কলকাতা, 17 জানুয়ারি: কুম্ভের মেলায় হারিয়ে যাওয়া ভাই...! কথাটা নানা ক্ষেত্রে রসিকতার সুরে ব্যবহৃত হলেও, এমন ঘটনা বাস্তবে ঘটলে তার পরিণতি যে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তা চাক্ষুস করলেন মুকুন্দপুরের বাসিন্দা 77 বছরের এক বৃদ্ধা ৷ মহাকুম্ভে গিয়ে মেয়ের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সহায় সম্বলহীন অবস্থায় তিনি যখন গাছতলায় দাঁড়িয়ে, তখন তাঁর হাত ধরলেন আর এক বাঙালি ৷ ইসলামপুরের সেই ব্যক্তি সব কাজকর্ম ফেলে, নিজের খরচে বৃদ্ধাকে কলকাতায় এনে, পুলিশের সাহায্য নিয়ে তাঁকে ঘরে ফেরালেন ৷ মহাকুম্ভের পুণ্যস্নানেও এত বড় পুণ্য হয়তো করে উঠতে পারেননি কোনও ভক্ত ৷
জানা গিয়েছে, গত 10 জানুয়ারি মহাকুম্ভের মেলায় পুণ্যস্নানের উদ্দেশ্যে মেয়ে রুমা হালদারের সঙ্গে উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজে গিয়েছিলেন 77 বছরের বৃদ্ধা কৃষ্ণা সরকার । তবে স্নান করতে গিয়ে তিনি তাঁর মেয়ের থেকে আলাদা হয়ে যান ৷ অনেক চেষ্টা করেও মেয়ে রুমার খোঁজ পাননি তিনি । অবশেষে বৃদ্ধা একটি গাছের তলায় আশ্রয় নেন ৷
পরিবার ফিরে পেলেন মহাকুম্ভে হারিয়ে যাওয়া বৃদ্ধা (নিজস্ব চিত্র) এদিকে, মহাকুম্ভে পুন্যস্নানে গিয়েছিলেন আর এক বাঙালি সঞ্জয় কুণ্ডু ৷ তাঁর বাড়ি উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুরে ৷ তিনি হঠাৎ দেখতে পান গাছের তলায় ঠান্ডায় থরথর করে কাঁপছেন এক অশক্ত বৃদ্ধা ৷ আর তাঁর দু'চোখ বেয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছে ৷ বৃদ্ধাটি কোনও বিপদে পড়েছেন আশঙ্কা করে তাঁর দিকে এগিয়ে যান সঞ্জয় ৷ কথা বলতেই বুঝতে পারেন বৃদ্ধাও বাঙালি ৷ কলকাতার বাসিন্দা ৷ বৃদ্ধা সঞ্জয়কে জানান, তিনি মেয়ের সঙ্গে এসেছিলেন, কিন্তু কুম্ভের মেলায় হারিয়ে গিয়েছেন ৷ তাঁর কাছে কোনও টাকা-পয়সাও নেই ৷
সব শুনে বৃদ্ধাকে নিয়ে মেলার বেশ কয়েকটি পুলিশ সহায়তা কেন্দ্রে ঘোরেন সঞ্জয় । সেখানকার পুলিশ প্রশাসন যথেষ্ট চেষ্টা করলেও, কৃষ্ণা দেবীর মেয়ের সঙ্গে তাঁর দেখা করানো সম্ভব হয়নি । আর কোনও আশা না দেখে, নিজের খরচে বৃদ্ধার ট্রেনের টিকিট কেটে গতকাল তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসেন সঞ্জয় ৷ তিনি বৃদ্ধার থেকে জানতে পারেন যে, তাঁর আত্মীয়রা কলকাতার মুকুন্দপুরে থাকেন । তিনিও সেখানেই থাকেন । সেই মতো কৃষ্ণাদেবীকে নিয়ে সঞ্জয় মুকুন্দপুরে এলেও নিজের বাড়ি চিনিয়ে দিতে পারেননি বৃদ্ধা ৷ অবশেষে তাঁকে পূর্ব যাদবপুর থানায় নিয়ে যান সঞ্জয় ।
সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা পুলিশের ডিসি (ইডি) আরিশ বিলালের নির্দেশে সংশ্লিষ্ট থানার একজন মহিলা সাব ইনস্পেকটর ও অতিরিক্ত দুই সাব ইনস্পেকটর মিলে খোঁজখবর শুরু করেন ৷ ততক্ষণে ওই বৃদ্ধাকে রাখা হয় পূর্ব যাদবপুর থানার একটি ঘরে । সেখানে তাঁর সেবা সুশ্রুষার আয়োজন করেন থানার অন্যান্য পুলিশকর্মীরা । থানার পুলিশকর্মীরা ওই এলাকায় ভালোভাবে খোঁজখবর করেন এবং বৃদ্ধার ছবি এলাকার বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে দিতে থাকেন । সেই ছবি দেখেই তাঁর খোঁজ যায় বৃদ্ধার ছেলে দেবাশিস সরকারের কাছে । তিনি দ্বারস্থ হন পূর্ব যাদবপুর থানার । সঠিক পরিচয় পত্র দিয়ে অবশেষে হারিয়ে যাওয়া বৃদ্ধা মাকে খুঁজে পান তিনি ৷
মহাকুম্ভের মেলায় কোটি কোটি লোকের মাঝে হারিয়ে যাওয়ার পরও নিজের পরিবারে ফিরতে পেরে আপ্লুত 77 বছরের কৃষ্ণা দেবী ৷ তবে শুধু ছেলে বা পরিবারকে পাওয়াই নয়, সঞ্জয়ের মতো আর একটা ছেলেকে পাওয়াটাই তাঁর কাছে বাড়তি পাওনা ৷ কোনও রকম রক্তের সম্পর্ক ছাড়াই যিনি নিজের সব কাজকর্ম ফেলে, এতটা সময় দিয়ে, নিজের খরচে বৃদ্ধাকে বাড়ি ফিরিয়ে দিয়েছেন ৷ অক্লান্ত পরিশ্রমের পর বৃদ্ধাকে তাঁর পরিবারের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পেরে বেজায় খুশি কলকাতা পুলিশ তথা পূর্ব যাদবপুর থানার মহিলা সাব ইনস্পেকটর তনুশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়, সাব ইনস্পেকটর সুকুমার মণ্ডল, সাব ইনস্পেকটর সুমন দে ও অন্যান্যরা ৷
এই বিষয়ে কলকাতা পুলিশের ডিসি(ইডি) আরিশ বিলাল ইটিভি ভারতকে বলেন, "সঞ্জয় কুণ্ডুর মতো ব্যক্তিরা আজ দুর্লভ । থানা পুলিশ যতই সাহায্য করুক, যদি সঞ্জয় কুন্ডু নামে ওই ব্যক্তি কুম্ভ মেলায় হারিয়ে যাওয়া 77 বছরের কৃষ্ণা সরকারকে সাহায্য না করতেন, সেক্ষেত্রে এই সাফল্য মিলত না । আমরা কলকাতা পুলিশ ও বিশেষ করে পূর্ব যাদবপুর থানার গোটা পরিবার এই সঞ্জয় কুণ্ডুর মতো ব্যক্তিদের কাছে কৃতজ্ঞ ৷"
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পূর্ব যাদবপুর থানার একজন মহিলা সাব ইনস্পেকটর বলেন, "গোটা সমাজে যদি এই সঞ্জয় কুন্ডুর মতো আর কয়েকটা মানুষ নিজের এই মানবধর্মকে সামনে রেখে চলতে পারেন, সেক্ষেত্রে সমাজে অপরাধবোধ এবং অপরাধ মানসিকতা অনেকটা কমবে বলে আমার ধারণা ৷"
এই 'মানবধর্ম' পালনের পর বৃদ্ধাকে তাঁর ছেলের হাতে তুলে দিয়ে অবশেষে রাতের ট্রেন ধরে উত্তর দিনাজপুরে নিজের পরিবারের উদ্দেশে রওনা দেন সঞ্জয় কুন্ডু ।