কলকাতা, 26 নভেম্বর: সমাজ পরিবর্তন বা স্বাধীনতা এমনিতে আসে না। দীর্ঘ লড়াই এবং ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্যে দিয়েই আসে বহু কাঙ্ঘিত স্বাধীনতা। বিশ্ববিখ্যাত এক ক্রীড়াবিদ বলেছিলেন, "যে মেডেল যত চকচকে তার নেপথ্যে ততই অদৃশ্য রক্ত লেগে থাকে।" স্বাধীনতাও আসলে তাই।
দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে অবিভক্ত বাংলার ভূমিকা সর্বজনবিদিত। ঐতিহাসিক একাধিক দলিল বাংলার ছাত্র-যুব ও নারীদের মরণপণ সংগ্রামের সাক্ষ্য বহন করে ৷ স্বাধীনতা পাওয়ার লক্ষ্যের প্রথম যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে সিপাহী বিদ্রোহ। সেটারও শুরু বাংলার ব্যারাকপুরে। পাশাপাশি শুধু আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে স্বাধীনতা আসবে না । ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে হবে। এমন দাবিও প্রথম উঠেছিল বাংলায়। বাংলার প্রায় প্রতিটি এলাকা থেকে কেউ না কেউ স্বাধীনতা আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন।
এই সব কারণে বাংলার উপর ব্রিটিশদের আক্রমণও ছিল নিদারুণ। তবে শুধু স্বাধীনতা আদায়ের আন্দোলন নয়, দেশের সংবিধান রচনাতেও বড় ভূমিকা ছিল বাংলার। সংবিধানের খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান বাবা সাহেব আম্বেদকরের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে গিয়েছেন বাংলা মায়ের এই বীর সন্তানরা। অজানা সেই ইতিহাস তুলে ধরল ইটিভি ভারত।
হেমেন্দ্র কুমার মুখোপাধ্যায়: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রাক্তন সহউপচার্য সংবিধান সভার উপ-সভাপতি ছিলেন । তাঁর মূল দায়িত্ব ছিল সংরক্ষণ-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া। ধর্মে খ্রিস্টান এই নেতা সংখ্যালঘুদের সংরক্ষণের ব্যাপারে তৎপরতা দেখিয়েছেন । একটা সময় তিনি সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক সংরক্ষণও দিতে চেয়েছিলেন। তবে দেশ স্বাধীনতা পাওয়ার পর শুধুমাত্র অর্থনৈতিক এবং সামাজিক স্তরেই সংরক্ষণের পক্ষে সওয়াল করেন হেমেন্দ্র । আরও পরে 1951 সাল থেকে 1956 সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি । পাশাপাশি পালন করেছেন দেশবন্ধু মেমরিয়ালের দায়িত্বও।
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়: সংবিধান সভায় কংগ্রেসের টিকিটে নির্বাচিত হয়েছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের এই পুত্র । তিনিও আঞ্চলিক ভাষা থেকে শুরু করে সংখ্যালঘুদের সংরক্ষণ নিয়ে একাধিক উদ্যোগ নিয়েছেন । বিভিন্ন বিতর্কে অংশ নিয়ে নানা বিষয়ে তাঁর মতামত প্রকাশ করেছেন । পাশাপাশি সংবিধানে বলা মৌলিক অধিকারের প্রশ্নেও তাঁর ভূমিকা আছে । মুসলিম লিগ সংবিধান সভায় অংশ নেয়নি (মুসলিম লিগের কয়েকজন সদস্য অবশ্য স্বতন্ত্রভাবে সভায় যোগ দিয়েছিলেন )। সে সময় শ্যামাপ্রসাদ মনে করেছিলেন মুসলিম লিগ না থাকলেও সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার জন্য সংবিধান তৈরির আগেই যে সমস্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তার সঙ্গে আপোস করা উচিত নয়। 2019 সালের অগস্ট মাসে সংবিধানের 370 ধারা প্রত্যাহার করে নেয় কেন্দ্রীয় সরকার। সে সময়ও বিজেপি'র সাংসদরা সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার প্রশ্নে শ্যামাপ্রসাদের ভূমিকার কথা বারবার মনে করিয়ে দিয়েছিলেন।
মনমোহন দাস: কংগ্রেসের টিকিটে সংবিধান সভায় জায়গা করে নেয় মনমোহনের বেশ কয়েকটি মনে রাখার মতো অবদান আছে ৷ কাজ ভালোভাবে চালাতে সরকারি আধিকারিকদের তিনটি ভাষা জানা দরকার বলে মনে করতেন তিনি । হিন্দি এবং ইংরেজি ছাড়া যে এলাকায় ওই আধিকারিক কর্মরত সেখানকার স্থানীয় ভাষা তাঁর জানা দরকার বলে মনে করতেন মনমোহন । পাশাপাশি গ্রাম পঞ্চায়েতের মতো সংস্থা তৈরির কথাও বলেছিলেন। 1952 সালে প্রথম ভোট দেয় দেশ। সেখানে ভোটারদের তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে 1941 সালের জনগণনাকে যে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে সেটাও বলেছিলেন মনমোহন দাস ।
পিআর ঠাকুর: 1946 সালে সংবিধানস সভার সদস্য হন পিআর ঠাকুর । যে সমস্ত জনজাতি অতীতে নির্যাতনের শিকার হয়েছে তাদের সংখ্যালঘু শ্রেণির আওতায় আনতে চেয়েছিলেন তিনি । তাছাড়া আর্থিক স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন । একাধিক বক্তব্য পেশ করেছেন অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধেও ।
অরুণ চন্দ্র গুহ: 1946 সালে কংগ্রেসের টিকিটে সংবিধান সভায় জায়গা পাওয়া অরুণ চন্দ্র গুহ সংবিধানের বেশ কিছু অংশ নিয়ে প্রবল আপত্তি করেছেন । সাধারণ মানুষ যে সমস্ত অধিকার ও স্বাধীনতা পেয়ে থাকে তার উপর কোনও বিধিনিষেধ আরোপিত হোক, তা তিনি চাননি । সভার সদস্য হিসেবে নিজের কাজ শেষ করার পর একটি দীর্ঘ বক্তব্য পেশ করেছিলেন অরুণ । সেখানে এই সংবিধানের কোথায় কোথায় খামতি আছে, তা ব্যাখ্যা করেন । সবমিলিয়ে তাঁর দাবি ছিল, যেভাবে সংবিধান তৈরি হয়েছে তাতে এটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হতে পারে না, সামগ্রিক সময়ের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে মাত্র ।
লক্ষ্মীকান্ত মিত্র: 1946 সালে কংগ্রেসের টিকিটে সংবিধান সভায় স্থান পাওয়া লক্ষ্মীকান্ত ধর্মীয় স্বাধীনতার পক্ষে একাধিক বক্তব্য রেখেছিলেন । তাছাড়া ধর্মীয় স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে বাধা-এমনটাও মনে করতেন না তিনি। পাশাপাশি ভারতের রাষ্ট্রীয় ভাষা থাকা উচিত বলেও তিনি মনে করতেন।
সতীশচন্দ্র সামন্ত: সংবিধান সভার এই সদস্য মতামত প্রকাশের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করার দাবি করেন।