পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / state

ক্যানভাসে রংয়ের খেলা দুঁদে পুলিশ অফিসারের ! অপরাধ দমনে ছবি এঁকে শান দেন মগজাস্ত্রে - PAINTER POLICE OFFICER

ছবি এঁকেই অপরাধ দমনের উদ্ভাবনী শক্তি খুঁজে পান মালদার পুলিশ অফিসার মানবেন্দ্রনাথ সাহা ৷ যে হাতে তাঁর আইনের শাসন, সেই হাতেই চলে রং-তুলির খেলা ৷

ETV BHARAT
ইজেলে রংয়ের খেলায় ব্যস্ত দুঁদে পুলিশ অফিসার (নিজস্ব চিত্র)

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Jan 8, 2025, 8:01 PM IST

Updated : Jan 8, 2025, 10:15 PM IST

মালদা, 8 জানুয়ারি: দুঁদে পুলিশ অফিসার তিনি ৷ যথেষ্ট সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন রাজ্যের বিভিন্ন থানায় ৷ অপরাধের তদন্তে তাঁর নাকি জুড়ি মেলা ভার ৷ তাঁকে নিয়ে এমনটাই প্রচলিত মালদা জেলার পুলিশ মহলে ৷ সেই পুলিশ অফিসারই কখনও মগ্ন হয়ে যান নিজের সৃজনশীলতায় ৷ তখন তাঁর সামনে সাদা ক্যানভাস আর রং-তুলি ৷ ইজেলে চলে রংয়ের খেলা ৷ সেই পুলিশ অফিসার মানবেন্দ্রনাথ সাহা আজ ইটিভি ভারতের মুখোমুখি ৷ জানালেন নিজের শিল্পসাধনা আর কর্মক্ষেত্রের মেলবন্ধনের কথা ৷ মনে করিয়ে দিলেন সেই প্রবাদ, যিনি রাঁধেন, তিনি চুলও বাঁধেন ৷

ঘুম থেকে ওঠার পরেই শুরু হয়ে যায় তাঁর ব্যস্ততা ৷ ঘনঘন মুঠোফোনের রিং, কখনও ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশ পালন, কখনও বা অধস্তনদের নির্দেশ ৷ মস্তিষ্ক সচল থাকে গভীর রাতে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত ৷ সে কারণেই থানার আইসি হওয়া সত্ত্বেও তাঁর উপর জেলা সাইবার ক্রাইম থানার অতিরিক্ত দায়িত্বভার অর্পণ করা হয়েছে ৷ হাসিমুখে সেই দায়িত্ব পালন করেন ৷ তবে এরই মধ্যে চলে সৃজনশীলতায় শান ৷ ছবি আঁকার মধ্যেই তিনি নাকি উদ্ভাবনী শক্তি খুঁজে পান ৷ মস্তিষ্কে খুলে যায় অপরাধ পর্যবেক্ষণের নতুন জানলা ৷

অপরাধ দমনে ছবি এঁকে শান দেন মগজাস্ত্রে (ইটিভি ভারত)

মানবেন্দ্রনাথ সাহার বলছেন, "আমাদের কাজ সবসময় আমাদের চাপে রাখে ৷ সেই চাপ যেমন শারীরিক, তেমন মানসিক ৷ বছরের প্রতিটি দিন আমাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয় ৷ এতে আমরাও ক্লান্ত হয়ে পড়ি ৷ সেই সময় ছবি আঁকলে আমি আবার নতুন উদ্যম খুঁজে পাই ৷ ভিতরে যেন নতুন কোনও শক্তি অনুভব করি ৷ নিজেকেও যেন খুঁজে পাই ৷ সবচেয়ে বড় বিষয়, ছবি আঁকা আমাকে আরও কাজ করার এনার্জি দেয় ৷ তাই শত ব্যস্ততার মধ্যেও ছবি আঁকার চেষ্টা করি ৷"

মালদার পুলিশ অফিসার মানবেন্দ্রনাথ সাহার আঁকা ছবি (নিজস্ব চিত্র)

তাঁর কথায়, "আগামী দিনে সাইবার অপরাধ একপ্রকার মহামারির আকার নিতে চলেছে ৷ প্রতিটি মানুষ এখন দৈনন্দিন জীবনে সেটা টের পাচ্ছেন ৷ এই অপরাধ থেকে মানুষকে সুরক্ষা দেওয়া কিংবা অপরাধীদের গ্রেফতার করা ডেস্ক ওয়ার্ক হলেও প্রচুর মাথা ঘামাতে হয় ৷ এর জন্য মানসিকভাবে আমাদের সব দিক খোলা রাখতে হয় ৷ এই কাজে মনের উপর অসম্ভব চাপ পড়ে ৷ আমরাও মানসিকভাবে ক্লান্ত হই ৷ ময়দানে নেমে কাজ করা আমার মনে হয় বেশি সহজ ৷ সেই সময়ই আমি বেশি ছবি আঁকার সুযোগ পেয়েছি ৷ তবে এখনও ছবি আঁকি ৷ আমার পরিবার, সহকর্মী, ঊর্ধ্বতন আধিকারিকরাও এই কাজে আমাকে যথেষ্ট উৎসাহ দিচ্ছেন ৷ আমি তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ ৷"

শিল্পসাধনা আর কর্মক্ষেত্রের মেলবন্ধনে নিরলস চেষ্টা পুলিশকর্তার (নিজস্ব চিত্র)

নিজের ছবি আঁকার মাধ্যম হিসাবে জল রংকেই বেছে নিয়েছেন এই পুলিশকর্তা ৷ তার কারণ ? জানালেন, "আমার বাড়ি কোচবিহার ৷ ছোটতে যখন আঁকা শিখেছি, তখন ভিন্ন মাধ্যমে ছবি আঁকার সুযোগ খুব কম ছিল ৷ বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ শিখলেও আমি জল-রং মাধ্যমকেই বেশি পছন্দ করি ৷ এই মাধ্যম ছবি আঁকার ক্ষেত্রে যথেষ্ট কঠিন ৷ কিন্তু এই মাধ্যমে রং নিয়ে অনেক খেলা করা যায় ৷ অনেক চ্যালেঞ্জিং জায়গা নিয়েও খেলতে পারি ৷ এই মাধ্যমে কাজ করে মজা রয়েছে ৷ আমার বিষয়বস্তু মূলত লাইফ ৷ তার মধ্যে যেমন নেচার রয়েছে, তেমনই মানবজীবনের বিভিন্ন কাজ রয়েছে ৷ আমি একটা সিরিজ করেছি ব্যালে ডান্সারদের নিয়ে ৷ ওই কাজটা করতে আমার খুব ভালো লেগেছে ৷ এছাড়াও খেটে খাওয়া মানুষের দিন গুজরান ছবির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি ৷"

ছবি এঁকে অপরাধ দমনের উদ্ভাবনী শক্তি খুঁজে পান মালদার পুলিশ অফিসা (নিজস্ব চিত্র)

পুলিশ কর্মীদের মধ্যে নানা সময়ে অবসাদের কথা শোনা যায় ৷ তা দূর করতে বিশেষ টোটকা বাতলেছেন তিনি ৷ তিনি বলেন, "পুলিশকে বিভিন্ন সময় অবসাদ গ্রাস করে ৷ আমার অধস্তনরাও সেই অবসাদে ভোগেন ৷ সবাই হয়তো ছবি আঁকতে পারেন না ৷ তবে অনেকে আরও অনেক ধরনের শিল্পকর্মে জড়িত ৷ আমি বলি, যে যে শিল্পকলায় অভ্যস্ত, নিয়মিত সেই শিল্পে ব্যস্ত থাকলে তাঁরা নিশ্চিতভাবে অবসাদমুক্ত হবেন ৷ কাজ করতে তাঁদের সাহায্য করবে ৷ সহকর্মীদের সবসময় সেকথা বলি ৷ পজিটিভ এনার্জি পেতে এর কোনও বিকল্প নেই ৷"

জল রংয়ের মাধ্যমেই ছবি আঁকতে ভালোবাসেন (নিজস্ব চিত্র)

ছবি নিয়ে ভবিষ্যৎ কোনও পরিকল্পনা ? তিনি জানালেন, "কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ততার মধ্যেও আনন্দে ছবি এঁকে গিয়েছি ৷ এতদিন কোনও প্রদর্শনী করার সুযোগ পাইনি ৷ ভবিষ্যতে প্রদর্শনী করার ইচ্ছে রয়েছে ৷ নিজের আঁকা অনেক ছবির মধ্যে ভালো ও মন্দ, দু’ধরনেরই রয়েছে ৷ অবসর নেওয়ার পর ছবি আঁকা নিয়েই ব্যস্ত থাকার পরিকল্পনা রয়েছে ৷ আর শিলিগুড়ি কিংবা গৌড়বঙ্গে ছবি আঁকা নিয়ে গবেষণা বা সেই শিক্ষার তেমন কোনও পরিকাঠামো নেই ৷ অথচ এখানে তার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে ৷ ভবিষ্যতে এনিয়েও কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে ৷"

তাঁর ছবির বিষয় প্রকৃতি ও জীবন (নিজস্ব চিত্র)

এই পুলিশকর্তার স্ত্রী সংঘমিত্রা সান্ত্রা নিজে হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ৷ তাঁর রোজনামচাও ব্যস্ততাময় ৷ স্বামীর শিল্পচর্চার বিষয়ে বলতে দিয়ে তিনি জানালেন, "ওঁর ছবি আঁকার সবচেয়ে সমস্যার জায়গা হল সময় ৷ অল্প সময়ে ছবি আঁকতে তাঁর ব্যকুলতা দেখে আমাদেরও খারাপ লাগে ৷ জল রং মাধ্যমে ছবি আঁকার ক্ষেত্রে একদিনেই রং করতে হয় ৷ খুব ছোট ছবি হলেও রং করতে অন্তত দু’ঘণ্টা সময় লাগে ৷ কিন্তু ভালোবাসা থেকেই তিনি সেই কাজ করেন ৷ তাছাড়া পুলিশের মানসিক অবসাদ বেশি কাজ করে ৷ উনি সেই পরিস্থিতিতে পড়লেই ছবি আঁকতে বসে পড়েন ৷ ছবি এঁকেই নিজেকে অবসাদ থেকে বের করে আনেন ৷ এটা তাঁর কাছে শেখার বিষয় ৷ আমার স্বামী যে যে পুলিশ সুপারের অধীনে কাজ করেছেন, তাঁরাও তাঁকে সবসময় উৎসাহ দিয়ে এসেছেন ৷ বর্তমান পুলিশ সুপার তাঁকে ছবির প্রদর্শনী করারও অনুমতি দিয়েছেন ৷ তাঁদের সহযোগিতা আমার স্বামীকে এই ক্ষেত্রে এগিয়ে নিয়ে যেতে যথেষ্ট সাহায্য করেছে ৷ আমরাও এতে যথেষ্ট অনুপ্রাণিত হই ৷"

মানবেন্দ্রনাথ সাহার গোটা বাড়িটাই তাঁর ছবি আঁকার কর্মশালা ৷ গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকলেই প্রতিটি জায়গায় তাঁর আঁকা ছবি ৷ দেখে বোঝার উপায় নেই, এসব শিল্পকর্ম এক পুলিশ অফিসারের হাত দিয়ে বেরিয়ে এসেছে ৷ এই মুহূর্তে শহরে তৃণমূল নেতা খুনের তদন্তে ব্যস্ত পুলিশ সুপার প্রদীপকুমার যাদব ৷ এনিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি ৷ তবে একসময় মালদা জেলার পুলিশ সুপার ছিলেন কল্যাণ মুখোপাধ্যায় ৷ তিনিও বড় মাপের চিত্রশিল্পী ৷ মানবেন্দ্র নাথ সাহার কথা তুলতেই উচ্ছ্বসিত তিনি ৷ বললেন, "যে হাতে আইনের শাসন, সেই হাতেই রং-তুলিতে মূর্ত হয় চিত্রশিল্প ৷ মানবেন্দ্র যেমন ভালো প্রশাসক, তেমনই ভালো চিত্রশিল্পী ৷"

Last Updated : Jan 8, 2025, 10:15 PM IST

ABOUT THE AUTHOR

...view details