মালদা, 12 জুন: লকডাউনে বিভিন্ন রাজ্য থেকে ঘরে ফিরেছেন জেলার পরিযায়ী শ্রমিকরা৷ সরকারি নির্দেশ মেনে 14 দিন কোয়ারানটিন পর্ব শেষেই ঘরে ফিরেছেন অনেকে৷ কিন্তু, ঘরে ফিরতেই দেখা দিয়েছে বিপত্তি৷ বিপত্তি একটাই, আর্থিক সংকট ৷ প্রায় তিন মাসের লকডাউনে শূন্য ভাঁড়ার৷ অন্যদিকে, এই মুহূর্তে পরিবারের সদস্যদের জন্য অন্ন সংস্থানের কোনও পথ খোলা নেই রাজ্যে৷ বলছেন শ্রমিকরা৷ তাঁদের অভিযোগ, সরকার 100 দিনের কাজের কথা বললেও তার সুফল সকলে পাচ্ছেন না৷ তাঁরা জানাচ্ছেন, রেশনের কয়েক কিলো চাল-ডালে সমস্যা মেটার নয়৷ মিটছেও না৷ এমন অবস্থায় পেটে গামছা বেঁধে বসে থাকার বদলে ফের ভিনরাজ্যমুখী মালদার বহু পরিযায়ী শ্রমিক ৷ অনেকে ইতিমধ্যে রওনা দিয়েছেন পুরানো কর্মস্থলে৷ অনেকে পুঁটুলি বাঁধতে ব্যস্ত৷ কোরোনা আবহে এই শ্রমিকদের অবস্থান খুব স্পষ্ট৷ বাড়িতে থেকে না খেয়ে মরার থেকে কোরোনায় আক্রান্ত হয়ে মরা ভালো৷ এই ছবি ধরা পড়েছে ইংরেজবাজার ব্লকের অমৃতি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়৷ তবে, শুধু এই এলাকায় নয়, গোটা জেলাজুড়ে একই ছবি৷ পরিস্থিতির কথা স্বীকার করে নিয়েছেন ইংরেজবাজার পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষও৷ যদিও বিষয়টি জানা নেই বলে মন্তব্য BDO-র৷
কোরোনা মোকাবিলায় 24 মার্চ থেকে দেশজুড়ে চলেছে লকডাউন৷ সম্প্রতি তা শিথিল হলেও গোটা দেশেই কর্মক্ষেত্রে লকডাউনের কালো প্রভাব পড়েছে৷ এই অবস্থায় জেলা প্রশাসনের হিসেবে ভিনরাজ্যে কাজ করতে যাওয়া মালদার দেড় লাখের বেশি শ্রমিকের মধ্যে প্রায় 35 হাজার পরিযায়ী শ্রমিক জেলায় ফিরেছেন৷ সংখ্যাটা খানিক বেশিও হতে পারে৷ যেহেতু নানা উপায়ে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে আটকে পড়া অসহায় শ্রমিকরা জেলায় ফিরেছেন৷ কিন্তু, ভিনরাজ্যে কাজ হারিয়ে ঘরে ফিরে এলেও এই পরিযায়ী শ্রমিকরা পড়েছেন আরেক সমস্যায়৷ তাঁদের অভিযোগ, এলাকায় কাজ পাচ্ছেন না তাঁরা৷ এদিকে ভিনরাজ্য়ে আটকে পড়া অবস্থায় ও সেখান থেকে ফেরার ব্যবস্থা করতেই সর্বশান্ত হয়ে বসে আছেন ৷ পরিবারের লোকজন অনলাইনে টাকা পাঠানোর পরেই তাঁরা বাস-লরি ভাড়া করে ফিরেছেন৷
জেলায় এই সময় আমবাগানগুলিতে কিছু কাজ থাকে৷ কিন্তু, প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য এবার সেই কাজও তেমন নেই৷ সরকারের পক্ষ থেকে কয়েক কিলো চাল, ডাল আর আলু মিলেছিল৷ সেসব কবেই শেষ হয়ে গিয়েছে৷ জানাচ্ছেন শ্রমিকরা৷ অনেকে 100 দিনের কাজ করতে চাইলেও তা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ৷ কবে সেই কাজ পাবেন তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই৷ এই অবস্থায় খিদে থেকে বাঁচতে ঘরে ফিরে আসা শ্রমিকদের অনেকেই সব জেনেশুনেও মৃত্যুগহ্বরেই ঝাঁপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ তাঁরা ফের ভিনরাজ্যে ফিরতে শুরু করেছেন৷
অমৃতির মোমিনপাড়া গ্রামের বাসিন্দা রাজু মোমিন বলেন, "আমি হায়দরাবাদে কাজ করতে গিয়েছিলাম৷ লকডাউন ঘোষণার পর সেখানে কাজ বন্ধ হয়ে যায়৷ অনেক কষ্ট করে গ্রামে ফিরি৷ কিন্তু, এখন ঠিকমতো খেতে পাচ্ছি না৷ বন্ধন ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেওয়া ছিল৷ ঋণ শোধ দেওয়ার জন্য ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ চাপ দিচ্ছেন৷ এদিকে এখানে কোনও কাজ নেই৷ কাজ না থাকলে কীভাবে চলব? বাইরে যেতেই হবে৷ আমি যে ঠিকাদারের মাধ্যমে হায়দরাবাদে কাজ করতে গিয়েছিলাম তিনি জানিয়েছেন, ওখানে কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে৷ তবে এখান সেখানে গেলে প্রথমে 14 দিন কোয়ারানটিনে থাকতে হবে৷ ওই 14 দিন টাকাপয়সা দেওয়া হবে না৷ কিন্তু সেখানে নিজের পয়সায় 14 দিন কাটানোর পর অন্তত কাজ পাব৷ সংসারটা চলবে৷ তাই সেখানেই ফিরে যাচ্ছি৷"
রাজু মোমিন আরও জানাচ্ছেন, "এখানে ফেরার পর খানিকটা চাল ছাড়া সরকারি কোনও সাহায্য পাইনি৷ 100 দিনের কার্ড আমার আছে৷ কিন্তু, এখনও কাজ পাইনি৷"
একই বক্তব্য মহারাষ্ট্র ফেরত পরিযায়ী শ্রমিক রব্বানি খানের৷ তিনি বলেন, "এখানে কোনও রোজগার নেই৷ পেট চালাতে আমাদের ভিনরাজ্য যেতে হচ্ছে৷ আমাদের জন্য কেন্দ্র কিংবা রাজ্য সরকারের কোনও ভাবনাই নেই৷ শুধু আমি নই, আমাদের গ্রামের একজন গরিব মানুষও সরকারের কাছ থেকে কোনও সাহায্য পায়নি৷ কারোর বাড়িতে খাবার নেই৷ আমার আব্বা-আম্মার বয়স 80 বছর পেরিয়েছে৷ বাড়িতে আটজন সদস্য৷ আমি একমাত্র উপার্জন করি৷ যেদিন মহারাষ্ট্র পৌঁছাই, সেদিনই লকডাউন ঘোষণা হয়৷ সাতদিন না খেয়ে দিন কাটিয়েছি৷ সেখানে চিকিৎসা পরিষেবার কোনও ব্যবস্থা ছিল না৷ শেষ পর্যন্ত বাড়ির দুটো ছাগল বিক্রি করে পরিবারের লোকজন ঘরে ফেরার ভাড়া পাঠায়৷ অনেকদিন কাজ না করে বসে থাকতে হয়েছে৷ এদিকে সংসারের চাপও রয়েছে৷ রাজ্য সরকার আমাদের কাজ দিতে পারে না৷ তাই ভিনরাজ্যে যাওয়া ছাড়া আমাদের কোনও উপায় নেই৷"