কর্ণসুবর্ণ, 27 জুলাই : মুর্শিদাবাদ জেলার অন্যতম স্থান কর্ণসুবর্ণ ৷ এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম ৷ কিন্তু, শুধুমাত্র রক্ষণাবেক্ষণ এবং সরকারি উদ্যোগের অভাবে আজও লোকচক্ষুর অন্তরালেই কর্ণসুবর্ণ ৷ এখনও পর্যটক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠল না সপ্তম শতাব্দীর গৌরবময় গৌড় রাজ্যের অধিপতি শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ ।
শুধু শশাঙ্কের রাজধানী হিসেবে নয়, ইতিহাস বলছে, একসময় এখানে ছিল ভারতের সবথেকে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার । যেটি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকেও প্রাচীন বলে হিউয়েন সাঙের বর্ণনা থেকেই প্রমাণ মেলে । পাশাপাশি প্রাচীন বৌদ্ধ পিঠের অনেক নিদর্শনও এখানে মিলেছে । হিউয়েন সাঙ এর বর্ণনা অনুযায়ী স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ এখানে এসেছিলেন ধর্ম প্রচার করতে । এমনকী সম্রাট অশোক নির্মিত বৌদ্ধস্তুপের বহু নিদর্শন পাওয়া গেছে কর্ণসুবর্ণতে ।
ঐতিহাসিক দিক দিয়ে অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য আজ অবহেলায় ধুঁকছে ৷ দখল হয়ে যাচ্ছে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধিগৃহীত জমি । শশাঙ্কের রাজধানী এখন কার্যত গোচারণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে । অথচ এই এলাকাটি ঘিরে বিরাট পর্যটন কেন্দ্র গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল বলেই মনে করে স্থানীয় বাসিন্দারা। সরকার বিশেষ নজর না দেওয়ায় স্থানীয় মানুষদের মধ্যেও ক্ষোভ বাড়ছে ৷
মুর্শিদাবাদ জেলার আনাচে-কানাচে পা রাখলেই ইতিহাসের নিদর্শন পাওয়া যায় । এমনই একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্য যার নাম কর্ণসুবর্ণ । বহরমপুর শহর থেকে ভাগীরথীর পশ্চিমপাড় বরাবর 14 কিলোমিটার গেলেই মিলবে এই স্থাপত্যের ভগ্নাবশেষ । বিভিন্ন সময়ে খননকার্য চালিয়ে ঐতিহাসিকরা এবং পুরাতত্ত্ব বিভাগের গবেষকরা বহু প্রাচীন তথ্য এখান থেকে সংগ্রহ করেছেন । খননকার্যে মাটির নিচ থেকে উঠে এসেছে তাম্র, ব্রোঞ্জের নানান মূর্তি এবং অজস্র মাটির সিলমোহর । অনুসন্ধান চালিয়ে মাটির তলা থেকে মিলেছে রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার । আবিষ্কৃত হয়েছে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নানান ঘর । কোনওটা বসবাসের জন্য, কোনওটি শ্রেণিকক্ষ । কর্ণসুবর্ণের মাটির তলা থেকে তৃতীয় অথবা চতুর্থ শতাব্দীর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ধান মিলেছে । নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে তৈরি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় ইতিহাস মাটির তলায় চাপা পড়ে লোক চক্ষুর অন্তরালে রয়ে গিয়েছে শুধুমাত্র অবহেলার কারণে ।
রাজা শশাঙ্কের প্রাসাদ নামে পরিচিত 60 বিঘা এলাকা বিস্তৃত ঢিপিটির 1862 সালে খননকার্য শুরু করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এস আর দাস । 20 বছর ধরে চলে এই খননকার্য । আবিষ্কৃত হয় বৌদ্ধ বিহার ও বিভিন্ন সিলমোহর। হিউয়েন সঙের বর্ণনা অনুযায়ী এটাই ছিল ভারতবর্ষের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার । খননকার্যে তার একাধিক প্রমাণ মিলেছে । পাওয়া গিয়েছিল দ্বিতীয় তৃতীয় শতকের বসতির প্রমাণও । ঢিপির তল থেকে মিলেছে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ব্যবহৃত নানান সরঞ্জাম, তাদের ব্যবহারের শয়নকক্ষ, পঠন পাঠন কক্ষ। এমনকী স্নান করার কুয়োও মিলেছে । হিউযেন সাঙ তাঁর গ্রন্থে এই জায়গার স্পষ্ট বর্ণনা দিয়ে গেছেন । তার বর্ণনা থেকেই জানা গিয়েছে এটি প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার । খননকার্য থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে, এটি ছিল (600-638) খ্রিস্টাব্দের গৌড় অধিপতি শশাঙ্কের রাজধানী । 1844 সাল থেকে 150 বছরেরও বেশি দিন ধরে লেয়ার, বিভারিজ, ডক্টর সুধির রঞ্জন দাস, নিখিলনাথ রায় এই ঢিপিটির উপর খননকার্য চালিয়ে বহু প্রাচীন নিদর্শন আবিষ্কার করেছেন । যেগুলি শশাঙ্কের রাজধানী, রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার, গৌতম বুদ্ধের ধর্ম প্রচারের প্রত্যক্ষ প্রমাণ হিসেবে আজও রয়ে গেছে । এখন এই স্থানটি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধীনে রয়েছে ৷
রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পর্যটন কেন্দ্র হওয়া হল না কর্ণসুবর্ণের স্থানীয় বাসিন্দাদের আক্ষেপ এই স্থানকে ঘিরে বিশাল পর্যটন কেন্দ্র গড়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকলেও এখনও তা গড়ে ওঠেনি । স্থানীয় বাসিন্দা ফিরোজ হোসেন, লাল্টু শেখ এর বক্তব্য, মুর্শিদাবাদে লক্ষ্য লক্ষ্য পর্যটকের পা পড়ে। কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র কয়েকজন ইতিহাসের টানে কর্ণসুবর্ণ পর্যন্ত এসে পৌঁছান । পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠলে এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটত। স্থানীয় মানুষ উপকৃত হত। ঐতিহাসিক স্থাপত্য লাগোয়া ব্যবসায়ী আব্দুল তহিদ শেখ বলেন, এখানে ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ । পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠলে ব্যবসার হাল ফিরত । বহুদিন থেকে শুনে আসছি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠবে কিন্তু আজও গড়ে ওঠেনি । স্থানীয় মানুষ এবং ব্যবসায়ীদেরকে সমর্থন করে মুর্শিদাবাদ জেলা ইতিহাস ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রের সম্পাদক অরিন্দম রায় বলেন, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় আজ পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে যে স্ট্যাটাস পেয়েছে তারও আগে তৈরি বিশ্ববিদ্যালয় রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার সে স্ট্যাটাস পেল না । গৌতম বুদ্ধ, সম্রাট অশোকের মতো মানুষের পায়ের ছাপ যেখানে রয়েছে সেখানে আজও পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠল না এটা আমাদের কাছে দুর্ভাগ্য। আমরা বারবার দাবি করেছি। আজও করছি। কিন্তু আমাদের দাবি সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি । পাশাপাশি অরিন্দম বাবুর অভিযোগ , বহু নিদর্শন বেহাত হয়ে গেছে । খনন কার্যের ফলে যে প্রাচীন নিদর্শন গুলি পাওয়া গিয়েছিল সেগুলি জেলার বাইরে চলে গিয়েছে । সেগুলো নিয়ে সংগ্রহশালা গড়ে তুললে জেলার অর্থনৈতিক হাল পাল্টে যেতে পারত ।
খননকার্য থমকে রয়েছে । এখনো বহু প্রাচীন নিদর্শন মাটির তলায় চাপা পড়ে আছে বলে দাবি অনেকের । সেগুলি কি মাটির তলাতেই চাপা পড়ে থাকবে? প্রশ্ন তুলেছেন ইতিহাসবিদদের অনেকেই ।