কী ভাবে একের পর এক ভুল করলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ?
ক্ষমতার কোনও অভাব নেই তাঁদের । বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে তাঁরা বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয় । তথাপি, একটা আণুবিক্ষণিক জীব সে দেশকে কাঁপিয়ে দিল । বিশ্বের মহাশক্তিধর দেশ একের পর এক ভুল করেই চলেছে । মহামারী সচেতনতা সূচক বা এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইন্ডেক্স-এ যে দেশ 83.5 নম্বর নিয়ে তালিকায় সবার উপরে, সেই অ্যামেরিকা COVID-19 কে সামলাতে চরম সমস্যায় ।
এই প্যানডেমিক নিয়ে বহু সতর্কতা ও ইঙ্গিত থাকলেও সংক্রমণ ঠেকাতে পারেনি মার্কিন প্রশাসন । বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অ্যামেরিকার এই ব্যর্থতার পিছনে রয়েছে অর্থনীতিতে মন্দা আসার ভয়, নিজেদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থাগুলিকে গুরুত্ব না দেওয়া । যিনি নিজেকে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির প্রেসিডেন্ট বলে ব্যাখ্যা করেছেন, সেই ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম থেকেই এই মারণ ভাইরাস নিয়ে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এবং তথ্যকে গুরুত্ব না দেওয়ার ভুল করেছেন । তাঁর এই গয়ংগচ্ছ মনোভাবেরই জন্যই খেসারত দিচ্ছে অ্যামেরিকা ।
কোরোনা সংক্রমণের জেরে বহু উন্নত দেশই হুমড়ি খেয়েছে । সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে অ্যামেরিকা, স্পেন, ইটালি এবং ফ্রান্সের উপর । বিশেষজ্ঞদের মতে, মার্কিন প্রশাসনের উপরমহলের গাছাড়া মনোভাব, পরীক্ষার কিট ও অন্য জিনিসপত্রের অভাব এবং ফেডেরাল ও রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে সমন্বয়ের অভাবেই এই সমস্যার অন্যতম কারণ । দক্ষিণ কোরিয়া যেখানে প্রতি 10 লাখ নাগরিকের মধ্যে 8 হাজারের পরীক্ষা করেছে, সেখানে অ্যামেরিকা গত সপ্তাহ পর্যন্ত করেছে মাত্র 3 হাজার তিনশো জনের। কোরোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য এখনও সে দেশে কোনও কেন্দ্রীয় নীতি তৈরি হয়নি । বহু মার্কিন রাজ্যে এখনও লকডাউন ঘোষণা হয়নি । জময়েত ও ভিড় নিয়ন্ত্রণে সরকার কোনও রকম ব্যবস্থা না নেওয়ায় ঝড়ের গতিতে সংক্রমণ ছড়িয়েছে । উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ফ্লোরিডায় সবেমাত্র গত সপ্তাহে লকডাউনের ঘোষণা হয়েছে ।
অতিমারীতে যখন মানুষ মরতে শুরু করল, তখন যুদ্ধকালীন ভিত্তিতে ট্রাম্প সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ করল । আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণার পাশাপাশি সরকার অন্য দেশ থেকে মাস্ক, ভেন্টিলেটর এবং ওষুধ আমদানি শুরু করল । বিভিন্ন জায়গায় সেনা মোতায়েন করা হল । নিউ ইয়র্কের মতো দেশের একাধিক ভাইরাস হটস্পটে পাঠানো হল সেনার 3 হাজার চিকিৎসক । সেনার ইঞ্জিনিয়াররা নিউ ইয়র্কের জাভিটস কনভেনশন সেন্টারকে দেশের অন্যতম বড় হাসপাতালে পরিণত করল । দেশের 18 টি রাজ্যে তৈরি হচ্ছে 22 টি অস্থায়ী হাসপাতাল । পরীক্ষা করার জন্য হাসপাতালগুলিতে শুরু হল ব্যস্ততা । সরকার জানালো, দেশ জুড়ে সরবরাহ করা হয়েছে 1 কোটি ১৭ লাখ N95 মাস্ক, 2 কোটি 65 লাখ সার্জিকাল মাস্ক, 44 লাখ সার্জিকাল গাউন, 23 লাখ ফেস মাস্ক এবং 2 কোটি 26 লাখ গ্লাভস । এই সব সামগ্রী বিভিন্ন দেশ থেকে সেনাবাহিনীর 20 টি বিমানে করে আনা হয়েছে।
যদিও ট্রাম্প প্রথম থেকেই তাঁদের ভুল পথে চালনা করার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছে। সমালোচকদের মতে, তিনি নিজেই চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তাকে পাত্তা দেননি । অ্যামেরিকায় প্রথম COVID-19 রোগীর অস্তিত্ব মেলে 21 জানুয়ারি । কোরোনা ভাইরাসের মূল কেন্দ্র উহানে চিন লকডাউন ঘোষণা করে 23 জানুয়ারি । তার ঠিক পরের দিনই ট্রাম্প দাবি করেন, অ্যামেরিকায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে । 28 ফেব্রুয়ারি COVID-19 এ আক্রান্ত হয়ে অ্যামেরিকায় প্রথম মৃত্যু হয় । যেহেতু সেই মৃত ব্যক্তির গোষ্ঠী সংক্রমণ হয়েছিল, তাই বিপদ ঘণ্টাটা তখনই বেজে গিয়েছিল । সেই সপ্তাহেই ট্রাম্প ঘোষণা করলেন যে, কোরোনা ভাইরাস আশ্চর্যজনক ভাবে অদৃশ্য হবে । 6 মার্চ লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের মহামারী বিশেষজ্ঞদের একটি দল সতর্ক করে জানায় যে, অ্যামেরিকা যদি সময়মতো পদক্ষেপ না করে, তা হলে দেশের 81 শতাংশ মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন । কিন্তু তখনও ট্রাম্প বলে চললেন যে, দেশ নিরাপদই থাকবে।
16 মার্চ ট্রাম্পের বিশেষ টাস্কফোর্স কোরোনা ভাইরাস রেসপন্স কো-অর্ডিনেটর ডেবোরা ব্রিক্স যখন একটি সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করলেন যে, একসঙ্গে 10 জনের বেশি মানুষ জমায়েত করতে পারবেন না, তখন তাঁর ঠিক পিছনে দাঁড়ানো ট্রাম্প ব্রিক্সের বক্তব্যের বিরোধিতা করলেন । তাঁর দাবি ছিল, অনেকগুলি মার্কিন রাজ্যে ভাইরাসের অস্তিত্ব মেলেনি । অথচ যখন পরবর্তীকালে দেশে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকল, তখন তিনি ঘোষণা করলেন যে, আমেরিকার যত সম্ভব নাগরিককে পরীক্ষা করা হবে । অথচ আগে থেকে প্রস্তুত না থাকায় প্রশাসনের কাছে তখন যথেষ্ট কিট ছিল না ।
2018 সালে হোয়াইট হাউসের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল ডাইরেক্টরেট ফর গ্লোবাল হেলথ সিকিউরিটি অ্যান্ড ডিফেন্স বাতিল করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প । এই ডাইরেক্টরেটের কাজ ছিল, পরবর্তী যে কোনও বড় সংক্রমণের জন্য দেশের নিজস্ব ক্ষমতার মধ্যে থেকে অ্যামেরিকাকে প্রস্তুত রাখা । প্রশাসনের বহু কর্তা চমকে গিয়েছিলেন ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তে । 1999 সালে গঠিত জন স্বাস্থ্যের আপৎকালীন ফান্ড বহু দিন ধরেই ফাঁকা। এক সময় সরকার থেকে বলা হয়েছিল যে, রাজ্যগুলিকে এই ফান্ড থেকে ওষুধ সরবরাহ করা সম্ভব নয় । 13 মার্চ যখন ট্রাম্প COVID-19-কে স্বাস্থ্যে জরুরি অবস্থা হিসাবে ঘোষণা করলেন, তখন তিনি রাজ্যগুলিকেই ওষুধ তৈরি করতে নির্দেশ দিলেন। স্বাস্থ্য ও মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিষেবার ফান্ড সংযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। এই পদক্ষেপ আপৎকালীন অর্থের ভান্ডারের আসল উদ্দেশ্যকে ক্ষতি করবে বলে সমালোচনাও হয়।
এক নজরে দেখে নেওয়া যাক আমেরিকার বিখ্যাত ব্যক্তিদের কিছু টুইট—
আমরা অদৃশ্য শত্রুর বিষয়ে রোজ শিখছি । এই প্রতিপক্ষ কঠিন ও স্মার্ট। কিন্তু আমরা আরও কঠিন ও আরও বেশি স্মার্ট। - ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এই ঘটনাকে অ্যামেরিকার ইতিহাসে শতাব্দির জঘন্যতম জনস্বাস্থ্য বিপর্যয় হিসাবে দেখা হবে । এই বিপর্যয়ের মূল কারণ হল প্রস্তুতির অভাব এবং কখন, কোথায় এবং কী ভাবে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ছে তা বোঝার অক্ষমতা । - এরিক টোপোল, অ্যামেরিকান কার্ডিওলজিস্ট ও জেনেটিসিস্ট ।
যে সব দেশ এই ভাইরাসের হুমকি আগে থেকে বুঝতে পেরেছিল এবং কিছু আত্মত্যাগ করেছিল, তাঁদের ক্ষতি কম হয়েছে । এই ক্ষেত্রে অ্যামেরিকা ব্যর্থ হয়েছে । এই প্যানডেমিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মার্কিন প্রশাসন 6-8 সপ্তাহ অপেক্ষা করেছিল । - জেরেমি কোনিডিক, সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্টের সিনিয়র পলিসি ফেলো ।
ট্রাম্প তাঁর কিছু অনুগামীকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয়েছেন ।তাই তাঁরা কোনওভাবেই কোরোনা ভাইরাস সংক্রান্ত কোনও পরামর্শের দিকে ঝুঁকছেন না । এমনকি এ বিষয়ে তাঁরা আশঙ্কাও করছেন না । - নাওমি ওরেসকেস, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিষয়ক ইতিহাসবিদ ।