খানাকুল, 7 অক্টোবর: পুজোর বয়স নয় নয় করে 350 বছর ৷ খানাকুলের কুমারহাটের বোস বাড়ি, আরামবাগ মহকুমার সম্ভবত একমাত্র বনেদি বাড়ি যেখানে একই দালানে দুর্গা, কালী ও জগদ্ধাত্রী এই তিনটি শক্তিপূজা হয়ে থাকে । পুজোর প্রতিষ্ঠাতা নরনারায়ণ বসু ৷ বন্যাপ্রবণ এলাকায় পুজো শুরুর প্রামাণ্য ইতিহাস কালের নিয়মে নষ্ট হয়ে গিয়েছে । রীতি মেনে জন্মাষ্টমীর দিন মা সিদ্ধেশ্বরীর বিশেষ পুজো করার পর স্থানীয় বড়পুকুর থেকে মাটি তোলা হয় । সেই মাটি কাঠামোর গায়ে ছুঁইয়ে মূর্তি গড়ার কাজ শুরু হয় । ঠাকুর দালানেই বংশপরম্পরায় শিল্পীরা প্রতিমা তৈরি করে থাকেন ৷
দুর্গামন্দিরের পাশেই আছে বোধন বৃক্ষ । পঞ্চমীর দিন নিয়ম মেনে দেবীর বোধন হয় ৷ ষষ্ঠীতে বাড়ির তৈরি মিষ্টি মাকে নৈবেদ্য হিসেবে অর্পণ করা হয় ৷ এছাড়াও এদিন বানানো হয় মুড়কি, নাড়ু ইত্যাদি অনেক কিছু । ষষ্ঠীর দিন খিড়কির পুকুরে মাকে স্নান করানো হয় ৷ সপ্তমী-অষ্টমী-নবমী তিনদিনই শাস্ত্র মতে পুজো করা হয় । দোতলা মন্দিরের ওপর তলায় থাকেন বোসবাড়ির কুলদেবী সিদ্ধেশ্বরী মা ।
খানাকুলের বোস বাড়ির দুর্গাপুজোর ইতিহাস জানুন (ইটিভি ভারত)
পুজোর সময় তাঁকে নামিয়ে এনে প্রথম পুজো করা হয় । দুর্গামায়ের সঙ্গে পুজো করা হয় গৃহলক্ষ্মীর । যিনি পুজোর 4টে দিনই শুধু নিজের ঘরের বাইরে থাকেন । অষ্টমীর দিন 108টি প্রদীপের সমাহারে মন্দির থেকে বলির স্থান পর্যন্ত আলোকিত করা থাকে । বোস বাড়ির পুজোতে অষ্টমীর দিনের বিশেষত্ব হল এদিন নিখুঁত কালো ছাগল বলি দেওয়া হয় ।
এছাড়া পুজোর তিনদিন এই বাড়ির 300 বছরের পুরনো খড়্গ ব্যবহার করে পুজো করা হয় । দশমীর দিন বাঁশের কলম দিয়ে নতুন তালপাতার ওপর 'দুর্গা' নাম লেখেন বাড়ির প্রত্যেক সদস্য । তারপর বাড়ির পুকুরেই বিসর্জন যান মা । প্রাচীন রীতিনীতির পাশাপাশি থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বিভিন্ন খেলাধুলার আয়োজন ।
এরপর কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন এখানে গজলক্ষ্মীর পুজো হয় । অষ্টলক্ষ্মীর প্রধান লক্ষ্মী হলেন গজলক্ষ্মী । এই দেবীর বাহন হাতি । পুরনো দিনে বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা ধন-সম্পদ রক্ষা করার জন্য গজলক্ষ্মীর পুজো করতেন । এই বাড়িতে কালীপুজোর দিন হয় সিদ্ধেশ্বরী পুজো । কালো কষ্টিপাথরের ঘট আকৃতি দেবী মূর্তির দু'পাশে আছেন মা সর্বমঙ্গলা ও মঙ্গলচণ্ডী । এই বাড়ির পূর্বপুরুষ নরনারায়ণ বসু ছিলেন তন্ত্রসাধক । তিনিই ভগবতী মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । ভগবতী মায়ের মন্দিরে যাওয়া আসার পথেই স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে তিনি করবী গাছের তলায় নাগবেষ্টন করা অবস্থায় মা সিদ্ধেশ্বরীকে লাভ করেন । সঙ্গে দুই সহচরী মা সর্বমঙ্গলা ও মঙ্গলচণ্ডী ।
বংশপরম্পরায় পুরোহিতরা দু'বেলা মায়ের নিত্যসেবা করে থাকেন । কালীপুজোর আগের দিন 14 শাক ও 14 বাতি দেওয়া হয় । পুজোর দিন সকালে এক পালি চাল, ঘি, পাতিলেবু, দুধ সহকারে মায়ের বিশেষ গাত্রমার্জনা ও অঙ্গরাগ করা হয় । বাড়ির বাইরে তুলসি তলায় কলাগাছের খোলের উপর এঁড়ে বাছুরের গোবর, ভাঙা কড়ি ও চুল আঁচড়ানোর পর ফেলে দেওয়া চুল দিয়ে অলক্ষ্মী তৈরি করা হয় । সূর্যাস্তের পর মশাল জ্বালিয়ে, ভাঙা কুলো বাজিয়ে ছড়া কাটতে কাটতে অলক্ষ্মী বিদায় করা হয় । এরপর মা সিদ্ধেশ্বরীকে লক্ষ্মীর ঘরে নিয়ে এসে মহালক্ষ্মীরূপে পুজো করা হয় । সেই সময় কলার খোলের প্রদীপ জ্বেলে বিশেষ আরতি করা হয় । একে বলা হয় সুখের প্রদীপ ।
বিশ্বাস করা হয় যে, এই প্রদীপের আলোতে বাড়ির প্রতিটি কোণে সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি ছড়িয়ে পড়বে ৷ এরপর মা সিদ্ধেশ্বরীকে কালীরূপে পুজো করা হয় । এই সময় সিদ্ধেশ্বরী, সর্বমঙ্গলা, মঙ্গলচণ্ডী এই তিন দেবীর মাথাতেই করবী গাছের ডাল দেওয়া হয় । ওই রাতে মাকে পাহারা দেওয়ার জন্য বাড়ির কোন না কোনও সদস্য লক্ষ্মীর ঘরে জেগে থাকেন । পরদিন সকালে ভোরের আলো ফোটার আগেই আবার মাকে মন্দিরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় । মা 364 দিন নিজের ঘরে থাকেন কিন্তু এই কালীপুজোর একটি দিনই লক্ষ্মীর ঘরে এসে অধিষ্ঠান করেন ।
পুজোর কটা'দিন রঙিন আলোয় সেজে ওঠে বোস বাড়ি । অষ্টমীর ধুনুচি নাচ থেকে নবমীর রাত্রের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মিলিয়ে জমজমাটভাবে সম্পন্ন হয় পুজো ৷