গোবরডাঙা, 12 জুলাই : বাম আমলে শাসকদলের কাউন্সিলর ছিলেন । অথচ রুজি-রুটির জন্য আজ তিনি ভ্যানচালক । গোবরডাঙা পৌরসভার 2 নম্বর ওয়ার্ডের প্রাক্তন কাউন্সিলর বাবু দাস ।
২ নম্বর ওয়ার্ডের গৈপুরে স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন বাবু দাস । ১৯৭১ সালে পূর্ববঙ্গ স্বাধীন হয় । শিকড়ছিন্ন বাবা-মায়ের হাত ধরে খুলনা থেকে পাড়ি দিয়েছিলেন এপার বাংলায় । নতুন সাকিন হয় গোবরডাঙা শহরের গৈপুরে । বামপন্থী আন্দোলনের প্রতি ছিল তাঁর অদৃশ্য টান । পারিবারিক দুরাবস্থার জন্য লেখাপড়া বিশেষ করতে পারেননি । কাঁধে তুলে নিতে হয় সংসারের জোয়াল । বিদ্যে না থাক । ছিল বুকের পাটা । রাত-দুপুরে মহল্লায় কারও বিপদের কথা কানে এলে ছুটে যেতেন । ২০০০ সালের পৌর নির্বাচন । ২ নম্বর ওয়ার্ডে CPI(M) প্রার্থী করল সেই বাবু দাসকে । বিপুল ভোটে জয়ী হলেন তিনি । ২০০৫ সালে পরের নির্বাচনেও সহজ জয় । ২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত টানা 10 বছর কাউন্সিলর । মাসে সাম্মানিক ভাতা ২৫০ টাকা । তা দিয়ে কি পেট ভরে? তাই সংসার চালাতে তাঁকে রোজ মুদি দোকান খুলতে হত । 2010-এর পর 2 নম্বর ওয়ার্ড মহিলা সংরক্ষিত হয়ে যায় । বাবু দাসেরও কাউন্সিলরের পদ থেকে ছুটি হয়ে যায় । এরপর ২০১১ সালে রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদল । ক্ষমতার সমীকরণ বদলাল গোবরডাঙাতেও । বাবু দাসের মুদি দোকান হাতছাড়া হয়ে গেল । ঘরে স্ত্রী ও তিন মেয়ে । কী করবেন ভেবে পেলেন না । অবশেষে প্রাক্তন কাউন্সিলর হয়ে গেলেন ভ্যানচালক ।
মেয়েদের বিয়ে দিলেন ঋণ করে । সেই দেনা শোধ করতে গিয়ে মাথা গোঁজার তিন কাঠা জমির অর্ধেক বিক্রি হয়ে গেল । ঘর যেখানে রয়েছে, সেই জমি ছেড়ে দিতে হবে কিছুদিন পরে । পড়ে থাকা জমিতে স্ত্রীকে নিয়ে মাথা গোঁজার জন্য একটা সরকারি ঘরের আবেদন করেছিলেন । পৌরসভায় কাউন্সিলরের চেয়ারে বসে একদিন তিনি হাজার হাজার মানুষের বাড়িতে সরকারি পরিষেবা পৌঁছে দিয়েছেন । আজ সেই পৌরসভায় তাঁকে রোজ যেতে হয় মাথা গোঁজার একটা সরকারি ঘর পাওয়ার জন্য । রোজ সকাল হলে বাবু দাস ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়েন রেল স্টেশনের দিকে । দিনভর শহরের বিভিন্ন রাস্তায় তাঁকে ভ্যান চালাতে দেখা যায় । স্থানীয় বাসিন্দা তথা গোবরডাঙা পৌরসভার কর্মী সুজিত মজুমদার বলেন, ‘‘আমি দীর্ঘদিন ধরে বাবু দাসকে চিনি । পৌরসভার কর্মী হিসেবে কাজ করার সুবাদে কাউন্সিলর হিসেবেও তাঁকে দেখেছি । অত্যন্ত সৎ ও আদর্শবাদী মানুষ । ক্ষমতায় থেকে নিজের আখের গোছানোর কথা ভাবেননি । চারদিকে জনপ্রতিনিধিদের একাংশের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের কথা আমরা শুনতে পাই । বাবু দাসকে দেখে তাঁরা ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষা নিতে পারেন ।’’ গোবরডাঙার বর্তমান পৌরপ্রধান তথা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সুভাষ দত্ত বলেন, ‘‘আমি বাবু দাসকে যতটা দেখেছি, তাতে বলতে পারি, তিনি একজন ভালো কাউন্সিলর ছিলেন । ক্ষমতায় থেকে আর্থিক লাভের শিক্ষা তাঁর ছিল না । লোভকে জয় করতে পেরেছিলেন । অসৎ জন প্রতিনিধিদের কাছে তাঁর জীবন একটা ভালো পাঠ হতে পারে ।’’
দশ বছরের কাউন্সিলর এখন ভ্যান চালান বাবু দাসকে সাহায্য করার জন্য তাঁর স্ত্রী জ্যোৎস্না দাস বাড়িতে নারকেলের পাতা থেকে ঝাঁটার কাঠি বের করেন । তাতে কিছু টাকা হয় । তিনি বলেন, ‘‘মানুষের জন্য আমার স্বামী কাউন্সিলর হয়েছিলেন । নিজের লাভের কথা ভাবেননি । আমার সংসারে অভাব আছে । তবু আমি আমার স্বামীর জন্য গর্ব করি ।’’ CPI(M)-এর দলীয় সদস্য । প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বা বিমান বসুর সঙ্গে সভা করেছেন । 10 বছরের কাউন্সিলর থেকে আজ তিনি ভ্যানচালক । জীবনটাকে কেমনভাবে দেখছেন? বৃদ্ধ বাবুর মুখে স্মিত হাসি । বললেন, ‘‘মানুষের কাজ করব বলে কাউন্সিলর হয়েছিলাম । আশা করি সেই কাজ ঠিকমতো করতে পেরেছি । তাই আজ প্রাক্তন হয়ে গেলেও সবাই আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন ।’’ জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশ্য কী বার্তা দেবেন? গোবরডাঙার প্রাক্তন কাউন্সিলর বলেন, ‘‘মানুষের জন্য কাজ করতে হবে । নিজের জন্য নয় । না হলে ক্ষমতা চলে গেলে মানুষও চলে যাবে । কেউ ভালোবাসবে না ।’’ যেকোনও পরিস্থিতিতে শেষ ট্রেনের যাত্রীকে ভ্যানে করে ঘরে পৌঁছে দেন বৃদ্ধ বাবু দাস । তিনি যেন তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই দীনু ডাক হরকরা । লহমায় গোবরডাঙা হয়ে ওঠে সেই হরিপুর পোস্ট অফিস । গৈপুরের বাঁকে শোনা যায় ডাক হরকরার বল্লমের ঘণ্টা- ‘‘ঝুন ঝুন ঝুন ।’’