পুরুলিয়া, 27 জুন : প্রত্যেক বছর বর্ষার শুরুতে শ্বাস ফেলার ফুরসৎটুকু থাকে না মাছ চাষিদের ৷ পুকুর লিজে নেওয়া, চারা কেনা, ঋণ নেওয়া -এই রকম হাজার কাজ থাকে তাঁদের ৷ এই ব্যস্ততার চিত্র পুরুলিয়ার মাছ চাষিদের ঘরে ঘরে ৷ এবছর অবশ্য এই ব্যস্ততার ছবিটা খানিক ফিকে ৷ তার কারণ- কোরোনা দাপট ৷ তার উপর লকডাউন ৷ পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় ভিনরাজ্য থেকে চাষিদের মাছ আনা হয়নি ৷ হয়নি মাছ চাষও ৷ আসেনি খদ্দের ৷ খদ্দের টানতে, অনেক মাছচাষি প্রায় অর্ধেক দামে মাছ বিক্রি করেছেন ৷ তবুও শেষ রক্ষা হয়নি ৷ শুকনো মুখ নিয়ে চাষিরা এখন প্রশাসনের দ্বারস্থ ৷ তবে, আশার বিষয় যে পুরুলিয়া জেলা মৎস্য চাষি উন্নয়ন সংস্থার আধিকারিক ডাঃ আলোকনাথ প্রহরাজ মাছ চাষিদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন৷ তাঁদের তরফে মাছচাষিদের এই দুর্দশা নিয়ে একটা সমীক্ষা চলছে ৷ তা হয়ে গেলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁরা ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন ৷
হতাশ মাছ চাষিরা জানান, "পুরুলিয়ার মাছের চারার চাহিদা ব্যাপক । কিন্তু এবছর কোরোনা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে । কোরোনা পরিস্থিতিতে বাস ও ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক না হওয়ায় বাইরে থেকে ক্রেতারা পুরুলিয়ায় আসছেন না। জেলার মাছ চাষিরা বাইরে মাছ পাঠাতে পারছেন না। গাড়ি বুক করে বাইরে মাছ পাঠালে খরচ বেশি পড়ছে । ফলে, লোকসানের মুখ দেখতে হচ্ছে আমাদের । অন্যান্য বছরগুলিতে এই সময়টিতে এক একজন মাছ চাষি প্রতিদিন প্রায় 10 হাজার টাকার মাছের চারা বিক্রি করতেন । কিন্তু এই বছর বিক্রি নেই।"
তাঁরা আরও জানান, " অন্যান্য বছর আগাম অর্ডার মতো নিয়মিত বড় বড় অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে ভিন্ন প্রজাতির মাছের চারা 6-8 জন শ্রমিকের মাধ্যমে কোথাও ট্রেনে, কোথাও বাসে করে পাঠানো হত । সেক্ষেত্রে যাতায়াতের খরচ কম পড়ত । কিন্তু, চলতি বছরে আগাম বুকিং নেই ৷ তাছাড়া বাস বা ট্রেন পরিষেবা স্বাভাবিক না হওয়ায় ভিন রাজ্য বা ভিন জেলার বাজারে মাছের চারা পাঠানো বন্ধ রয়েছে । বাধ্য হয়ে অর্ধেক দামে বিক্রি করছি ৷ "
মাছ চাষি গিরি ধীবর বলেন, "এই সময়টি মাছের চারা বিক্রির উপযুক্ত সময় । সারা বছর এই সময়টির দিকেই তাকিয়ে থাকি আমরা । কিন্তু এই বছর কোরোনা পরিস্থিতিতে চারা মাছ বিক্রি একদমই নেই । খদ্দেরও নেই ৷ তাই মাছ বিক্রি না হওয়ায় প্রচুর মাছ পুকুরেই মারা পড়ছে । অন্যান্য বছর এই সময়ে শহরের বাজারেই প্রতিদিন 10-12 কুইন্টাল মাছের চারা বিক্রি হত । সেই জায়গায় এই বছর মাত্র 50-60 কেজি করে মাছের চারা বিক্রি হচ্ছে । প্রতি বছর ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে আমরা মাছের চারা চাষ করে থাকি । কিন্তু এবার ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছি আমরা । ব্যাঙ্ক ঋণ কীভাবে শোধ করব, পরিবার কীভাবে চালাব ভেবে পাচ্ছি না ।"
গিরি ধীবরের সুরে মাছ চাষি বাচ্চু দাস বলেন, "আমরা মাছ চাষের উপর নির্ভরশীল । কিন্তু এই বছর মাছের বাজার একেবারে তলানিতে ঠেকেছে । কোরোনা পরিস্থিতির আতঙ্ক, বিশেষ করে যাতায়াতের অভাবে ব্যবসায়ীরা পুরুলিয়ায় আসছেন না। আমরাও মাছের চারা পাঠাতে পারছি না । মাছের চারা বিক্রির আগাম বুকিংও বাতিল হয়ে গিয়েছে। তাই পুকুরেও প্রচুর মাছ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । মাছ চাষিদের সাহায্যের জন্য জেলা মৎস্য বিভাগ কোনও বছরই আগাম কোনও পরিকল্পনা নেয়নি। আর এই বছর, মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে এখনও কোনও সহযোগিতা মেলেনি । চারা মাছ বেশিদিন রাখার মতো ব্যবস্থা নেই জেলায়। আমরা এই মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য প্রশাসনের সাহায্যের আর্জি জানাচ্ছি । প্রশাসন যদি আমাদের পাশে দাঁড়ায় তাহলে খুবই উপকৃত হব ।"
বিষয়টি নিয়ে পুরুলিয়া জেলা মাছ চাষি উন্নয়ন সংস্থার আধিকারিক ডাঃ আলোকনাথ প্রহরাজ বলেন, "কোরোনা পরিস্থিতি মৎস্য চাষিদের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে । কারণ বাইরের জেলা থেকে সঠিক সময়ে মাছের ডিম সংগ্রহ করতে পারেননি তাঁরা । কারণ, পুরুলিয়ায় একটি মাত্র মৎস প্রজনন ক্ষেত্র রয়েছে । তাই মাছের ডিম উৎপাদন জেলায় অতি অল্প পরিমাণে হয় । কেউ কেউ মাছের চারা সংগ্রহ করে চাষ করলেও সেই মাছের চারা খদ্দেরদের অভাবে বিক্রি হচ্ছে না। অনেকেই আবার লক ডাউনের কারণে মাছের ডিম সংগ্রহ করতে পারেননি । তাই এই বছর বড় মাছ চাষের আশাটাও কম । ভবিষ্যতে মাছের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ।"
নিজেদের অবস্থান নিয়ে তিনি জাননা, "আমরা মাছ চাষিদের পাশে রয়েছি । মৎস দপ্তরের খাতায় নথিভুক্ত 1 লাখ 24 হাজার 191 জন মৎস্যজীবী রয়েছেন । প্রতি বছরই মৎস্য চাষিদের খাবার বিলি, মাছের ডিম বিলি করা হয়ে থাকে । এর বাইরেও পুরুলিয়ায় বহু মৎস্য চাষি রয়েছেন । তবে নতুন করে এই বছর কাউকে সরকারি খাতায় নথিভুক্ত করা হয়নি । আগে সার্ভে করে দেখা হবে কোথায় কী রকম ক্ষতি হয়েছে । তারপর সেইমতো উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে ।"