মাঁঝি -- দ্য মাউন্টেন ম্যান । মনে রাখার মতো একটি সিনেমা । নওয়াজ়উদ্দিন সিদ্দিকির গায়ে কাঁটা দেওয়া অভিনয় । 2015 সালে মুক্তি পেয়েছিল সিনেমাটি । বিহারের বাসিন্দা দশরথ মাঁঝির জীবন কাহিনি জায়গা করে নিয়েছে সেলুলয়েডের পর্দায় । পাহাড় কেটে রাস্তা বানিয়েছিলেন তিনি ।
এবার আরও এক দশরথ মাঁঝির খোঁজ মিলল । নাম লাউঙ্গি ভূঁইঞা । ইনিও বিহারের । গয়ার লাহথুয়ার কোঠিলওয়ায় বাড়ি । চাষের জমিতে জলের সমস্যা । তাই নিজেই তিন কিলোমিটার লম্বা একটি খাল কেটে ফেলেছেন ।
বিহারের কোঠিলওয়া । গয়া শহর থেকে প্রায় আশি কিলোমিটারের রাস্তা । চারিদিকে ঘন জঙ্গল । আর ছোটো ছোটো টিলা । শোনা যায়, ঘন জঙ্গল ও টিলায় ঘেরা এই গ্রামেই নাকি একসময় আশ্রয় নিত মাওবাদীরা । গ্রামটির সমস্যা একটাই । কোনও মরশুমেই জল থাকে না ঠিক মতো । কয়েক বছর আগে পর্যন্তও এই সমস্যা ছিল গ্রামে ।
কিন্তু এখন যদি কেউ কোঠিলওয়ায় যান, তবে পুরো আলাদা ছবি চোখে পড়বে । চাষের ক্ষেতগুলিতে পুরোদমে কাজ চলছে । জলের সে সমস্যাও আর নেই । গ্রাম ঘুরে দেখলেই চোখে পড়বে একটি খাল । খাল চলে গেছে দূরের পাহাড়ি ঢিবির দিকে । সেদিক থেকেই খাল দিয়ে জল ঢুকছে গ্রামে ।
এই খাল কিন্তু সরকারের কাটানো খাল নয় । খাল কেটেছেন গ্রামেরই একজন । লাউঙ্গি ভূঁইঞা । বৃদ্ধ । শীর্ণকায় চেহারা । অথচ খালটি তিন কিলোমিটার লম্বা । আর এই গোটা খালটি তিনি কি না একাই কেটেছেন !
ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছেন, গ্রামের কৃষকরা চাষ করার সময় ঠিকঠাক জল পান না । চরম সমস্যার মধ্যে দিন কাটছিল কৃষকদের । আর সেই দেখে লাউঙ্গি নিজেই নেমে পড়েন এর সমাধান খোঁজার জন্য । মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নেন । যেভাবেই হোক, গ্রামে জলের ব্যবস্থা করতেই হবে ।
গ্রামের থেকে কিছু দূরে একটি উচুঁ পাহাড়ি টিলা রয়েছে । বর্ষার জল সেই টিলার ঢাল বেয়ে নিচে গড়িয়ে নামে । নদীতে গিয়ে মেশে । সেই জল কি নদীতে মেশার আগে কোনওভাবে গ্রামে নিয়ে আসা যায় ! ভাবতে শুরু করেন তিনি । ব্যাস । যেমন ভাবা, তেমনি কাজ । ঠিক করে ফেলেন, পাহাড়ের ওই জল খাল কেটে গ্রামে নিয়ে আসবেন । কোদাল কাঁধে নেমে পড়েন খাল কাটার কাজে ।
তখন কেউ ভাবতেও পারেননি লাউঙ্গি এই অসাধ্য সাধন করতে পারবেন । কেউ সাহায্যের জন্যও এগিয়ে আসেনি । সবাই নিজের নিজের কাজে শহরে চলে যেতেন । কিন্তু লাউঙ্গি ছিলেন একরোখা । গ্রামে জলের ব্যবস্থা তাঁকে করতেই হবে, যেভাবেই হোক । তাই সবাই নিজের নিজের কাজে চলে গেলেও লাউঙ্গি গ্রামেই থেকে যেতেন । সকালে ঘুম থেকে উঠে জঙ্গলে গরু চরাতে দিয়ে, খাল কাটার কাজে লেগে পড়তেন । বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদের তেজও বাড়ত । গা পুড়ে যেত । কিন্তু কোনওদিনও হাল ছাড়েননি । এটাই ছিল তাঁর রোজকার রুটিন ।
একা একা একটা গোটা খাল কাটা মুখের কথা নয় । রোজ একটু একটু করে কাটতেন । তিরিশ বছর ধরে এভাবে একটু একটু করে মাটি কাটতে কাটতে তৈরি করে ফেলেছেন তিন কিলোমিটার দীর্ঘ খাল । মনে মনে তিনি যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তা পূরণ করেছেন । আজ আর কোঠিলওয়ায় জলের কোনও সমস্যা নেই । লাউঙ্গির দীর্ঘ তিরিশ বছরের পরিশ্রমের ফল পাচ্ছেন আজ এই গ্রামের মানুষরা ।