নয়াদিল্লি, 31 অক্টোবর : শত ঝড়ঝাপটা বুকে নিয়েও দেশের অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিরোপা মাথায় নিয়ে সগৌরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় । এই প্রজন্মের মানুষ বিতর্ক দিয়ে জামিয়াকে চিনলেও, স্বাধীনতার 75 বছর পূর্তিতে নতুন ভাবে চেনা প্রয়োজন এই বিশ্ববিদ্যালয়কে । কারণ ইংরেজ বিরোধী বিপ্লবের সন্ধিক্ষণে জন্ম হওয়া জামিয়া দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যেমন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে, তেমনই প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পর, আজও ভারতের সমাজ এবং রাজনীতিতে সমান প্রাসঙ্গিক এই বিশ্ববিদ্যালয় ।
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে 1920 সালে ব্রিটিশ বিরোধী অসহযোগিতা আন্দোলনের সূচনা করেন মহাত্মা গান্ধি । শওকত আলি, মহম্মদ আলি, মৌলানা আবদুল কালাম আজাদের মতো স্বাধীনতা সংগ্রামীদের এই আন্দোলনে পাশে পান তিনি । সেই সময় বিদেশি পণ্যের পাশাপাশি, ইংরেজ শাসক পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বয়কটেরও ডাক ওঠে । সেই দাবিকে সমর্থন জানিয়ে ব্রিটিশ-ঘেঁষা বলে পরিচিত আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বেরিয়ে আসেন মৌলানা মেহমুদ হাসান, মৌলানা মহম্মদ আলি, হাকিম আজমল খান, আবদুল মজিদ খোয়াজা এবং চিকিৎসক মোখতার আহমেদ আনসারির মতো জাতীয়তাবাদী শিক্ষাবিদ এবং পড়ুয়ার দল ।
ইংরেজ বিরোধী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে শুরুতে আলিগড়েই একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া গড়ে তোলা হয় । মহাত্মার সহযোগিতায় 1925 সালে জামিয়াকে সরিয়ে আনা হয় দিল্লির করোলবাগে । সেই সময় মহাত্মার বক্তব্য ছিল, ‘‘জামিয়াকে চালিয়ে নিয়ে যেতেই হবে ৷ টাকা পয়সার সমস্যা থাকলে আমাকে বলবেন ৷ প্রয়োজনে বাটি হাতে নিয়ে ভিক্ষা করব আমি ৷’’
ইতিহাসবিদ সোহেল হাশমির কথায়, ‘‘করোলবাগে জামিয়াকে সরিয়ে আনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিংহভাগ খরচই চালাতেন হাকিম আজমল ৷ ইংরেজদের দেওয়া ‘বিদ্বান’ উপাধি প্রত্যাখ্যান করেন তিনি ৷ কিন্তু জামিয়া প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মাথাতেই, 1927 সালে মৃত্যু হয় তাঁর ৷ অনুগামীরা তাঁকে ‘মসিহ-উল-মুল্ক’ সম্মানে ভূষিত করেন, যার অর্থ দেশের আরোগ্যকর্তা ৷’’ হাকিম আজমলের বাবা বল্লীমরনের শরিফ মঞ্জিলে একটি হাসপাতাল গড়ে তোলেন ৷ এই শরিফ মঞ্জিলই কংগ্রেসের সদর দফতরে পরিণত হয় এবং দিল্লিতে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির যাবতীয় বৈঠক সেখানেই হতো ৷
হাকিম আজমলের মৃত্যুর পর জামিয়া চালাতে আর্থিক সঙ্কট দেখা দেয় ৷ জামিয়া প্রেস ছাড়া মকতবা এবং গ্রন্থাগারকে মূল ক্যাম্পাসে তুলে আনা হয় ৷ সেই সময় আরও সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হন মোখতার আহমেদ আনসারি ৷ জামিয়ার প্রতিষ্ঠা বা তাকে শুধু ধরে রাখা নয়, তার জন্য অর্থ সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে বিপ্লবীদের নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেওয়া, ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাঁর ৷
পেশায় চিকিৎসক ছিলেন মোখতার আনসারি ৷ 1928 থেকে 1936 সাল পর্যন্ত জামিয়ার উপাচার্য ছিলেন তিনি ৷ সেই সময় শুধু কংগ্রেস বা মুসলিম লিগ নয়, সোশ্যালিস্ট, কমিউনিস্ট এমনকি গুপ্ত আন্দোলনের অংশ বিপ্লবীদের নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিতেন মোখতার আনসারি ৷ ইংরেজের সঙ্গে সংঘর্ষে জখম হয়ে তাঁর দুয়ারে এসে হত্যা দিতেন বিপ্লবীরা ৷ বিনা পয়সায় সকলের চিকিৎসা করতেন তিনি ৷ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত সকলকে আগলে রাখতেন ৷ শোনা যায়, দিল্লিতে দলে দলে বিপ্লবীরা দেখা করতে এলে মহাত্মা জানতে চাইতেন, তাঁরা কাকে অনুসরণ করেন ৷ জবাব পেতেন, ‘‘ডাক্তার আনসারি আমাদের বাদশা ৷’’
ইতিহাসবিদ সোহেল হাশমি জানিয়েছেন, সেই সময় ভারত সেরা যে কয়েক জন শল্য চিকিৎসক ছিলেন, তাঁদের মধ্যে কলকাতার বিধানচন্দ্র রায়, মুম্বইয়ের মিরাজকর এবং দিল্লির মোখতার আনসারি ছিলেন অন্যতম । দিল্লির দরিয়াগঞ্জে বিরাট বাড়ি ছিল তাঁর । সেখানে কংগ্রেসের বৈঠকও বসত । ইংরেজদের নজর থেকে বাঁচতে সেখানে গা ঢাকা দিতেন বহু বিপ্লবী । ইংরেজ বিরোধী বিপ্লবে যুক্ত থাকলেও, এমন অনেক বিপ্লবী আসতেন, যাঁদের মতাদর্শ ছিল সম্পূর্ণ আলদা । কিন্তু মোখতার আনসারি কাউকেই ফেরাতেন না ।
ইংরেজ শাসকের চোখে চোখ রেখে জামিয়াকে গড়ে তোলার পিছনে হাকিম আজমল এবং মোখতার আনসারি, দু’জনের অবদানই অনস্বীকার্য ৷ 1936 সালে মারা যান মোখতার আনসারি । শুধু জামিয়াকে আগলে রাখাই নয়, হাকিম আজমলের মতোই মৃত্যুর পরেও জামিয়ার মাটিতেই মিশে যান তিনি ৷ দু’জনকেই জামিয়া ক্যাম্পাসে সমাধিস্থ করা হয় ৷ তাঁদের হাতে গড়ে ওঠা জামিয়া তাই এই শতবর্ষ পরেও দেশের সেরা ৷ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কৃতী ছাত্রছাত্রীরা সেখান থেকে পাশ করে বেরিয়েছেন, রাজনীতি, বিনোদন, সাংবাদিকতা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্যের নজির গড়েছেন যাঁরা ।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে জামিয়ার গুরুত্ব বিচার করতে গিয়ে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, ‘‘মহাত্মার অসহযোগ আন্দোলনের তেজস্বী সন্তান জামিয়া ৷’’ স্বাধীনতার 75 বছর পূর্তিতে তাই জামিয়াকে ভারত মায়ের বিপ্লবী সন্তানদের কৃষ্টি বললেও অত্যুক্তি হয় না ৷