বারাসত, 5 অক্টোবর: সুবিচার মেলেনি এখনও । তাই আরজি কর-কাণ্ডে প্রতিবাদ জানাতে কোনও জাঁকজমক থাকছে না বারাসতের শতাব্দী প্রাচীন চট্টোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গাপুজোতে । জৌলুসহীন, অনাড়ম্বরভাবেই এ বছর তাঁদের পারিবারিক এই পুজো হতে চলেছে ।
কাটছাঁট করা হয়েছে পুজোর বেশকিছু আয়োজনেও । থাকবে না কোনও আলোর রোশনাই ৷ হবে না ভোগ বিতরণ এবং বস্ত্রদানের মতো সামাজিক কর্মসূচিও । শুধু থাকছে মায়ের পুজোর আচার ও রীতি-নীতি । কিন্তু, কেন এই পথে হাঁটতে হল চট্টোপাধ্যায় পরিবারকে?
দুর্গোৎসবে 'না', আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে জৌলুসহীন পারিবারিক পুজোও (ইটিভি ভারত) পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে,আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসক ছাত্রীর উপর নির্যাতন ও খুনের ঘটনা রীতিমতো নাড়া দিয়েছে চট্টোপাধ্যায় পরিবারকে । ঘটনার প্রায় দু'মাস পরেও এখনও অধরা আরজি কর-কাণ্ডের প্রকৃত দোষীরা । তাই, পুজো হলেও পরিবারের সকলেরই মন আজ ভারাক্রান্ত । এই আবহে বহু পুরনো চট্টোপাধ্যায় বাড়ির পুজোর আয়োজন করাটাই কার্যত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল পরিবারের সদস্যদের কাছে । শেষমেশ বুকে একরাশ যন্ত্রণা এবং মনে ব্যথা চেপে রেখেই এ বছর মায়ের পুজো করতে হচ্ছে তাঁদের ।
উৎসবের বদলে বিচার চান পরিবারের সদস্যরা (নিজস্ব ছবি) তবে, পুজো হলেও তা হচ্ছে একেবারে নমো নমো করে । পুজোর যেটুকু আচার অনুষ্ঠান করতে হয়, সেটুকু বাদ দিয়ে বাকি সমস্ত আড়ম্বরই এ বছর বাতিল করা হয়েছে পুরনো এই বনেদি বাড়ির পুজোতে । শুধু তাই নয়, পুজোর পাঁচটা দিন পরিবারের সকলেই মা দুর্গার কাছে নির্যাতিতা ছাত্রীর বিচার চেয়ে প্রার্থনা করবেন বলেও জানিয়েছেন পরিবারের অন্যতম সদস্য সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় । বারাসতে ঐতিহ্যবাহী বনেদি বাড়ির পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম এই চট্টোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গাপুজো ।
কথিত আছে, আজ থেকে একশো বছরেরও বেশি সময় আগে প্রচলন হয়েছিল বনেদি বাড়ির এই পুজোর । বংশধর বিপিন বিহারী চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরেই প্রথম এই পুজোর সূচনা হয়েছিল বারাসতের গুস্তিয়াতে । পরবর্তীতে সেই পুজো স্থানান্তরিত হয়ে চলে যায় কলকাতার শ্যামবাজারে যদু মিত্র লেনে । বংশ পরম্পরায় একসময় চট্টোপাধ্যায় পরিবারের এই পুজো হাতবদল হয়ে ফিরে আসে বারাসতে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে । বিগত প্রায় 20 বছর ধরে এখানেই হয়ে আসছে তাঁদের পারিবারিক পুজো । পুজোর সময় পরিবারের সমস্ত সদস্যই মিলিত হন এখানে । চলে হই-হুল্লোড়, আনন্দ, উপভোগও । আলোর রোশনাইয়ে সেজে ওঠে বাড়ির দালান । বাদ যায় না দুঃস্থদের হাতে নতুন বস্ত্র তুলে দেওয়াও । অষ্টমীতে কুমারী পুজো, ভোগ বিতরণ । এসব তো আছেই । কিন্তু, ব্যতিক্রম এবার ৷
আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে জৌলুসহীন পারিবারিক পুজো (নিজস্ব ছবি) আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে এ বছর পুজোর আড়ম্বরের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে প্রায় সমস্ত কিছুই । পুজোর আনন্দ উপভোগের পরিবর্তে পরিবারের সদস্যরা চাইছেন, নির্যাতিতার মৃত্যুর সুবিচার । বন্দনা চট্টোপাধ্যায় নামে পরিবারের এক প্রবীণ সদস্য বলেন, "বুকে কষ্ট, বেদনা নিয়েই এ বছর আমাদের মায়ের পুজো করতে হচ্ছে । মা'কে আনতে হবে । পুজো করতে হবে বলেই করা । তা না হলে আমরা সেটাও করতাম না । আলোর রোশনাই থেকে শুরু করে পুজোর তোরণ ও ভোগ বিতরণ, সবকিছুই এ বছর আমরা কাটছাঁট করে দিয়েছি । এত আন্দোলন, প্রতিবাদ ! তারপরও কী নির্যাতিতার পরিবার বিচার পাবে না? এটা ভেবেই যেন মন আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে । শুধু আমিই নই, আমার মতো অনেক মায়ের বুক ফেটে যাচ্ছে । মা দুর্গার কাছে একটাই প্রার্থনা করব, নির্যাতিতার পরিবার বিচার পাক ।"
বারাসতের শতাব্দী প্রাচীন চট্টোপাধ্যায় পরিবারের পুজো (নিজস্ব ছবি) একই সুর শোনা গিয়েছে পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের গলাতেও । তাঁর কথায়, "আরজি করের নির্মম এই ঘটনায় গোটা পরিবার ভেঙে পড়েছে । সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছে আমার মেয়ে সায়নী । ও যখন নির্যাতিতার বাড়িতে গিয়েছিল, তখন তাঁর বাবা-মা দু'জনেই আমার মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, আমাদের বাড়ির প্রদীপ চিরতরে নিভে গিয়েছে । আর কোনোদিন জ্বলবে না । সেটা যখন সায়নী বাড়িতে এসে বলল, তখন পরিবারের সকলেই আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম, এ বছর কোনও জাঁকজমক থাকবে না পারিবারিক পুজোতে । সেটাই করতে চলেছি আমরা ।"