টোটো চালিয়ে গরিব ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদান মালদা, 27 মার্চ: স্বার্থের পৃথিবীতে তিনি ধ্রুব দাস নন, যেন ধ্রুবতারা ৷ একসময় স্বপ্ন দেখতেন, উচ্চশিক্ষিত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হবেন ৷ সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচবেন ৷ কিন্তু পরিবারের আর্থিক অনটন তাঁকে সেই সুযোগ দেয়নি ৷ উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেই কলমের হাত বদল হয়েছে টোটোর হ্যান্ডেলে ৷ কিন্তু যাঁর চোখে অফুরান স্বপ্ন, তাঁকে আটকায় কে ! এখন তিনি এই শহরকে শিক্ষিত করার স্বপ্ন দেখেন ৷ তাই প্রতিদিন সকালে দু’ঘণ্টা গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েদের নিয়ে চলে ধ্রুব মাস্টারের ক্লাস ৷ সেখান থেকে অর্থলাভ তো দূরের কথা, নিজের উপার্জনের কিছু অংশ ছেলেমেয়েদের জন্য খরচ করতে হয় তাঁকে (Toto driver gives Free tuition to poor students) ৷
ধ্রুব মাস্টারের ক্লাসে গরিবদের বিনামূল্যে শিক্ষাদান বছর বিশের তরতাজা যুবক ধ্রুব ৷ বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের জোয়াল এখন তাঁর কাঁধে ৷ পড়াশোনা করে উচ্চশিক্ষিত হওয়ার খুব স্বপ্ন ছিল ৷ সংকট সেই স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে ৷ ইংরেজবাজার পৌরসভার 23 নম্বর ওয়ার্ডের তেলিপুকুর জগন্নাথ কলোনিতে তাঁর বাড়ি ৷ বাড়ি থেকে 30 মিনিট হাঁটাপথ পেরোলে নরসিং কুপ্পা ৷ পৌরসভার মধ্যে হলেও ওই এলাকার প্রতিটি কোনায় অনুন্নয়নের ছোঁয়া ৷ বাসিন্দাদের প্রত্যেকেই গরিব ৷
নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাওয়া সংসার৷ ফলে ছেলেমেয়েদের শিক্ষার কথা তাঁদের মাথায় আসে না ৷ মিড ডে মিল খেতেই যেটুকু স্কুলে যাওয়া ৷ সেই এলাকাতেই শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার ব্রত নিয়েছেন ধ্রুব ৷ প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে ন’টা পর্যন্ত পৌরসভার একটি অর্ধনির্মিত শৌচালয়ে ছেলেমেয়েদের পড়ান তিনি ৷ মনের খিদে মিটিয়ে বেরিয়ে পড়েন পেটের খিদে মেটাতে ৷ তবে ওই ছোট্ট ঘরে অত ছেলেমেয়ে বসতে পারে না ৷ বাধ্য হয়ে অনেককে বাইরে গাছতলায় বসতে হয় ৷
সকাল 7টা থেকে 9টা দু’ঘণ্টা করে চলে ধ্রুব মাস্টারের ক্লাস ধ্রুব জানান, বছরখানেক ধরে এখানকার ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন তিনি ৷ এখন প্রায় 50 জন ছেলেমেয়ে তাঁর কাছে পড়ে ৷ আর্থিক সংকটে নিজে উচ্চমাধ্যমিকের পর পড়তে পারিনেনি তিনি ৷ এই সংকটে এলাকার অসংখ্য ছেলেমেয়ের পড়াশোনা মাঝপথেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে ৷ আর কেউ যাতে এই অবস্থায় না পড়ে, সেটাই তিনি চান ৷ এই এলাকার আর্থ সামাজিক পরিবেশও ভালো নয় ৷ মূলত শ্রমিক পরিবারের বাস ৷ আর্থিক সমস্যায় এখানকার বাচ্চারা শিক্ষা থেকে দূরে চলে যাচ্ছে বলে তাঁর মত ৷
তিনি বলেন, "এমন চলতে থাকলে ওইসব বাচ্চাদেরও হয়তো একসময় আমার মতো টোটো চালাতে হবে ৷ সেটা আমি চাই না ৷ প্রথমে যখন এখানে পড়াতে এসেছিলাম, তখন পড়াশোনার মাহাত্ম্য এলাকাবাসীকে বোঝাতে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল ৷ তবে ধীরে ধীরে স্থানীয়রাও আমাকে সাহায্য করতে শুরু করেন ৷ আমি এই এলাকায় পড়াশোনার পরিবেশ তৈরি করতে চাই ৷ আমি জানি, আমার ছেলেমেয়েরা একদিন জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আমার পরিশ্রমের মূল্য দেবেই ৷"
ধ্রুবর কাছে পড়তে এসেছিল এলাকারই সুমিত্রা মণ্ডল ৷ মালদা রেলওয়ে হাইস্কুলের ক্লাস এইটের ছাত্রী ৷ সে জানায়, বাবা গুদামের শ্রমিক ৷ বাড়িতে অভাব নিত্যসঙ্গী ৷ এদিকে তারা তিন ভাইবোন ৷ সে পড়াশোনা করতে চায় ৷ অভাবের জন্য এতদিন তাঁর কোনও গৃহশিক্ষক ছিল না ৷ শেষ পর্যন্ত এক বছর আগে ধ্রুব স্যার এখানে আসেন ৷ তাদের বিনা পয়সায় পড়ানো শুরু করেন ৷ তাঁর কাছে পড়তে খুব ভালো লাগে বলে জানায় সুমিত্রা ৷
স্থানীয় অষ্টমী পাহাড়ি বলেন, "আমার স্বামী পরিযায়ী শ্রমিক ৷ আমাদের দুটো মেয়ে ৷ দু’জনেই ধ্রুবর কাছে পড়ে৷ ও যে কাজ করছে, তার কোনও তুলনা নেই ৷ এখানকার সবাই খুব গরিব৷ ধ্রুব আমাদের কাছে যেন ত্রাতা হয়ে এসেছে ৷ সবাইকে বিনে পয়সায় পড়ায়৷ শুধু তাই নয়, নিজের টাকায় বাচ্চাদের বই-খাতা, কলম, এমনকি খাবারও খাওয়ায় ৷ ওর জন্যই এলাকায় শিক্ষার একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে ৷ তবে ওর পড়ানোর জায়গাটা খুব ছোট হয়ে গিয়েছে ৷ বিষয়টি কাউন্সিলরকে বলতে হবে ৷"
এনিয়ে ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সুজিতকুমার সাহার বক্তব্য, কিছুদিন আগেই ধ্রুবর পড়ানোর বিষয়ে খবর পেয়েছেন তিনি ৷ ছেলেটি খুব ভালো উদ্যোগ নিয়েছে ৷ আপাতত ও পৌরসভার একটি অর্ধনির্মিত শৌচালয়ে বাচ্চাদের পড়াচ্ছে ৷ এটা ভালো লাগছে না ৷ তাই তাঁরা ঠিক করেছেন, ছেলেমেয়েদের পড়ানোর জন্য একটা ব্যবস্থা করে দেবেন ৷ তাঁর যদি কোনওকিছুর প্রয়োজন হয়, সেটাও তাঁদের জানাতে বলেছেন তিনি ৷ সুজিত বলেন, "ধ্রুবকে সবরকম সহযোগিতা করতে আমি প্রস্তুত রয়েছি ৷ তবে সমাজে কিছু মানুষ আছে বলেই সমাজটা ঠিক আছে ৷ আমার মনে হয় প্রতিটি মানুষ যদি নিজের উপার্জনের কিছু অংশ সমাজের জন্য ব্যয় করেন, তবে এই সমাজ আরও সুস্থ হবে ৷ ঠিক যেভাবে সমাজকে সুস্থ করার ব্রত নিয়ে নেমে পড়েছে ধ্রুব ৷"
আরও পড়ুন:মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে পরিষেবা দুর্গাপুরের দুই টোটো চালকের