কলকাতা, 9 ডিসেম্বর: শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, খোলা আকাশের নীচে ওদের বাস । কেউ চার ফুট বাই ছয় ফুটের প্লাস্টিকের ছাউনির নীচে রাত কাটায় । ঝড় ঝাপটার ভয়ে কারও আবার উড়ালপুল বা সেতুর নীচেই বাস । কারও বাবা-মা, ভাই-বোন আছে । কারও আবার তাও নেই ৷ তবে তাদের দু'চোখে বড় হওয়ার স্বপ্ন । কেউ ফুটপাথের গণ্ডি পেরিয়ে পাঁচিল ঘেরা বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছতে চায় । কেউবা শিল্পকলায় নিজের সত্ত্বা তুলে ধরতে চায় । সেজন্যই 10-15 বছর বয়সি ছেলেমেয়েগুলো কেউ নাচ শিখছে, কেউ ছবি আঁকছে, কেউবা কাঁথা বুনছে । সেই ফুটপাথবাসী কচিকাঁচাদের হাতে তৈরি উপহার সামগ্রীর মেলা বসল দক্ষিণ কলকাতায় ।
টালিগঞ্জ থানার উলটো দিকে ড. মেঘনাদ সাহা পার্কে পথশিশুদের বড়দিনের বাজার বসে রবিবার । 'ক্রিসমাস মার্কেট: আর্ট, ক্র্যাফট, ফুড', শীর্ষক বাজারে কাগজ কাপড় ও নানা রঙে আঁকা বাহারি ছবি ও খাবারের মেলা বসে । এই মার্কেটের অধিকাংশ সামগ্রী ওই ফুটপাথবাসী কচিকাঁচাদের হাতে তৈরি । এর থেকে যা টাকা আয় হয়, তা তাদেরই পড়াশোনা ও যাবতীয় খরচের কাজে লাগে । সকাল থেকে সন্ধে, খেলাধুলো, নাচ, গান, খাওয়া-দাওয়া সমস্তটাই তদারকি করেন প্রাক্তন স্কুলশিক্ষিকা মিত্রবৃন্দা ঘোষ ।
গত পাঁচ বছর ধরে টালিগঞ্জ থানা সংলগ্ন কয়েকটি রাস্তার কচিকাঁচাদের নিয়ে এলাকায় স্কুল করেছেন তিনি । নাম দিয়েছেন 'রামধনু স্কুল' । এই স্কুলের পড়ুয়ারা আবার কলকাতা পুরনিগমের সরকারি স্কুলেও পড়ে । তিনজন থেকে গত পাঁচ বছরে বৃদ্ধি পেয়ে এ বছর 32 জনে দাঁড়িয়েছে পড়ুয়ার সংখ্যা । গত বছর তাদের মধ্যে প্রিয়া প্রামাণিক মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন । এখন টালিগঞ্জ গার্লস হাইস্কুলের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী সে । আগামী দিনে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছবি বা আর্ট নিয়ে পড়াশোনা করতে চায় ।
প্রিয়া প্রামাণিক বলে, "আমি বা আমার মতো অনেক ফুটপাথের ছেলেমেয়েদের বড় হওয়ার স্বপ্ন রয়েছে । নানা কারণে সে স্বপ্ন পূরণ হয় না । কিন্তু, দিদি যেভাবে আমাদের জন্য এগিয়ে এসেছেন তাতে আমি-সহ বাকিরাও তাদের স্বপ্নপূরণ করতে পারবে বলে আমি মনে করি । এই বাজার থেকেই যা টাকা-পয়সা আয় হবে সব কিন্তু আমাদের জন্য খরচ করেন দিদি । আমাদের টিউশন পড়ানো, রং পেন্সিল কিনে দেওয়া, বই খাতা যাবতীয় দায়িত্ব দিদি নিয়েছেন ।"
প্রতিবছর বড়দিনের প্রাক্কালে সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে অনুষ্ঠিত হয় বড়দিনের এই বাজার । এবার তার পঞ্চম বছর । ফুটপাথের শিশুরাই এই বাজারের আয়োজন করে রবিবার । তাদের হাতের কাজ ছিল বাজারের অন্যতম আকর্ষণ । পথচলতি মানুষের ভিড়ও ছিল চোখে পড়ার মতো । মিত্রবৃন্দা ঘোষের কথায়, "এই বাজারের ফলে পথশিশুদের মধ্যে কনফিডেন্স আসবে যা আগামী দিনে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে ৷" শুধু তাই নয়, পথশিশুদের উপহার দেওয়া হয় ৷ বসে আঁকো প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে যেমন খুশি তেমন সাজো ইত্যাদি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ।
বিগত পাঁচ বছর ধরে এই পথশিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষা দিয়ে আসছেন দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা মিত্রবিন্দা ঘোষ । তিনি এই বাজারের অন্যতম উদ্যোক্তা । এ বিষয় তিনি ইটিভি ভারতকে বলেন, "বেসরকারি স্কুলে পড়ানোর সময় থেকেই ফুটপাথের বাচ্চাদের প্রতি আমার আলাদা ভালো লাগা ছিল । তাদের বয়সি আমার একটা মেয়েও আছে । ফলে তাদেরকে এবং আমার মেয়েকে আমি আলাদা চোখে দেখতে পারি না ।"