আতঙ্কে করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় আহতরা ভাতার, 3 জুন: প্রচণ্ড জোরে ছুটছিল করমণ্ডল এক্সপ্রেস। বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ওড়িশার বালাসোর ছাড়ার প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে হঠাৎ বিকট আওয়াজ হয় তারপরেই মানুষের আর্তনাদ । এখানে ওখানে কেউ মৃত অবস্থায়, কেউ রক্তাক্ত অবস্থায় বাঁচার আর্জি জানিয়ে চিৎকার করে চলেছে । ওই জায়গা থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে যে বাড়ি ফিরব ভাবিনি ৷ বলছেন ট্রেন দুর্ঘটনার সাক্ষী পূর্ব বর্ধমানের ভাতারের বামশোরের বাসিন্দা শেখ পটু-সহ অন্যান্যরা।
শুক্রবার ভাতারের বামশোর এলাকা থেকে দশ জন মিলে কেরলে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে যাচ্ছিলেন । হাওড়া থেকে তাঁরা করমণ্ডল এক্সপ্রেসে চাপেন । ট্রেনে ছিল খুব ভিড় । প্রচণ্ড জোরেও ছুটছিল ট্রেনটি । ওড়িশার বালাসোরের কাছে বাহাঙ্গা স্টেশনের কাছে জোরাল শব্দে কেঁপে ওঠে ট্রেনের যাত্রীরা । তারপরেই সব অন্ধকার । শুরু হয় হয় মানুষের আর্তনাদ । এখানে ওখানে ছিটকে পড়ে আছে যাত্রীরা। ফলে যে যার পরিচিতকে খোঁজার জন্য চিৎকার করে ডাকতে শুরু করে । যারা কম চোট পায় তাদের মধ্যে কেউকেউ মোবাইলের আলো জেলে কামরার ভেতরে দেখার চেষ্টা করে । দেখে ট্রেনটা অন্য একটা ট্রেনের উপরে চেপে গিয়েছে । জ্বলছে ট্রেনের বগি।
আরও পড়ুন:'যাকে ফোন করছেন তিনি মারা গিয়েছেন', ওপার থেকে জানাল অচেনা কেউ; উৎকণ্ঠায় বামনগোলার পরিবার
এ দিকে কামরার মধ্যে রক্ত বয়ে যাচ্ছে । কেউ কেউ হয়তো সেখানেই মারা গিয়েছে ৷ আবার কেউ কেউ জলের জন্য বাঁচার আশায় বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করে চলেছে । কেউ পরিবার পরিজনকে খুঁজে পেয়েছে, কেউ পায়নি । এই অবস্থায় কাঁচের জানালা ভেঙে কেউ কেউ বের হতে শুরু করে । ট্রেনের বগির মধ্যে আহত বা মৃত অবস্থায় যারা পড়ে আছে তাদের গায়ে পা দিয়েই তখন অন্যান্যরা নিজেদের প্রাণ বাঁচিয়ে জানলা দিয়ে নামতে ব্যস্ত । সেখান থেকে জানলা দিয়ে বের হওয়ার পরে স্থানীয় মানুষজন ও পুলিশের সহযোগিতায় অনেকেই অল্প বিস্তর আহত হয়ে পাকা রাস্তায় পৌঁছে যায় । তবে রাতের অন্ধকারে সেখানে গাড়ি মেলেনি । সেখান থেকে ফোনে যোগাযোগ করে গাড়ি ভাড়া জোগাড় করে আজ কোনমতে নিজেদের বাড়ি পৌঁছয় আহতরা ।
ভাতারের বামশোরের বাসিন্দা শেখ পটু বলেন, "করমণ্ডল এক্সপ্রেসে চেপে কেরল যাচ্ছিলাম । সেখানে রাজমিস্ত্রীর কাজ করি আমরা । বিকেল ছটা নাগাদ গাড়ি বালেশ্বরে পৌঁছয় । তারপর প্রায় ঘণ্টাখানেক পড়ে একটা বিকট আওয়াজ শুনতে পাই । সেই আওয়াজ শুনে আমরা খুব ভয় পেয়ে যাই । এরপরেই আমরা সবাই ছিটকে পড়ি এখানে ওখানে । কামরার লাইট নিভে যায় । সব অন্ধকার । কিছুই বুঝতে পারছিলাম না । কিছুক্ষণ পরে মোবাইলের আলো জ্বেলে দেখি আমাদের গাড়ির কামরা অন্য গাড়ির উপরে চেপে গিয়েছে । গাড়ির মধ্যেই অনেকেই রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল । আমরা উপায় না থাকায় তাদের গায়েই পা দিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে বের হই ।"
আরও পড়ুন:জানালা ভেঙে ট্রেনের ছাদে উঠে প্রাণে বাঁচলেন সুন্দরবনের 12 জন বাসিন্দা
তিনি আরও বলেন, "পুলিশ আমাদের সাহায্য করে । মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে দেহের উপর দিয়েই আমরা বের হয়েছি । এর মধ্যে শুধু ছিল মানুষের আর্তনাদ । কেউ বলছে বাঁচাও, কেউ বলছে জল দাও ৷ তখন আমরা নিজেদের বাঁচাতে ব্যস্ত । আমাদের যাবতীয় ব্যাগ ট্রেনেই পড়ে আছে । আমরা কেউ কাউকে দেখতে পাইনি । ট্রেনের মধ্যেই সকলে কান্নাকাটি শুরু করে । ভেবেছিলাম মরেই গেছি । পরে জানালা দিয়ে আমাদের বের করা হয় । পুলিশ ও স্থানীয়রা আমাদের মূল রাস্তায় পৌঁছে দেয় । সেখান থেকে অনেক কষ্টে গাড়ি জোগাড় করি । এরপর বাড়ির দিকে রওনা দিই । এখনও আতঙ্কে রয়েছি ৷ কিছু ভাবতে পারছি না ৷"
আরও পড়ুন:আসছি বলে চলে গেলেন, রেল দুর্ঘটনায় মৃত ডুয়ার্সের শ্রমিকের দেহ ফেরাতে হিমশিম পরিবার
শেখ নাসরুল জানান, করমণ্ডল এক্সপ্রেসে চেপে চেন্নাই যাচ্ছিলেন । খুব জোরে ট্রেন ছুটছিল । তাঁরা দশজন ছিলেন । খুব কষ্টে কাঁচ ভেঙে তাঁদের বের করা হয় । এরপর স্থানীয়রা উদ্ধার করে তাঁদের মূল রাস্তায় নিয়ে যায় । ভাতারের বামশোরের বাসিন্দা শেখ সবুজ জানান, কেরলে রাস্তমিস্ত্রি জোগাড়ের কাজে যাচ্ছিলেন । যখন দুর্ঘটনা ঘটে তখন গাড়িটা খুব জোরে দুলছিল । তারা প্রথমে বুঝতে পারিনি কী হচ্ছে । যখন বুঝতে পারেন তখন প্রাণ বাঁচাতে জানলার কাঁচ ভেঙে বাইরে বের হন । তাঁর বুকে ও পাঁজরে আঘাত লেগেছে । বেঁচে বাড়ি ফিরবেন ভাবেননি বলে জানাচ্ছেন তিনি ।