পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / state

বড়দিনের অনন্য বাজার, হাতের কাজে স্বপ্নপূরণ ফুটপাথের কচিকাঁচাদের - STREET CHILDREN CHRISTMAS MARKET

ফুটপাথের শিশুরাই এই বাজারের আয়োজন করেছিল রবিবার । তাদের হাতের কাজ ছিল বাজারের অন্যতম আকর্ষণ । পথচলতি মানুষের ভিড়ও ছিল চোখে পড়ার মতো ।

street children Christmas Market
ফুটপাথবাসী কচিকাঁচাদের হাতে তৈরি সামগ্রীর মেলা (নিজস্ব ছবি)

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Dec 9, 2024, 8:00 PM IST

কলকাতা, 9 ডিসেম্বর: শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, খোলা আকাশের নীচে ওদের বাস । কেউ চার ফুট বাই ছয় ফুটের প্লাস্টিকের ছাউনির নীচে রাত কাটায় । ঝড় ঝাপটার ভয়ে কারও আবার উড়ালপুল বা সেতুর নীচেই বাস । কারও বাবা-মা, ভাই-বোন আছে । কারও আবার তাও নেই ৷ তবে তাদের দু'চোখে বড় হওয়ার স্বপ্ন । কেউ ফুটপাথের গণ্ডি পেরিয়ে পাঁচিল ঘেরা বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছতে চায় । কেউবা শিল্পকলায় নিজের সত্ত্বা তুলে ধরতে চায় । সেজন্যই 10-15 বছর বয়সি ছেলেমেয়েগুলো কেউ নাচ শিখছে, কেউ ছবি আঁকছে, কেউবা কাঁথা বুনছে । সেই ফুটপাথবাসী কচিকাঁচাদের হাতে তৈরি উপহার সামগ্রীর মেলা বসল দক্ষিণ কলকাতায় ।

টালিগঞ্জ থানার উলটো দিকে ড. মেঘনাদ সাহা পার্কে পথশিশুদের বড়দিনের বাজার বসে রবিবার । 'ক্রিসমাস মার্কেট: আর্ট, ক্র্যাফট, ফুড', শীর্ষক বাজারে কাগজ কাপড় ও নানা রঙে আঁকা বাহারি ছবি ও খাবারের মেলা বসে । এই মার্কেটের অধিকাংশ সামগ্রী ওই ফুটপাথবাসী কচিকাঁচাদের হাতে তৈরি । এর থেকে যা টাকা আয় হয়, তা তাদেরই পড়াশোনা ও যাবতীয় খরচের কাজে লাগে । সকাল থেকে সন্ধে, খেলাধুলো, নাচ, গান, খাওয়া-দাওয়া সমস্তটাই তদারকি করেন প্রাক্তন স্কুলশিক্ষিকা মিত্রবৃন্দা ঘোষ ।

পথশিশুদের বড়দিনের বাজার (ইটিভি ভারত)

গত পাঁচ বছর ধরে টালিগঞ্জ থানা সংলগ্ন কয়েকটি রাস্তার কচিকাঁচাদের নিয়ে এলাকায় স্কুল করেছেন তিনি । নাম দিয়েছেন 'রামধনু স্কুল' । এই স্কুলের পড়ুয়ারা আবার কলকাতা পুরনিগমের সরকারি স্কুলেও পড়ে । তিনজন থেকে গত পাঁচ বছরে বৃদ্ধি পেয়ে এ বছর 32 জনে দাঁড়িয়েছে পড়ুয়ার সংখ্যা । গত বছর তাদের মধ্যে প্রিয়া প্রামাণিক মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন । এখন টালিগঞ্জ গার্লস হাইস্কুলের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী সে । আগামী দিনে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছবি বা আর্ট নিয়ে পড়াশোনা করতে চায় ।

প্রিয়া প্রামাণিক বলে, "আমি বা আমার মতো অনেক ফুটপাথের ছেলেমেয়েদের বড় হওয়ার স্বপ্ন রয়েছে । নানা কারণে সে স্বপ্ন পূরণ হয় না । কিন্তু, দিদি যেভাবে আমাদের জন্য এগিয়ে এসেছেন তাতে আমি-সহ বাকিরাও তাদের স্বপ্নপূরণ করতে পারবে বলে আমি মনে করি । এই বাজার থেকেই যা টাকা-পয়সা আয় হবে সব কিন্তু আমাদের জন্য খরচ করেন দিদি । আমাদের টিউশন পড়ানো, রং পেন্সিল কিনে দেওয়া, বই খাতা যাবতীয় দায়িত্ব দিদি নিয়েছেন ।"

নিজের কাজ বাজারে তুলে ধরে ফুটপাথবাসীরা (নিজস্ব ছবি)

প্রতিবছর বড়দিনের প্রাক্কালে সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে অনুষ্ঠিত হয় বড়দিনের এই বাজার । এবার তার পঞ্চম বছর । ফুটপাথের শিশুরাই এই বাজারের আয়োজন করে রবিবার । তাদের হাতের কাজ ছিল বাজারের অন্যতম আকর্ষণ । পথচলতি মানুষের ভিড়ও ছিল চোখে পড়ার মতো । মিত্রবৃন্দা ঘোষের কথায়, "এই বাজারের ফলে পথশিশুদের মধ্যে কনফিডেন্স আসবে যা আগামী দিনে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে ৷" শুধু তাই নয়, পথশিশুদের উপহার দেওয়া হয় ৷ বসে আঁকো প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে যেমন খুশি তেমন সাজো ইত্যাদি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ।

বিগত পাঁচ বছর ধরে এই পথশিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষা দিয়ে আসছেন দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা মিত্রবিন্দা ঘোষ । তিনি এই বাজারের অন্যতম উদ্যোক্তা । এ বিষয় তিনি ইটিভি ভারতকে বলেন, "বেসরকারি স্কুলে পড়ানোর সময় থেকেই ফুটপাথের বাচ্চাদের প্রতি আমার আলাদা ভালো লাগা ছিল । তাদের বয়সি আমার একটা মেয়েও আছে । ফলে তাদেরকে এবং আমার মেয়েকে আমি আলাদা চোখে দেখতে পারি না ।"

তাঁর কথায়, "গত পাঁচ বছর আগে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে প্রিয়া প্রামাণিককে রাস্তায় বসে ছবি আঁকতে দেখি । তার আঁকা দেখে আমি অবাক হয়ে যাই । সঙ্গে সঙ্গে আমি জিজ্ঞাসা করি, আমি তোমাকে উপহার দিতে চাই, তুমি কি নেবে বলো ? প্রিয়া অন্য কিছু বা অন্য পাঁচটা ফুটপাথবাসী বাচ্চার মতো টাকা পয়সা চাইতে পারতো । কিন্তু, ও আমার কাছে রং পেন্সিল চেয়েছিল । আমি ওকে দিয়েও ছিলাম । তারপরে আমার মনে হল প্রিয়ার মতো অনেক ছেলেমেয়ে রাস্তায় আছে যাদের এরকম বহু ট্যালেন্ট রয়েছে । তার প্রকাশ ঘটা দরকার ৷ তাদের স্বপ্নপূরণ হওয়া দরকার ।"

ফুটপাথের শিশুরাই এই বাজারের আয়োজন করে (নিজস্ব ছবি)

তিনি আরও বলেন, "সেই জায়গা থেকে তিনটি মেয়েকে নিয়ে আমার যাত্রা শুরু হয় । পাঁচ বছরে এই বাচ্চাদের সংখ্যা 32 দাঁড়িয়েছে । ওদের জামা কাপড়, পড়াশোনা, নাচ, গান, বইখাতা সমস্তটার খরচ আমি বহন করি । তার থেকে বড় কথা, ওরা শুধু পড়াশোনা শিখছেই নয়, নিজের হাতে স্বাবলম্বী হওয়ার কাজও শিখছে । আমি সেটাই করার বেশি চেষ্টা করছি । যাতে ওরা আগামীতে নিজের স্বপ্নপূরণ করতে পারে ।"

শহর কলকাতার আকাশছোঁয়া বহুতলের বাসিন্দাদের অনেকেই ফুটপাথবাসী বাচ্চাদের দেখে নাক সিঁটকান । কেউবা দূর ছাই বলে তাড়িয়ে দেন । কিন্তু আজকের মেলায় সেই সব ফুটপাথবাসী ছেলেমেয়েদের হাতে তৈরি সামগ্রী কিনতে আসে তথাকথিত 'এলিট ক্লাস' । কিন্তু সবাই এক নন । অনেকেই চান, এই ফুটপাথবাসী ছেলেমেয়েগুলো অন্য পাঁচটা শিশুর মতো নিজের স্বপ্নপূরণ করুক ।

সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে অনুষ্ঠিত হয় বড়দিনের এই বাজার (নিজস্ব ছবি)

ঠিক এ কারণেই আজ কলকাতার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কলেজের অধ্যাপিকা, স্কুল শিক্ষিকা, নাচের শিক্ষিকারা এই মেলাতে উপস্থিত হন । আদতে কলকাতার বাসিন্দা হলেও বর্তমানে কর্মসূত্রে দেশের বাইরে থাকেন পাপিয়া ভট্টাচার্য । আজকের এই ক্রিসমাস মার্কেটে এসে অনেকগুলি জিনিস কিনেছেন তিনি । পাপিয়া বলেন, "ফুটপাথের অনেক শিশুই হীনমন্যতায় ভোগে । কিন্তু, আমি ওদের বলতে এসেছি যে, তোমরা ফেলনা নও । তোমরাও সমাজের একটা বড় অংশ । সবাই পায়ে পা মিলিয়ে চলব । এই উৎসাহটাই ওদের দিতে এসেছি ।"

প্রাক্তন স্কুল শিক্ষিকা মানসী ভট্টাচার্য পথশিশুদের থেকে পেপার ওয়েট ক্যালেন্ডার কিনেছেন । তিনি বলেন, "যাদের কথা কেউ ভাবে না তাদের নিয়ে একজন ঘরোয়া মেয়ে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন । সাধু উদ্যোগ । কিছু করবার যে চাবিকাঠি এই বাচ্চারা পেয়েছে তা যদি তারা বজায় রাখতে পারে তারা নিজেরাই প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে ।"

মেলায় এসে আপ্লুত বেহালার বাসিন্দা রত্না শ্বর । তিনি বলেন," মিত্রবৃন্দার এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই । ছেলেমেয়েগুলো প্রত্যেকের হাতের কাজ খুব ভালো । আমি চাই এই সমস্ত ছেলেমেয়েগুলোর পাশে সকলেই এসে দাঁড়াক ।" কলকাতাতে বুটিক চালান তনুজা রায় । নিজে বুটিকের কাজও শেখান । তিনি বলেন, "প্রত্যেকটি মেয়ের হাতের কাজ খুব ভালো, আমি এদের সঙ্গ দিতে চাই । যাতে আগামীতে এরা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারে ।"

ABOUT THE AUTHOR

...view details