লাল জল । দূর থেকে একঝলক দেখলে এমনই লাগে এই হ্রদের জল । যত কাছে যাবেন, কেমন একটা গা ছমছমে ভাব । নিস্তব্ধ । জনপ্রাণী নেই । এ যেন অন্য কোনও এক পৃথিবী । আর একটু এগোতেই যা চোখে পড়বে, তা না চাক্ষুস করলে বিশ্বাস করা কঠিন । হ্রদের জল থেকে মুখ উঁচিয়ে রয়েছে একটি গাছের ডাল । ডালের উপর বসে রয়েছে একটি পাখি । কিন্তু কোনও নড়াচড়া নেই । অবয়ব আছে । চোখ আছে । ডানা আছে । কিন্তু প্রাণ নেই । একেবারে নিথর ।
শুধু একটি পাখি নয় । এমন আরও রয়েছে । হ্রদের জলে বা আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গাছের ডালগুলির দিকে চোখ পড়লে আতকে উঠতে হবে । কোথাও হাঁস । কোথাও ঈগল । কোথাও বাদুড় । কোথাও আবার অন্য কোনও নাম না জানা পাখি । সবই রয়েছে । ঠিক আসল পাখির মতোই । কিন্তু প্রাণের লেশমাত্র নেই । বছরের পর বছর ধরে এভাবেই মমির মতো হয়ে রয়েছে । এ যেন এক মৃত্যু উপত্যকা । যেন অদৃশ্য কোনও জাদু রয়েছে এই হ্রদের জলে ।
আফ্রিকা মহাদেশের তানজ়ানিয়া । তার উত্তরের দিকে পাহাড়ি ঘেরাটোপে লুকিয়ে রয়েছে এই হ্রদ । নাম ন্যাট্রন হ্রদ । লাল রঙের জল । এই অস্বাভাবিক রঙের কারণে আপনি আকৃষ্ট হতেই পারেন । কিন্তু হ্রদের জলে একবার ছুঁলেই শেষ । অবয়ব তো থেকে যায় । কিন্তু তাতে আর কোনও প্রাণ অবশিষ্ট থাকে না । খুব অল্প সংখ্যক কিছু প্রাণীই বাঁচতে পারে এই হ্রদের জলে ।
কিন্তু কেন এখানে বেশিরভাগ প্রাণী থাকতে পারে না? এই প্রাণহীন অবয়বগুলির রহস্য কী ?
সব উত্তর লুকিয়ে রয়েছে এই হ্রদে লাল জলে । এই ন্যাট্রন হ্রদ আদতে একটি লবণাক্ত জলের হ্রদ । এই হ্রদে জল প্রবেশ তো করে, কিন্তু জল বেরোনোর কোনও পথ নেই । সূর্যের আলোয় যেটুকু জল বাষ্পীভূত হয়, সেটাই একমাত্র উপায় । এখানে বছরে 500 মিলিমিটারের কম বৃষ্টি হয় । আর বাষ্পীভূত হয় তার থেকে অনেক বেশি । দীর্ঘদিন ধরে এভাবে জল বাষ্পীভূত হতে হতে হ্রদের জলে লবণ ও অন্য খনিজের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে যায় ।
আর এই জলে রয়েছে ন্যাট্রন নামের এক ধরনের রায়ায়নিক । সেই থেকেই হ্রদের নাম ন্যাট্রন । ন্যাট্রন হল আসলে সোডিয়াম কার্বোনেট ও বেকিং সোডার মিশ্রণ । আর এরজন্য হ্রদের জল অত্যাধিক ক্ষারীয় । pH প্রায় 10.5 এর কাছাকাছি, যা কি না অ্যামোনিয়ার প্রায় সমান ।
জলের তাপমাত্রা কোনও কোনও সময়ে 140 ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্তও পৌঁছে যায় ।
হ্রদের জলের এই অস্বাভাবিক আচরণের পিছনে রয়েছে আরও একটি কারণ । ন্যাট্রন হ্রদ থেকে মাত্র 20 কিলোমিটার দক্ষিণেই রয়েছে আগ্নেয়গিরি । এখান থেকে সোডিয়াম কার্বোনেট ও ক্যালসিয়াম কার্বোনেট হ্রদের জলে মেশে ।
এই ধরনে মাত্রাতিরিক্ত গরম, লবণাক্ত ভাব ও ক্ষারীয় পরিবেশের কারণে হাতে গোনা কিছু জীবই থাকতে পারে এখানে । ন্যাট্রন তেলাপিয়া । কিছু অ্যালগি । আর এক প্রজাতির ফ্ল্যামিঙ্গো । এছাড়া আর কোনও প্রাণীই বাঁচতে পারে না এই মৃত্যু উপত্যকায় । হ্রদের আশেপাশে ওই নিথর অবয়বগুলি তারই প্রমাণ ।
তাই পাহাড়ি ঘেরাটোপের মধ্যে এই ন্যাট্রন হ্রদ আপনাকে যতই আকৃষ্ট করুক, হ্রদের জলে যেন কখনও ভুলেও পা দিতে যাবেন না ।