দিল্লিতে ভোটের দামামা বেজে গেছে। দিল্লির আকাশে বাতাসে এখন ভোটের গন্ধ । এবারের ভোটে আম আদমি পার্টি ফের একবার ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে অনেকটাই নিশ্চিত । BJP একমাত্র আম আদমি পার্টিকে কিছুটা চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে, কিন্তু তাও তারা AAP-এর থেকে অনেকটাই পিছনের সারিতে রয়েছে । অন্যদিকে, দিল্লিতে 15 বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেসের বর্তমান অবস্থা তথৈবচ । 2015 সালের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের বিপুল ভরাডুবি হয়েছে সেই ক্ষত তারা এখনও পুরোপুরি পূরণ করতে পারেনি । যে সকল সাংবাদিক দিল্লির প্রতিটা রাজনৈতিক দলের হৃদস্পন্দন বুঝতে পারেন তারা স্পষ্ট করেছেন এবারের ভোটে নিঃসন্দেহে বেশ খানিকটা এগিয়ে রয়েছে আম আদমি পার্টি । 2019 সালের লোকসভা নির্বাচনে দিল্লিতে অত্যন্ত খারাপ ফল করেছিল আম আদমি পার্টি । কিন্তু সেই অবস্থা তারা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে । অন্যদিকে, 2019-এর লোকসভা নির্বাচনে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছিল BJP । সাতটার মধ্যে সাতটা আসনই গেরুয়া শিবির নিজেদের দখলে নিয়েছিল, অন্যদিকে শতাংশ হিসেবে BJP-র দখলে ছিল 57 শতাংশ ভোট । কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পালটে গেছে । দিল্লির সচেতন ভোটাররা উপলব্ধি করেছেন বিধানসভা নির্বাচনে আম আদমি পার্টিকে ভোট দেওয়াই যুক্তিসংগত । লোকসভায় অভাবনীয় সাফল্য পেলেও BJP কিন্তু আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে অনেকটাই ব্যাকফুটে । অনেক সাধারণ ভোটার মনে করেন, কেন্দ্রে যে রাজনৈতিক দল সরকার গড়েছে বিধানসভা নির্বাচনের তার থেকে বেশ খানিকটা দূরত্ব বজায় রাখাই যুক্তিসঙ্গত ।
কেন দিল্লিতে আম আদমি পার্টির জনপ্রিয়তা এত বেশি ?
এ প্রসঙ্গে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মন্ত্রিসভার অভাবনীয় সাফল্যের কথা তুলে ধরতে হয় । কেজরিওয়াল সরকার শিক্ষা-স্বাস্থ্যর মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিকে ঢেলে সাজিয়েছে । এখন রাজধানী শহর থেকে একজন দরিদ্র মানুষও বিনা চিকিৎসায় বাড়ি ফিরে আসেন না । এর পুরো কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল । মুখ্যমন্ত্রীর এই ভূমিকা তাঁকে পৃথক করেছে BJP-র থেকে, বহুগুণ জনপ্রিয় করে তুলেছে কংগ্রেসের যে কোনও মুখ্যমন্ত্রীর থেকে ।
2014 এবং 2019 সালের লোকসভা নির্বাচন আম আদমি পার্টি দিল্লিতে তেমন কোনও সুবিধা করতে পারেনি । কিন্তু দিল্লির প্রতিটি ভোটারের কাছে বিধানসভা ভোটের নিরিখে সবার আগে রয়েছে এই আম আদমি পার্টি । 2013 বিধানসভা নির্বাচনে AAP কিন্তু একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি । তারা 28 টি আসনে 29.5 শতাংশ ভোট পেয়েছিল কিন্তু মাত্র বছর খানেক বাদে 2015 সালের বিধানসভা নির্বাচনে আম আদমি পার্টি দিল্লিতে এক ইতিহাস তৈরি করে । মোট 70 টি বিধানসভা আসনের মধ্যে আম আদমি পার্টি 67 টি আসন দখল করে । শতকরা হিসেবে যা ছিল 5 4.3 শতাংশ ।
এবারের দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে BJP তাদের প্রচারের বিভিন্ন জাতীয় ইশু তুলে ধরছে বারবার । প্রচারে তারা গুরুত্ব দিচ্ছে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাস কে, 70 ধারা তুলে নেওয়া কে, অযোধ্যা রাম মন্দির নির্মাণ এবং তিন তালাকের মত বিষয়গুলিকে । কিন্তু বিধানসভা নির্বাচন সব সময় হয়ে থাকে রাজ্যের স্থানীয় ইশুকে কেন্দ্র করে । জাতীয় বিষয়গুলি সাধারণ মানুষের কাছে বিধানসভা নির্বাচনে খুব একটা বড় প্রভাব ফেলতে পারে না । BJP যেখানে জাতীয় বিষয়গুলিকে হাতিয়ার করে ভোটে লড়াইয়ের চেষ্টা করছে সেখানে APP রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিকে তুলে ধরছে এবং গত পাঁচ বছরে রাজ্যের উন্নয়নে তারা কী করেছে, কী কী গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ করা হয়েছে সেসব গুলিকে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসছে । সরকারের সাফল্যের দিকটা তুলে ধরছে বারবার । এ প্রসঙ্গে আমরা ঝাড়খণ্ড এবং হরিয়ানার বিধানসভা নির্বাচনের কথা বলতে পারি । এই দুই নির্বাচনে গুরুত্ব পেয়েছে স্থানীয় ইশু, আরও স্পষ্ট করে বললে রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইশুগুলো । জাতীয় বিষয়গুলি ভোটারদের উপর বিন্দুমাত্র প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি । আমার মনে হয় দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে সেখানকার প্রতিটি সাধারণ মানুষ রাজ্যের বিষয়গুলির দিকে যতটা নজর দেবেন তার বিন্দুমাত্র দেবেন না জাতীয় বিষয়গুলির উপর । রাজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কোন রাজনৈতিক দল কেমন ভূমিকা নিয়েছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ হবে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে ।
স্বাভাবিকভাবে দিল্লির জন্য কেজরিওয়ালের সরকার অভাবনীয় কাজ করেছে সেটাই আম আদমি পার্টিকে ভোটের লড়াইয়ে বেশ কয়েক পা এগিয়ে রাখছে । বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা গেছে দিল্লি সরকার রাজ্যের সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করে যেসব নীতি নির্ধারণ করেছে, যেসব নতুন আইন ব্যবস্থা চালু করেছে, যেসব নতুন নতুন পদক্ষেপ করেছে তার দ্বারা উপকৃত হয়েছেন প্রায় প্রতিটি সাধারণ মানুষ । সেটাই এবারের বিধানসভা নির্বাচনে বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করতে চলেছে বলেই মনে করা হচ্ছে । জাতীয় ইশুকে সামনে রেখে খুব কম সংখ্যক ভোটার ভোট দেবেন বলে প্রাথমিক সমীক্ষায় উঠে আসছে । বিভিন্ন সংগঠন যে সমীক্ষা চালিয়েছে তাতে দেখা গেছেসাধারণ ভোটাররা আম আদমি পার্টি দিল্লির জন্য কী পদক্ষেপ করেছে সেটা যতটা গুরুত্ব দিয়েছে তার থেকে খুব কম গুরুত্ব দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কেন্দ্র থেকে কী নতুন নতুন পদক্ষেপ করেছেন সেটি । এই হিসেবে আম আদমি পার্টি দিল্লির জন্য কী কাজ করেছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে 55 শতাংশ মানুষের কাছে বা প্রতি দুজনের মধ্যে একজনের কাছে । সেখানে মোদি সরকার কেন্দ্রে থেকে কী পদক্ষেপ করেছে গুরুত্ব পেয়েছে মাত্র 15 শতাংশ মানুষের কাছে ।
CSDS- এর মত সংস্থা দিল্লির ভোটের আগে সমীক্ষা চালিয়ে যে তথ্য সামনে এনেছে তাতে দেখা গেছে, আম আদমি পার্টিকে অত্যন্ত বিশ্বস্ত বলে মনে করেন রাজ্যের অধিকাংশ মানুষ । সেখানে BJP সরকারকে তেমনভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় না । কেন্দ্রে BJP সরকার কী গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ করেছে বা সাধারণ মানুষের জন্য কী কী নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা হরিয়ানা-ঝাড়খণ্ড রাজ্যের ভোটে বিন্দুমাত্র প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি । তথ্য বলছে আম আদমি পার্টির যে বিপুল জনপ্রিয়তা রয়েছে তার বিন্দুমাত্র নেই কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকা BJP সরকারের । শেষ ছ'মাসে দিল্লিতে আম আদমি পার্টির জনপ্রিয়তা যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যেভাবে তারা নিজেদেরকে আরও শক্তিশালী করেছে তার বিন্দুমাত্র দেখা যায়নি মোদি নেতৃত্বাধীন BJP-র কাছ থেকে ।
তবে আম আদমি পার্টির কাছে সমস্যা হচ্ছে বিরোধী হাওয়া । ক্ষমতাসীন সরকারের কাছে সব সময় বিরোধী হাওয়া একটা বড় সমস্যা । পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকা আম আদমি পার্টির সরকারের বিরুদ্ধে স্বাভাবিকভাবেই একটা বিরোধী জনমত গড়ে উঠেছে । একই কথা বলা যায় কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন BJP সরকারের ক্ষেত্রেও । পরপর দু'বার ক্ষমতায় আসা নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিরুদ্ধে একটি বিরোধী জনমত গড়ে উঠেছে । বিষয়টি ব্যাখ্যা করার জন্য আমরা হরিয়ানার উদাহরণ দিতে পারি । 2019 সালের লোকসভা নির্বাচনে হরিয়ানায় 58 শতাংশ ভোট পেয়েছিল BJP । কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনে কাট্টার সরকারকে ভোট দিতে মানুষ অস্বীকার করেন । একই ছবি ধরা পড়েছে ঝাড়খণ্ডের ক্ষেত্রেও । ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা এবং কংগ্রেসের মিলিত জোটের কাছে আটকে যেতে হয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টিকে । কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকা BJP সরকার ঝাড়খনণ্ড ভোটের আগের কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরার চেষ্টা করেছিল । কিন্তু তা কোনও প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি সে রাজ্যের সাধারণ মানুষের মনে । রঘুবর দাসের বিপুল জনপ্রিয়তা রাজ্যের BJP-র পরাজয়কেই যেন সুনিশ্চিত করে তুলেছিল । এই একই কথা বলা যায় রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ের ক্ষেত্রেও । এই তিন রাজ্য মোদি ঝড় তেমনভাবে কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি । এইসব বিষয়গুলোর দিকে নজর রাখলে নিঃসন্দেহে বলা যায় আম আদমি পার্টির সরকার দিল্লি ভোট নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত নয়, কারণ তারা খুব সহজেই জয় পাবে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ।
এই প্রেক্ষিতে আরও একটা বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া যাক । সাম্প্রতিক অতীতে বিভিন্ন ভোটের ক্ষেত্রে একটা গতিধারা লক্ষ্য করা গেছে । দেখা গেছে কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের থেকে ভোটের বাজারে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ব্যক্তিবিশেষের ভূমিকা । যেমন আম আদমি পার্টির সরকারের থেকে মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের জনপ্রিয়তা বহুগুণ বেশি । দিল্লিতে BJP-র একাধিক নেতা রয়েছেন কিন্তু অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মত জনপ্রিয়তার আর কোনও নেতার নেই । এক্ষেত্রে আমরা লোকসভা নির্বাচনের উদাহরণ দিতে পারি । ভারতীয় জনতা পার্টি গত দু'টি লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করে, তাঁকেই মুখ করে নির্বাচনে লড়াই করেছিল । ব্যক্তি বিশেষের সেই ভূমিকাই BJP-কে পরপর দু'বার লোকসভা নির্বাচনে জয় এনে দিয়েছে । একই কথা দিল্লি নির্বাচনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য । এখানে মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের জনপ্রিয়তা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির থেকেও বহুগুণ বেশি । দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিটি সাধারণ মানুষের কাছে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রহণযোগ্যতা যত বেশি তার ধারে কাছে জাতীয় স্তরে শুধু নয় রাজ্যস্তরের কোনও নেতার জনপ্রিয়তাও নেই ।
আগামী 4 ফেব্রুয়ারি দিল্লি বিধানসভা নির্বাচন । এখনও এক সপ্তাহের বেশি সময় রয়েছে । শেষ মুহূর্তের প্রচারে প্রতিটি রাজনৈতিক দলই মরণ কামড় দিতে প্রস্তুত । জোর কদমে প্রচার চলছে । তবে স্থানীয় ইশু, মানুষের প্রতিটি সমস্যার কথা তুলে ধরে এবং তার সমাধানের দিশা দেখিয়ে আম আদমি পার্টি নিজেদের ভোট ব্যাংকে যতটা মজবুত করতে পেরেছে অন্যান্য রাজনৈতিক দল ততটা পারেনি । এইজন্যই দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে আম আদমি পার্টিকে এগিয়ে রাখতে হচ্ছে ।
সঞ্জয় কুমার
অধ্যাপক, CSDS (সেন্টার ফর স্টাডি অফ ডেভেলপিং সোসাইটিস)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত