কোচবিহার, 18 জুন:"কুছ ভি কহে দো মেরে নাম সে, মুছে কোই এইতরাজ নেহি, খেদ হে কি মে কয়েদ খানে মে, মে তে গুণহেগার নেহি"- মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের এই কবিতা শোনালেন অনন্ত মহারাজ ৷ মঙ্গলবার 12 টা নাগাদ কোচবিহারের মদনমোহন মন্দিরে পুজো দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনন্ত মহারাজে চকচক বড়বাড়ি এলাকার প্রাসাদোপম বাড়িতে যান ৷
কোচবিহারে তাঁর বাড়িতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্বাগত জানাচ্ছেন অনন্ত মহারাজ (ইটিভি ভারত) তাঁকে হলুদ রঙের উত্তরীয় পরিয়ে বরণ করে নেন কোচবিহারের রাজবংশী নেতা অনন্ত মহারাজ ৷ যিনি বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদও বটে ৷ সোমবার দমদম বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন কোচবিহারে তাঁর দু'টি কাজ আছে ৷ এদিকে অনন্ত মহারাজ জানালেন, এই সাক্ষাৎ নিছক সৌজন্য সাক্ষাৎ ৷ এদিন সকালে এসপি তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর আসার খবর দেন ৷ তিনি তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি ৷ আর রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান আসতে চাইলে, তাঁকেও তিনি বাধা দিতে পারেন না ৷ তবে রাজনৈতিক মহল তৃণমূল সুপ্রিমোর সঙ্গে বিজেপি দলের রাজবংশী 'রাজা'র এই সাক্ষাৎ ভালো চোখে দেখছে না ৷ তাহলে কি অনন্ত মহারাজ তাঁর কবিতায় কোনও নতুন সমীকরণের ইঙ্গিত দিলেন ?
ভোট মিটেছে 4 জুন ৷ এবারের ভোটে উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহারের মধ্যে শুধু কোচবিহারটিই বিজেপির থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে তৃণমূল ৷ প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিককে 39 হাজার 250 ভোটে হারিয়েছেন তৃণমূলের বিধায়ক জগদীশ বসুনিয়া ৷ তার দু'সপ্তাহের মাথায় কোচবিহারের রাজবংশী নেতা অনন্ত মহারাজের সঙ্গে দেখা করতে তাঁর প্রাসাদে পৌঁছলেন তৃণমূল সুপ্রিমো ৷ তাঁকে গুয়াপান দিয়েছেন অনন্ত ৷ 15-20 মিনিট তাঁর প্রাসাদে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ অনন্ত বলেন, "তিনি শুধু গ্রিন টি খেয়েছেন ৷ আর আমরা যা যা করেছিলাম, সব দেখেছেন ৷" মমতাও তাঁকে শাল উপহার দিয়েছেন ৷
এই সাক্ষাৎ কি শুধু লোকদেখানো সৌজন্য ? নিশীথ প্রামাণিকের পরাজয়ের পর থেকে অনন্ত মহারাজকে নিয়ে নানা কথা শোনা যাচ্ছে ৷ তিনি নাকি নির্বাচনী প্রচারে বিজেপি প্রার্থী তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পাশে ছিলেন না ৷ গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান অনন্ত মহারাজ ভোটের সময় দার্জিলিংয়ে গিয়ে বসেছিলেন ৷ এদিকে তাঁর সঙ্গে নিশীথের সম্পর্ক একসময় বেশ ভালোই ছিল ৷
2023 সালের জুলাই মাসে অনন্ত মহারাজকে রাজ্যসভার সাংসদ করে ভারতীয় জনতা পার্টি ৷ তাতে বড় ভূমিকা ছিল নিশীথের ৷ সেই সময় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ ফোনে অনন্ত মহারাজের সঙ্গে কথা বলেছিলেন ৷ দক্ষিণবঙ্গে মতুয়াদের মতো উত্তরে রাজবংশী ভোট পাওয়াই লক্ষ্য ছিল গেরুয়া শিবিরের ৷ ওই বছরের 8 সেপ্টেম্বর ধূপগুড়ি বিধানসভা উপনির্বাচন ছিল ৷ তার আগেই বিজেপি জিসিপিএ নেতা অনন্তকে রাজ্যসভায় পাঠায় ৷ কারণ, জিসিপিএ ব্যানারে অনন্ত মহারাজ 2016 সাল থেকে বিজেপিকে সমর্থন করে আসছে ৷ তবে উপনির্বাচনে 4 হাজার 309 ভোটে বিজেপির তাপসী রায়কে হারিয়ে ধূপগুড়ির বিধায়ক হন নির্মল চন্দ্র রায় ৷
অনন্ত ফ্যাক্টর কাজ করল না উপ-নির্বাচনে ৷ রাজনৈতিক মহলের একাংশের মত, অনন্ত মহারাজের অনুগামী রাজবংশীদের ভোট পায়নি বিজেপি ৷ এবারে লোকসভা ভোটেও কোচবিহার হাতছাড়া হল গেরুয়া শিবিরের ৷ এদিন মহারাজ তাঁর প্রাসাদের বাইরে দাঁড়িয়ে সাফ বলেন, "আমি কোনও রাজনৈতিক দল করি না ৷ গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশন সংগঠন করি ৷ বিজেপির প্রতীকে রাজ্যসভার সাংসদ হয়েছি ৷"
তাঁর গলায় বারবার শোনা গিয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অমিত শাহ রাজবংশী নেতা সম্মান দিলেও স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্ব তাঁকে গুরুত্ব দেয়নি ৷ সেই ক্ষোভ উগরে দিলেন এদিন মমতা-সাক্ষাতের পরেও ৷ অনন্ত মহারাজের আক্ষেপ, "আজ পর্যন্ত আমাকে কোচবিহারে বিজেপির কার্যালয়টিও দেখায়নি ৷ আমি যে বিজেপির একজন সদস্য, বিজেপির কোনও নেতা বলেনি ৷ কেন্দ্রীয় দল এসেছে ৷ তাঁরাও ডাকছেন না ৷ আমাকে মানেই না ৷"
এই অসম্মানের জন্য কি রাজ্যসভার সাংসদ পদ ছেড়ে দেবেন গ্রেটার কোচবিহারের স্বঘোষিত মহারাজা ? না, তা করবেন না বলেই জানালেন বিজেপি সাংসদ ৷ এবার তাঁর গলায় অন্য সুর, "এরা আমায় কি সম্মান দেবে ? আমায় সম্মান দিয়েছেন গৃহমন্ত্রী মাননীয় অমিত শাহ ৷ সম্মান দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, যিনি আমার সঙ্গে দেখা করেছেন এবং বৈঠক করেছেন ৷"
এদিকে নিশীথের সঙ্গে অনন্ত মহারাজের বনিবনা হচ্ছিল না অনেক দিন ধরেই ৷ এই ভোটে অনন্ত মহারাজ বিজেপির জন্য কাজ করেছেন কি না, তা নিয়েও বিস্তর জলঘোলা হয়েছে ৷ কারণ ভোটের আগে একটি লিফলেট গ্রেটার কোচবিহার সমর্থকদের বাড়ি বাড়ি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ৷ তাতে তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল । আর সেই লিফলেটে নাকি অনন্ত মহারাজের স্বাক্ষর ছিল ৷ ঘটনাটি তদন্তের বিষয় ৷ তবে লোকসভা ভোটে কোচবিহারে আসনে তৃণমূলের জয়ী হওয়ার নেপথ্যে নাকি অনন্ত মহারাজের দলের একটা বড় অবদান আছে, মনে করছে রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ ।
তাহলে কি তৃণমূলে যোগ দেবেন অনন্ত মহারাজ ? না, সেই সম্ভাবনা প্রসঙ্গে সাফ জবাব মহারাজের, "আপনারা বুঝুন ৷ আমি কোনও রাজনৈতিক দলে নেই ৷" এদিন তিনি আরও বলেন, "আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে, তা মানুষ বলছে ৷ আমি কারও বিরুদ্ধে নেই ৷ আমাকে মুখ্যমন্ত্রী শাল উপহার দিয়েছেন ৷ আমার বাড়ি দেখে মুগ্ধ হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী ৷"
এদিন অনন্ত মহারাজ একটি হিন্দি কবিতা পাঠ করে শোনান- "কুচ ভি কহ দো মুঝসে, মুঝে এতরাজ নেহি হ্যায় ৷ খেদ হ্যায় কি মে ক্যাদ খানে মে, মে তো গুনহেগার নেহি ৷ খুশবুও কি গাও ম্যায় মে, মে বদনাম হো গায়া ৷ বদনামি কি চেহেরো মে মে নিলাম হো গায়া ৷ হার জবান পর খরিদ রাখা হে মুঝে ৷ বদনামি কি গেম সমঝকার ৷ মেরে নাম কা চর্চা হোনে লাগা নফরত কা ময়দান পর ৷ বুঝে গোল মে বদলকার আনন্দ লেতে হ্যায় লোগ ৷ দেখ লো ইনহে জি ভরকে, কিতনে আজিব হ্যায় ইয়ে লোগ ৷ কিয়া ঝুঁকা দোগে ইন মাওয়ালিকে আগে, ফির কিয়া জবাব দোগে অনন্ত বিধাতা কে আগে ।"