে থাকা এবং খুবই কম বৃদ্ধির ভারতীয় অর্থনীতি, যাকে ‘হিন্দু রেট অব গ্রোথ’ বে ব্যঙ্গ করা হত, তার বিশ্বায়ন ঘটিয়েছিলেন। তার আমলেই পাঁচ দশক ধরে একই জায়গায় আটকে থাকা হিন্দু গ্রোথ রেট থেকে বেরিয়ে আসতে পারে ভারতীয় অর্থনীতি।
তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সেই সময়, ১৯৯৪ সালের জুন থেকে ১৯৯৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত আমি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব হিসাবে কাজ করেছি। স্বরাষ্ট্র সচিবের পদটি সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদ। সাধারণত প্রধানমন্ত্রীর হোম স্টেট-এর হোম ক্যাডারের কোনও IAS অফিসার, যিনি আগে তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন এবং যাঁর উপর প্রধানমন্ত্রীর যথেষ্ট আস্থা রয়েছে, তাঁকেই এই পদের জন্য মনোনিত করা হয়। আমার ক্ষেত্রে কিন্তু বিষয়টা ছিল আলাদা। আমি ছিলাম মহারাষ্ট্র ক্যাডারের। এমনকি ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত যুগ্ম সচিব থাকার সময়টুকু ছাড়া আমি ভারত সরকারের কোনও পদে কোনও দিন কাজও করিনি। দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৯৯৩-’৯৪ সালে আমার পোস্টিং হয় গ্রামোন্নয়ন ও আবাসন মন্ত্রকের সচিব পদে। সেখানে কয়েক মাস কাজের সময় প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওয়ের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। কিন্তু এই প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আমাকে স্বরাষ্ট্র সচিব পদে উন্নীত করা হয়। আমার ধারণা, সেই সময়ের স্বরাষ্ট্র সচিব, শঙ্কররাও বি চহ্বন, যিনি নিজেও মহারাষ্ট্র থেকে ছিলেন, তিনিই সৎ ও পরিশ্রমী অফিসার হিসাবে আমার কথা প্রধানমন্ত্রীকে বলেন। আমি এটা শুধুমাত্র এই কারণেই উল্লেখ করলাম কারণ, পিভি রাও কাউকে কোনও রকম বিশেষ সুবিধা না দিয়ে শুধুমাত্র দক্ষতার উপর জোর দিয়েছিলেন। শুধুমাত্র দক্ষতার জন্যই তিনি বিরোধী নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামীকে মন্ত্রীর সমতুল পদে বসিয়েছিলেন। পাশাপাশি আর এক বিরোধী নেতা ও শক্তিশালী বক্তা অটলবিহারী বাজেপয়ীকে রাষ্ট্রপুঞ্জে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য মনোনিত করেছিলেন। সেই একই কারণে অর্থনীতিবিদ এবং একেবারেই অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মনমোহন সিংহকে দেশের অর্থমন্ত্রীর জন্য নির্বাচিত করেন।
নরসিমা রাওয়ের যে বিষয়গুলি সবার প্রথমে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, সেগুলি হল তাঁর হিমশীতল মস্তিষ্ক, স্থির বুদ্ধি এবং নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। বহু কঠিন রাজনৈতিক সমস্যা, যার বেশির ভাগটাই তাঁরই নিজের দল কংগ্রেস থেকে এসেছিল, সেগুলি সামলাতেন খুবই দৃঢ় ভাবে। তিনি কোনও সমস্যাতেই ঘাবড়ে যেতেন না। তাঁর আমলে বাবরি মসজিদ ধ্বংস নিয়ে তাঁকে বহু বক্রোক্তি ও প্রশাসনিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। বাবরি কাণ্ডে তাঁর প্রশাসনের অবস্থান নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু বাবরি মসজিদ কাণ্ডে গঠিত লিব্রাহান কমিশন জানিয়ে দেয়, তাঁর নেওয়া সিদ্ধান্তের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে কখনওই দোষারোপ করা যায় না। স্থিতপ্রজ্ঞার আদর্শ উদাহরণ ছিলেন তিনি।
চরিত্রগত ভাবে তাঁর সরকারের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল, ভারতীয় সংবিধানের প্রতি তাঁর অগাধ আস্থা। তাঁর অনুমতির অপেক্ষায় থাকা যে কোনও প্রকল্প নিয়ে তাঁর প্রথম প্রশ্ন ছিল, “এটা সাংবিধানিক তো?” এমন কোনও প্রস্তাব বা প্রকল্পে তিনি কখনওই রাজি হতেন না, যেগুলিকে তিনি মনে করতেন সংবিধান বিরোধী।
তিনিই প্রথম নেতা, যিনি ভারতের ‘পূর্বে তাকাও’ নীতি প্রবর্তন করেন। এর আগে পর্যন্ত ভারতের প্রধান নজর ছিল পশ্চিমি রাষ্ট্র ও পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলি। তিনি বুঝেছিলেন, এশিয়া মহাদেশে ভারতের পক্ষে প্রতিষ্ঠিত হওয়া তখনই সম্ভব, যখন বাংলাদেশ, মায়ানমার, তাইল্যান্ড এবং ASEAN গোষ্টিভুক্ত অন্য দেশগুলির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক মজবুত হবে। তাঁর আমলেই ভারতের সঙ্গে ইজরায়েলের সম্পর্ক মজবুত হয় এবং ১৯৯২ সালে তারা নয়াদিল্লিতে দূতাবাস খোলে। ইরানের সঙ্গেও তিনি মজবুত সম্পর্ক গড়ে তোলেন। দেশের পরমাণু পরীক্ষা এবং ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা অত্যন্ত সফল হয়। প্রসঙ্গত, সাধারণ নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন আগে, ১৯৯৬ সালের মে মাসে পরমাণু বোমার পরীক্ষা করতে তিনি ডক্টর আবদুল কালামকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কংগ্রেস নির্বাচনে হেরে যায় এবং ১৯৯৮ সালে বাজপেয়ী সরকারের আমলে পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা হয়।
তিনি একান্ত ভাবে চেয়েছিলেন কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করতে। যদিও ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সেই রাজ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথাচাড়া দিয়েছিল। তিনি ডক্টর ফারুখ আবদুল্লা এবং রাজ্যের অন্য নেতাদের বলেছিলেন যে, তিনি যে কোনও প্রস্তাবে রাজি যতক্ষণ কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ থাকে। বুরকিনা ফাসোয় এক সরকারি সফর থেকে তিনি ঘোষণা করেন, কাশ্মীর যতক্ষণ ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ রয়েছে, ততক্ষণ তার স্বায়ত্ত্বশাসনের ক্ষেত্রে কোনও নির্দিষ্ট সীমা নেই। কিন্তু এই বিষয়ে তিনি বেশি কিছু করার আগেই সাধারণ নির্বাচনে হেরে যায় কংগ্রেস। জম্মু-কাশ্মীরে বিধানসভা ও সংসদীয় নির্বাচন করানোর কৃতিত্ব কিন্তু তাঁরই। প্রায় ৮ বছর সে রাজ্যের মানুষ ভোট দিতে পারেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, নির্বাচিত সরকার পাওয়ার অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। তিনি আমাকে বলেছিলেন, সে রাজ্যের নির্বাচন যেন দেশের অন্যান্য অংশের থেকে আলাদা ভাবে করা হয় এবং তা যেন সাধারণ নির্বাচনের পরে করা হয়। কিন্তু সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেস হেরে যাওয়ায় যাবতীয় পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। পরে দেবগৌড়ার আমলে নির্বাচন কমিশন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কঠিন পরিশ্রমের ফলে সে রাজ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর দর্শন ছিল, বিচ্ছিন্নতাবাদের মোক্ষম ওষুধ হল নির্বাচন। আর এই নীতি থেকেই তিনি নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচ্ছিন্নতাবাদে দীর্ণ অসম এবং পঞ্জাবেও নির্বাচন করার জন্য, তা সে যত কম মানুষই ভোটই দিন না কেন। তাঁর দর্শন যে একেবারে সঠিক ছিল, তার প্রমাণ, নির্বাচনের পর এই সব রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রশমনের রাস্তা প্রশস্ত হয় এবং পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়। অনেকেই হয়ত জানেন না যে, শ্রী নরসিমা রাও নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদি সংগঠনগুলির সঙ্গে আলোচনার পরিবেশ তৈরি করেন। ১৯৯৫ সালের জুন মাসে তিনি নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদি নেতা মুইভা ও আইজাক সু-এর সঙ্গে প্যারিসে বৈঠক করে সমঝোতার রাস্তা খোঁজার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার আগেই নাগা সমস্যাকে আইন ও নিরাপত্তার সমস্যা হিসাবে দেখা শুরু হয়। রাও কিন্তু নাগা নেতাদের দাবি অনুযায়ী এই নাগা সমস্যাকে রাজনৈতিক হিসাবে মেনে নিয়ে আলোচনার জন্য আহ্বান করেছিলেন। তাঁর এই প্রচেষ্টার ফলেই ১৯৯৭ সালের অগস্টে সংঘর্ষবিরতি চুক্তি বাস্তবায়িত হয় এবং রাজনৈতিক আলোচনা শুরু হয়। এর ফলেই নাগাল্যান্ড এবং নাগা অধ্যুষিত উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন অঞ্চলে শান্তি ফিরে আসে।
সম্ভবত নরসিমা রাও একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যাঁর বিরুদ্ধে একাধিক ফৌজদারি মামলা করে হেনস্থা করা হয়। এই সব মামলা তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় এবং তাঁর পদ ছাড়ার অব্যবহতি পরে দায়ের হয়। এই সব তদন্ত প্রক্রিয়া বহু বছর ধরে চলে এবং এর ফলে এক সময় তিনি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল JMM দুর্নীতি মামলা, যা ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত চলেছিল, সেন্ট কিটস মামলা এবং লাখুভাই পাঠান মামলা। এই সব মামলা থেকেই শেষ পর্যন্ত অবশ্য তিনি বেকসুর রেহাই পান। এই সব মামলাই ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। জৈন ডায়েরি (জৈন হাওয়ালা মামলা)-র ভিত্তিতে বহু কংগ্রেস নেতা ও কয়েক জন বিরোধী নেতার বিরুদ্ধে তিনি সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়ায় অনেকেই তাঁর উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। কিন্তু এ ছাড়া তাঁর হাতে আর কোনও বিকল্প পথও ছিল না কারণ সুপ্রিম কোর্ট এই বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল এবং প্রতি সপ্তাহে তদন্তের অগ্রগতির উপর কড়া নজর রাখছিল। এটা খুবই দুর্ভাগ্যের বিষয় ছিল যে, তাঁর নিজের দলেরই কয়েক জন তাঁর প্রতি সদয় ছিলেন না। ১৯৯৬ সালের মে মাসে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন। তিনি এর পর প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট সরকারি বাসভবনে থাকতে শুরু করেন। আমিও দিল্লিতে থেকে যাই এবং মাঝেমধ্যেই তাঁর সঙ্গে তাঁর বাসভবনে গিয়ে দেখা করে আসতাম। সেই মহান ব্যক্তি তখন একেবারেই নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছিলেন এবং নিজের লেখালিখি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।
এ বার সময় এসেছে এই মহান ব্যক্তিত্বকে ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত করার। নটবর সিংহ এক বার নরসিমা রাও সম্পর্কে লিখেছিলেন, “ভারতের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক হৃদয়ের সঙ্গে তিনি গভীর ভাবে যুক্ত। ভারতকে খুঁজে পাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই তাঁর।”