কলকাতা , 6 জুলাই : উমার মৃণ্ময়ী মূর্তি তৈরিতে আবশ্যক পতিতালয়ের মৃত্তিকা । অন্তত শাস্ত্র তাই বলে । হিন্দু শাস্ত্র মতে , দুর্গা প্রতিমা গড়তে কয়েকটি বিশেষ উপকরণ প্রয়োজনীয় । যেমন, গাভীর মূত্র , গোবর , ধানের শিষ , গঙ্গার জল , রাজবাড়ির মাটি , চৌমাথার মাটি , গজদন্ত মৃত্তিকা , গঙ্গার দুই তীরের মাটি ও নিষিদ্ধ পল্লির মাটি । দুর্গা মূর্তি গড়ার জন্য বিশ্বজোড়া বিখ্যাত কুমোরটুলি । কিন্তু, শাস্ত্র মেনে পতিতলয়ের মৃত্তিকা ব্যবহার করেই কি এখনও এখানে মহামায়ার মূর্তি গড়েন শিল্পীরা ? খোঁজ নিতে কুমোরটুলি পৌঁছে গেছিল ETV ভারত । সেখানকার শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল , প্রত্যেকেই জানেন দেবীর মূর্তি গঠনে কোনও এককালে পতিতলয়ের মৃত্তিকা ব্যবহার করা হত । কিন্তু, অধিকাংশ শিল্পীই নিজেদের কর্মজীবনে সেখানকার মাটি মৃণ্ময়ী মূর্তি গঠনে ব্যবহার করেন না ।
কেন পতিতালয়ের মাটি ছাড়া গড়া হয় না দুর্গা প্রতিমা ? একাধিক ব্যাখ্যা রয়েছে পুরাকাল থেকে চলে আসা এই রীতির । একটি ব্যাখ্যা অনুযায়ী , পতিতালয়ের মাটি পবিত্র । একজন পুরুষ যখন পতিতালয়ে গিয়ে যৌনকর্মে লিপ্ত হন তখন তাঁর জীবনের সঞ্চিত সব পূণ্য সেখানে ফেলে আসেন । আর তাঁর যৌনাচারের জন্য সেখান থেকে সংগ্রহ করে আসেন পাপ । এভাবেই বহু পুরুষের পূণ্য জমতে জমতে নিষিদ্ধ পল্লির মাটি হয়ে ওঠে পবিত্র । সেই কারণেই দেবী মূর্তি তৈরিতে অনস্বীকার্য সেখানকার মাটি । আর একটি ব্যাখ্যা , শরৎকালে দেবীর অকালবোধন হয় । এই সময়ে মহামায়া নয়টি রূপে পূজিত হন । এই নয়টি রূপ হল বিনোদিনী , কাপালিনি , ধোপানি , নাপিতিনি , ব্রাহ্মণী , শূদ্রাণী , গোয়ালিনি , মালিনি ও পতিতা । নবম রূপটিই পতিতালয়ের প্রতিনিধি । সেই কারণেও এই রীতির জন্ম বলে মনে করা হয় ।
আবার পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী দেবতার থেকেও বেশি ক্ষমতাশালী ছিলেন পতিতা । পুরাণে বর্ণিত আছে , ইন্দ্রত্ব লাভ করার জন্য ঋষি বিশ্বামিত্র যখন কঠোর তপস্যা করছিলেন , তখন তাঁর ধ্যান ভাঙাতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন দেবরাজ ইন্দ্র । নিজে হাজার চেষ্টা করে সেই ধ্যান ভাঙাতে পারেননি দেবরাজ । শেষ পর্যন্ত এই কঠিন কাজের জন্য স্বর্গের অপ্সরা মেনকাকে পাঠান তিনি । মেনকার কৌশলে ও নৃত্যে ভেঙে যায় বিশ্বামিত্রের ধ্যান । যে কাজ দেবরাজ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন সেই কাজ অতি সহজেই করেছিলেন মেনকা । এই রকমই একাধিক ব্যাখ্যা বা মত রয়েছে । কিন্তু, সর্বোপরি মা দুর্গার শুভ্রমূর্তি প্রতিমা গড়তে ও তাঁর আরাধনায় যে তথাকথিত 'অশুদ্ধ' জায়গার মাটি লাগে তা অনস্বীকার্য ।
দুর্গার মৃণ্ময়ী মূর্তি গঠনে বিশ্বজোড়া নাম কলকাতার কুমোরটুলির । শুধু কলকাতা, রাজ্য বা দেশ নয় । বিদেশেও পাড়ি দেয় কুমোরটুলির গড়া দেবী প্রতিমা । পতিতালয়ের মাটি মূর্তি গঠনের মাটির সঙ্গে ব্যবহার করে মূর্তি তৈরি হয় ৷ পুরাকাল থেকে এই রীতি চলে আসছে ৷ কিন্তু এই রীতি আজ কতটা মানা হয় কুমোরটুলিতে ? কুমোরটুলির 60 বছর বয়সী শিল্পী শ্যামল পাল বলেন , " এগুলি এখন আর মানা হয় না । শুনেছিলাম আগে হত । কিন্তু , এখন আর হয় বলে আমি জানি না । পতিতালয়ের মাটি এখন আর কেউ আনে না । দুর্গা প্রতিমা গঠনে খড়, দড়ি, বাঁশ, কাপড়, পেরেক, মাটি, রং, সাজ এই সব ব্যবহার করা হয় । কিন্তু, এখন আর শাস্ত্র মেনে ওই সব উপাদান দিয়ে মূর্তি গঠন করা হয় না । আগে বলা হত , মহালয়ার দিন দুর্গা প্রতিমার চক্ষুদান করা হয় । কিন্তু , এখন ওইসবও আর হয় না । এখন প্রতিমা গড়ার পরিমাণ বেড়ে গেছে । এখন যদি মহালয়ার দিন চক্ষুদান হয় তাহলে ডেলিভারি কবে হবে ? তাই এখন আর মহালয়ার দিন সেভাবে চক্ষুদান হয় না, আগে থেকেই হয়ে যায় । সেরকমই পতিতালয়ের মাটি আর ব্যবহার হয় না ৷ "
পুরাকালের রীতি ভেঙে পতিতালয়ের মাটি ছাড়া দুর্গাপ্রতিমা গড়ছে কুমোরটুলি
দুর্গা প্রতিমা তৈরিতে কি এখনও ব্যবহার করা হয় পতিতালয়ের মৃত্তিকা ? খোঁজ নিতে কুমোরটুলি পৌঁছে গেছিল ETV ভারত । সেখানকার শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রত্যেকেই জানেন দেবীর মূর্তি গঠনে কোনও এককালে পতিতলয়ের মৃত্তিকা ব্যবহার করা হত । কিন্তু, অধিকাংশ শিল্পীই এখন আর দুর্গা মূর্তি তৈরিতে পতিতালয়ের মৃত্তিকা ব্যবহার করেন না ৷
73 বছর বয়সী আর এক শিল্পী মানিক পাল বলেন , "দুর্গাপূজায় যা যা লাগে তা দশকর্মার থেকেই দেন । কথিত আছে, আমরা বাবা-ঠাকুরদার আমল থেকেই শুনে আসছি যে , পতিতালয়ের ধুলো বা মাটি অতি অবশ্যই দুর্গাপূজার জন্য প্রয়োজনীয় । তা না হলে দুর্গাপুজো সমাপ্ত হয় না ৷ এখন কুমোরটুলিতে 250 দোকানদার । সবার পক্ষে তো ওখান থেকে ধুলো বা মাটি আনা সম্ভব নয় । এখন দশকর্মার দোকানে বললে ওখান থেকে দিয়ে দেয় । বাইরের যে সমস্ত জায়গায় আমরা ঠাকুর পাঠাই তাঁরাও বলেন , ওখানকার মাটি পাঠাবেন । আমরা দশকর্মার দোকান থেকে কিনে পাঠিয়ে দিই । ওখানকার অনেক মহিলারা আসেন ঠাকুর নিতে । তাঁদের বললেও দেন । কিন্তু , কুমোরটুলিতে মূর্তি গড়তে ওখানকার মাটি ব্যবহার করতে দেখিনি । ওটা ব্রাহ্মণরা মূর্তির গায়ে লাগিয়ে দেন বলে জানি ।"
তবে আবার জানা যাচ্ছে এখনও অনেক বনেদি বাড়িতে দেবীর মূর্তি গঠনে পতিতলয়ের মাটি ব্যবহার করা হয় ৷ তবে বলা ভালো মূর্তি গঠনে নয় ৷ দেবীর মহাস্নানে পতিতালয়ের মৃত্তিকা ব্যবহার করা হয় ৷ যেমন , লাহা বাড়ি । লাহা বাড়ির মেয়ে সুস্মেলি দত্ত বলেন , " আমাদের লাহা বাড়ির ক্ষেত্রে মূর্তি গড়ায় বরাবরই পতিতাপল্লির মাটি ব্যবহার করা হত না বা এখনও হয় না । আমাদের সপ্তমী , অষ্টমী , নবমীতে দর্পণ বা আয়নায় মহাস্নান করানো হয় দেবীকে । সেখানে আট রকমের জল , আট রকমের তেল এবং আট রকমের মাটি দিয়ে মাকে স্নান করানো হয় । আট রকমের মাটির মধ্যে অবশ্যই থাকবে বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা । তার সঙ্গে গঙ্গা মৃত্তিকা , যমুনা মৃত্তিকা , গজদন্ত মৃত্তিকা এই রকমের আরও কয়েক ধরনের মাটি থাকে । মূর্তি প্রতিমা গড়ার জন্য ওই মাটি ব্যবহার করা হয় না । আমাদের দশকর্মার দোকান থেকে এটা আনা হয় । আগে ওখান থেকেই আনা হত বলে শুনেছি । এখনও তো দশকর্মার দোকান থেকেই আনা হয় ।"তবে , শাস্ত্র মতে, যাঁদের দুয়ারের মাটি ছাড়া দুর্গা প্রতিমা গড়া বা তাঁর আরাধনা সম্পূর্ণ হয় না তাঁরাই বহু বছর ধরে মাটি দেওয়ার বিরুদ্ধে । তাঁদের বক্তব্য , যেখানে সমাজ যৌনকর্মীদের সম্মান দেয় না, সেখানে তাঁদের দুয়ারের মাটি নিয়ে ধুমধাম করে দুর্গা পুজো হয় । অথচ, সেই পুজোতে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার বা ধুনুচি নাচে অংশগ্রহণ করার অনুমতি ছিল না তাঁদের । তাই বহু লড়াই করে 2013 সাল থেকে দুর্গা পুজো করার অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছেন যৌনকর্মীরা । সেই বছর থেকেই মাটি দেওয়ার বিরোধিতাও করে এসেছেন তাঁরা । তবে , এখনও তাঁদের পল্লি থেকে কেউ চুরি করে বা কেউ বহু আবেদন-নিবেদন করে মাটি নিয়ে যান বলে জানাচ্ছেন তাঁরা ।এই বিষয়ে দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির সেন্ট্রাল কমিটির সভানেত্রী বিশাখা লস্কর বলেন , "যৌনপল্লির মাটি নিয়ে দুর্গা পুজো হয় । অথচ, যৌনকর্মীদের মানুষ হিসাবে সমাজের মানুষরা গণ্য করে না । যৌনকর্মীদের অপমান করা , অবহেলা করা ৷ বলা যায় সমাজের অবহেলিত মানুষগুলির মধ্যে রয়েছেন যৌনকর্মীরা । অথচ, আমাদের বাঙালি ধর্মে যে দুর্গা পুজো হয় তা কিন্তু যৌনপল্লির মাটি দিয়েই হয় । মূলত, যৌনপল্লির মাটি দিয়েই প্রতিমা তৈরি হয় । এখন কুমোরটুলি বলছে যে , আমাদের এখানকার মাটি নিয়ে মূর্তি গড়ে না । এখন দুর্গা পুজোটাকে হয়তো ওরা ব্যবসা হিসাবে ধরে নিয়েছে । কিন্তু, আমরা যতটা জানি এখানকার মাটি কোনও না কোনওভাবে নিয়ে যাওয়া হয় । আমরা মাটি দিতে আপত্তি করি এই কারণে যে , যৌনপল্লির মাটি নিয়ে দুর্গাপুজা ধুমধাম করে হয় । অথচ, সেই যৌনকর্মীদের সমাজে সম্মান দেওয়া হয় না । শাস্ত্রে আছে যৌনপল্লির মাটি দিয়েই দুর্গা প্রতিমা করা হয় । ওরা কিন্তু কোনও না কোনওভাবে মাটি নিয়ে যায় । বনেদি বাড়িও মাটি নিয়ে যায় । তবে, সরাসরি এসে নিয়ে যেতে পারে না । অনেকেই সরাসরি এসে চায় বা টাকা দিয়ে কিনতে চায় । কিন্তু, মাটি নিয়েই যায় । তবে, আমরা দুর্বার সংগঠনের তরফ থেকে মাটি নিতে বাধা দেব । কারণ , যৌনকর্মীদের সম্মান না দিয়ে তাঁদের মাটি দিয়ে দুর্গা প্রতিমাকে সম্মান জানানোর কোনও মানে হয় না ।"