সুপ্রিম কোর্ট দেশের খনি অঞ্চলগুলিকে লিজ় দেওয়ার ক্ষেত্রে সবুজায়নের জন্য বিশেষ নির্দেশ দিয়েছে । এই নির্দেশ অনুসারে কোনও খনি অঞ্চলকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করার পর সেটিকে সঠিকভাবে ভরাট করে সেই এলাকায় নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সবুজায়ন করতে হবে । শীর্ষ আদালতের এই নির্দেশকে অবশ্যই সমস্ত পরিবেশ সচেতন ভারতীয়র স্বাগত জানানো উচিত । কিন্তু এটাও দেখার যে, সঠিকভাবে যেন সবুজায়ন হয় । কারণ সঠিক পদ্ধতি মেনে সবুজায়ন না হলে তাতে উলটে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি ।
সভ্যতার সেই আদিকাল থেকে ভূগর্ভ থেকে বিভিন্ন খনিজ পদার্থ উত্তোলনের কাজ চলছে । আফ্রিকায় এমন কিছু খনির সন্ধান পাওয়া গেছে যেগুলোর বয়স প্রায় 43 হাজার বছর । কিন্তু, সভ্যতার আদিকালে মানুষ প্রকৃতির কোনও ক্ষতি না করে খনিজ পদার্থ উত্তোলন করত । সেজন্য তারা নিজেদের হাত ও পাথরের সরঞ্জাম ব্যবহার করত । এটা ঘটনা যে, খনিজ পদার্থ সভ্যতার উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় । কিন্তু, আদিকালের মানুষের মতো আমরাও যদি প্রকৃতির ক্ষতি না করে ভূগর্ভ থেকে খনিজ পদার্থ উত্তোলন করি, তবে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি এড়ানো সম্ভব ।
আমাদের পূর্বপুরুষদের ব্যবহৃত পাথরের সরঞ্জামের তুলনায় এখন খনিতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আকারে ও ক্ষমতায় অনেক বড় ও শক্তিশালী । সেগুলির ক্ষমতা এতটাই বেশি যে, সেগুলির সাহায্যে আমরা খুব সহজেই পাহাড় কেটে ফেলতে পারি বা ভূগর্ভের অনেক নিচ থেকে খনিজ তুলে আনতে পারি । প্রযুক্তিগতভাবে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে গেছি ঠিকই, কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে কাজ করার ক্ষেত্রে আমরা কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষদের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছি । তাই শীর্ষ আদালতের এই নির্দেশকে অবশ্যই আমাদের স্বাগত জানানো উচিত । কারণ, এই নির্দেশ যদি আমরা ঠিক মতো পালন করি, তাহলে দেশ পরিবেশ রক্ষায় সঠিক পথে এগোতে পারবে ।
কিন্তু প্রথমে যেটা বলার তা হল, শীর্ষ আদালতের এই নির্দেশ পালন করতে হলে আমাদের প্রয়োজন সঠিক পদ্ধতিতে সেই কাজ করা । ভারতে কয়লা থেকে বক্সাইট- বিভিন্ন ধরনের খনি রয়েছে । সেগুলির মধ্যে অনেকগুলি গভীর খনি, কিছু আবার অগভীর খনি । তাই পরিবেশ রক্ষার কাজটি যদি সঠিকভাবে করতে হয়, তবে সবুজায়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের খনির ক্ষেত্রে বিভিন্ন নিয়ম মেনে চলতে হবে । বিভিন্ন ধরনের খনিজের জন্য খনি অঞ্চলের মাটিতে বিভিন্ন প্রকার ক্ষতিকর 'রাসায়নিক অবশেষ' (টক্সিক ওয়েস্ট) থেকে যায়, যা সেই অঞ্চলের মাটি ও জলের উৎসের ক্ষতি করে । ভূমির সবচেয়ে উপরের যে স্তর, যা গাছের বেড়ে ওঠার তথা পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয়, সেই স্তরটি এই ধরনের রাসায়নিক অবশেষের জেরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় । যে দেশগুলি পরিবেশ রক্ষায় বেশি গুরুত্ব দেয়, সেখানে খনি থেকে খনিজ উত্তোলনের সময় যে মাটি তোলা হয়, তা নষ্ট না করে অন্যত্র জমিয়ে রাখা হয় । পরে খনি পরিত্যক্ত ঘোষণা হলে সেই মাটি দিয়ে খনিটি ফের ভরাট করা হয় । তবে সেটা অন্য প্রসঙ্গ, যা নিয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে ।
কোনও এলাকায় খনির কাজ হলে সেখানে ভূমির উপরের স্তরটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় । তাই সেই এলাকায় সবুজায়নের জন্য অনেক বেশি পরিশ্রম ও পরিকল্পনা প্রয়োজন । খনি এলাকায় মাটিতে গাছের পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় পদার্থের (নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম) পরিমাণ অনেকটাই কমে যায় । তার জেরে সবুজায়নে সমস্যা হয় । তা ছাড়া ওই এলাকায় মাটির জলধারণ ক্ষমতাও কমে যায় । আরও একটি সমস্যা হল, খনি এলাকার মাটিতে অ্যাসিড-ক্ষার মাত্রা (pH লেভেল)-র সামঞ্জস্য একেবারেই ঠিক থাকে না । এছাড়া সেই এলাকার মাটিতে থাকে প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন ভারি ধাতু । এসবের জেরে গাছের জন্য প্রয়োজনীয় জীবাণু (মাইক্রো অর্গানিজ়ম) ওই মাটিতে বাঁচতে পারে না । এই সমস্ত কারণে খনি এলাকায় সবুজায়নে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় । কয়লাখনি অঞ্চলগুলিতে মাটিতে লবণের পরিমাণ কমে যায় এবং মাটি ভঙ্গুর হয়ে পড়ে - যা সবুজায়নের ক্ষেত্রে অন্যতম সমস্যা ।
এই লেখায় আগেই বলেছি যে, খনি এলাকায় সবুজায়নের ক্ষেত্রে শীর্ষ আদালতের নির্দেশ যদি ঠিক মতো পালিত হয়, তবে সঠিকভাবে সবুজায়ন সম্ভব হবে । আর যদি তা নয়, তবে সবুজায়নের নামে আগাছার বাড়বাড়ন্ত হবে আর সেক্ষেত্রে ওই এলাকার মাটি তার উর্বরতা আরও হারাবে । তাই খনি এলাকায় কীভাবে সবুজায়ন করা হবে, তা নিয়ে সঠিক পথ নির্দেশ করার জন্য শীর্ষ আদালতের তরফে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে দিলে ভালো হয় । কোন রাজ্যের কোন খনি এলাকায় সবুজায়ন কীভাবে হবে, সেই বিষয়ে সঠিক পদ্ধতি বাতলে দিতে সেখানকার ভূবৈচিত্র, পরিবেশ, কোন ধরনের গাছপালা সেখানে বেশি হয় - এই বিষয়গুলি মাথায় রেখে বিশেষজ্ঞ কমিটির কাজ করা উচিত । এই কমিটিতে অবশ্যই স্থানীয় বাসিন্দা বা সেখানকার আদিবাসীদের রাখা উচিত । কারণ, তাদের সঙ্গে সেই এলাকায় প্রকৃতি ও পরিবেশের নিবিড় যোগ রয়েছে । তাই সেখানে সবুজায়নের ক্ষেত্রে তাদের পরামর্শকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত ।
কোনও খনি এলাকায় সবুজায়নের ক্ষেত্রে শীর্ষ আদালত ও বিশেষজ্ঞ কমিটির অবশ্যই দেখা উচিত যে, স্থানীয় গাছপালা অর্থাৎ স্থানীয় উদ্ভিদের বৈচিত্র্যকে যেন গুরুত্ব দেওয়া হয় । সবুজায়নের ক্ষেত্রে ওই এলাকায় সেভাবে হয় না এমন গাছপালাকে যেন গুরুত্ব না দেওয়া হয় । খনি এলাকায় সবুজায়ন বিভিন্নভাবে হতে পারে, তবে স্থানীয় পরিবেশের কথা মাথায় রেখে সেখানে বনসৃজনের জন্য ন্যূনতম 50 শতাংশ এলাকায় স্থানীয় গাছপালাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত । পাশাপাশি ওই এলাকায় বনসৃজনের ক্ষেত্রে 10 শতাংশ জমিকে আলাদা করে সেখানে স্থানীয় বিপন্ন প্রজাতির বৃক্ষরোপণে গুরুত্ব দেওয়া উচিত । পরিবেশ রক্ষায় স্থানীয় উদ্ভিদ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় । তাই খনি এলাকায় বৃক্ষরোপণের ক্ষেত্রে সেই বিষয়টিতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন । যে সমস্ত উদ্ভিদের পাতা বড়, বনসৃজনে সেগুলিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত । কারণ, ওই ধরনের উদ্ভিদ মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে । এইভাবে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলিকে গুরুত্ব দিয়ে খনি এলাকায় বনসৃজন করলে সেখানে পরিবেশ তথা জৈববৈচিত্র্য রক্ষার কাজটি অনেকটাই ঠিকভাবে করা সম্ভব । এক্ষেত্রে খনি কম্পানিগুলি আদিকালের 'হাম্মুরাবি' পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারে । এই পদ্ধতির মূল কথা হল 'অরণ্যকে অরণ্য ফিরিয়ে দাও' । স্থানীয় বাসিন্দারা পরিবেশ রক্ষায় এই পদ্ধতি মূলত অনুসরণ করে । পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায় তারা জনপ্রিয় 'মিয়াওয়াকি' পদ্ধতিও অনুসরণ করে ।
বনসৃজনের ক্ষেত্রে কৃষি ও বাস্তুতন্ত্রের কথা মাথায় রাখা উচিত, যাতে মাটিতে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ না মেশে । বৃক্ষরোপণ এমনভাবে করা উচিত, যাতে সেই এলাকায় পরিবেশ পশুপাখিদের জীবনধারণের চাহিদা মেটায় । পাশাপাশি ঔষধি গাছ রোপণে গুরুত্ব দেওয়া উচিত, যাতে স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি জীবজগতের অন্যান্য প্রাণীদেরও উপকার হয় । কোনও এলাকায় বনসৃজনের ক্ষেত্রে প্রথম ধাপে বিভিন্ন প্রজাতির ঘাস রোপণ করা উচিত, তাহলে পরবর্তী পর্যায়ে ওই এলাকায় বনসৃজনের কাজটি সুবিধাজনক হয় ।
শীর্ষ আদালতের নির্দেশ অনুসারে কম্পানিগুলিকে বনসৃজন প্রকল্পের জন্য 'জৈববৈচিত্র্য আধিকারিক' বা 'পরিবেশ সংরক্ষক আধিকারিক'-দের দিয়ে কাজ করতে হবে । তা ছাড়া এই প্রকল্পের পরিকল্পনা তৈরি করাতে হবে বাইরের কোনও সংস্থাকে (থার্ড পার্টি) দিয়ে । যদি প্রকল্পের কাজে কম্পানির তরফে কোনও গাফিলতি হয়, সেক্ষেত্রে জরিমানার কড়া নিয়ম থাকা প্রয়োজন । তবে একইসঙ্গে কম্পানির স্বার্থের কথা মাথায় রেখে CSR কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাদের এই প্রকল্পে আংশিক অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া উচিত ।
ভূমিক্ষয় গোটা দেশের সমস্যা । তবে যে এলাকায় ভূমিক্ষয় হয়, সেই এলাকার বাসিন্দারা এর জেরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় । কারণ, ভূমিক্ষয়ের ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকা ও বাসস্থানের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে । আশা করা যায়, শীর্ষ আদালতের নির্দেশ সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি সেই পরিবেশের মাধ্যমে স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনধারণের নতুন সুযোগ তৈরি করবে । যখন কোনও এলাকায় এভাবে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে বনসৃজন হবে তখন সেই এলাকার বাসিন্দারা ফের তাদের জীবন-জীবিকার জন্য অরণ্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারবে ।
আমাদের 'বসুধৈব কুটুম্বকম' নীতির কথাও মনে রাখা উচিত । মাটি, গাছ ও প্রাণিজগতের প্রতি আমাদের বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে । নিজেদের স্বার্থের জন্য পরিবেশের ক্রমাগত ক্ষতিসাধন করে চলেছি আমরা । ইতিমধ্যে, আমরা পরিবেশের যতটা ক্ষতি করেছি, তা মেরামত করার দায়িত্ব নেওয়ার সময় এসেছে । কারণ প্রকৃতির কাছে আমরা সন্তানের মতো । তার দান আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে । আমরা প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ ও জয় করার চেষ্টা করি এবং ভাবি যে, সেটা আমরা করতে পারব । আসলে প্রকৃতির উদারতা ও ধৈর্য্য আমাদের সেটা ভাবতে সাহায্য করে । কিন্তু একটা সময় প্রকৃতির সেই ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙবে । তাই প্রকৃতির ধৈর্য্যের পরীক্ষা নেওয়া উচিত নয় আমাদের ।