নিশ্চিহ্নের পথে কলকাতায় বিপ্লবী যতীন দাসের জন্মস্থল কলকাতা, 26 নভেম্বর: তিলোত্তমার এই ব্যস্ত রাস্তা প্রায় সারাবছরই আমজনতার ভিড় থাকে ৷ এখানেই বাড়ি বাংলার অন্যতম বীর স্বাধীনতা সংগ্রামী যতীন্দ্রনাথ দাসের ৷ উত্তর কলকাতার হাতিবাগানে টাউন স্কুলের বিপরীতে গণেন্দ্র মিত্র লেন ৷ এই চার ফুটের সরু গলিতে ঢোকার মুখেই রয়েছে বিপ্লবীর মূর্তি ৷ এই গলিতে জন্মগ্রহণ করেন বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ দাস ওরফে যতীন দাস ৷
এই গলির প্রথম বাড়িটি বেশ কয়েক বছর আগে প্রোমটিং হয়ে গিয়েছে ৷ দ্বিতীয় বাড়িটি গায়ে বিরাট অশ্বত্থ গাছ ৷ দেওয়াল জুড়ে শুধুই শিকড় ৷ ভগ্নপ্রায় বাড়িটির ঠিকানা 1বি, গণেন্দ্র মিত্র লেন ৷ 1904 সালে 27 অক্টোবর এই বাড়ির নীচতলার একটি ঘরে জন্মগ্রহণ করেন বিপ্লবী যতীন দাস ৷ এটা তাঁর মামার বাড়ি ৷ পরে ভবানীপুরে নিজের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন তিনি ৷ এরপর ভারতের ইতিহাস অনেক পরিবর্তন হয়েছে তাঁদের মতো বিপ্লবীদের সংগ্রামের বিনিময়ে ৷
এই বাড়িতে বিপ্লবীর মামার বাড়ির পরিবারের তিন শরিক বসবাস করে ৷ প্রায় 120 বছরের এই বাড়িটি সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে ৷ গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকলেই দেওয়াল জুড়ে ফাটল ৷ দরজার কাঠ খুলে গিয়েছে ৷ ফাটল ওঠা-নামার সিঁড়িতে ৷ দোতলার ঘরের ছাদের একাংশ ভেঙে পড়েছে ৷ ঘরে ঘরে ধুলোর আস্তরণ ৷ উপর-নিচ মিলিয়ে মোট 8 টি ঘর রয়েছে ৷
বাড়িতে এখন থাকেন সপ্তর্ষি ঘোষ ৷ তিনি ক্যামেরার সামনে আসতে চাননি ৷ তবে বাড়ির ভগ্নদশা নিয়ে সপ্তর্ষি ঘোষ বলেন, "বাড়ি ঘুরে দেখুন কী অবস্থা ! আমাদের আর্থিক অবস্থা এতটা ভালো নয় যে এই বিরাট বাড়ি সংস্কার করে ফেলব ৷ শরিকি সমস্যা তো আছেই ৷ বাকিরা থাকতে না পেরে অন্য জায়গায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকছেন ৷ আর আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রয়ে গিয়েছি ৷ বাড়িতে বয়স্ক মা আছেন ৷ তাই বাড়ি ডেভেলপমেন্ট করার পরিকল্পনা করছি ৷ সেই বিষয়ে আলোচনাও চলছে ৷"
ভারতের স্বাধীনতার 75 বছরে দেশে 'আজাদি কা অমৃত মহোৎসব' পালিত হয়েছে ৷ কেন্দ্রীয় সরকারের এই সংক্রান্ত একটি ওয়েবসাইটে নাম রয়েছে বিপ্লবী যতীন দাসের ৷ সেখানে তাঁর সম্বন্ধে লেখা হয়েছে, মাত্র 17 বছর বয়সে তিনি মহাত্মা গান্ধির অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ৷ 1929 সালে 63 দিন ধরে একটানা অনশনের পর তাঁর মৃত্যু হয় ৷ তখন তাঁর বয়স মাত্র 25 বছর ৷ লাহোর সেন্ট্রাল জেলে সেই সময় শহিদ ভগৎ সিং এবং অন্য বন্দিরাও অনশন করছিলেন ৷ তবে যতীন্দ্রনাথ দাসের উপর ব্রিটিশরা প্রবল অত্যাচার করেছিল ৷ ফলে তাঁর ফুসফুস নষ্ট হয়ে যায় ৷ ধীরে ধীরে পুরো শরীরটাই প্যারালাইসিস হয়ে গিয়েছিল ৷
গণেন্দ্রনাথ লেনের এই বাড়িতে ঢুকলেই গেটের মুখে দেওয়ালে পাথরের ফলক ৷ তাতে লেখা 'বিপ্লবী যতীন্দ্র নাথ দাস'। বাড়িটি ঐতিহ্যশালী ভবনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ৷ তবে এখনও গ্রেড দেওয়া হয়নি ৷ বিপ্লবীর ধুলো, ঝুলে ভর্তি ঘরটি তালা বন্ধ ৷ আশঙ্কা ভগ্নপ্রায় বাড়িটি হয়তো একদিন প্রোমোটারের হাত চলে যাবে ৷
প্রশ্ন উঠছে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় যিনি গ্রেফতার হলেন এবং অনশনে যাঁর মৃত্যু, তাঁর স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি কি এভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে ? তাঁর মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান লিখেছেন ৷ তাঁর শবদেহ নিয়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু মিছিল করেছিলেন ৷ এমন ব্যক্তিত্বের জন্মভিটে রক্ষায় কেন উদাসীন রাজ্য সরকার, কলকাতা পৌরনিগম ? কেন শুধু হেরিটেজ তালিকায় নাম তুলে দায় ঝেড়ে ফেলা হল ? প্রশাসন কি হস্তক্ষেপ করবে না ?
প্রাক্তন নগর পরিকল্পক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, "এই বাড়ি গ্রেড ওয়ান হেরিটেজ হওয়া দরকার ৷ বাড়িটা যদি ভেঙে পড়ে বা প্রোমোটার নিয়ে নেয়, তাহলে কি রক্ষা করা যাবে ? মূর্তি বানিয়ে লাভ কী ? যদি আসল জিনিসই রক্ষা করা না-যায় !" মায়ের বাড়ি, ভগিনী নিবেদিতার বাড়ির কথা উত্থাপন করেন দীপঙ্কর ভট্টাচার্য ৷
তিনি আরও বলেন, "প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায় মেয়র থাকাকালীন টাউন হলে অফিস করার কথা হয়েছিল ৷ তখন জ্যোতি বসু একটি কমিটি গঠন করেন ৷ সেই কমিটি ঐতিহ্য রক্ষার বিকল্প হিসেবে 20 হাজার স্কোয়্যার ফুট জায়গায় অফিস করার নির্দেশ দেয় ৷ হাটকো বিল্ডিং করেন ৷ এই ক্ষেত্রে যতীন দাসের বাড়িতে যাঁরা আছেন, তাঁদের হয় সরকারিভাবে পুনর্বাসন দিতে হবে অথবা ওই বাড়ির সমান জায়গা বা অতিরিক্ত এফএআর দিতে হবে ৷ যাতে বাড়ির বাসিন্দারা কোনও প্রোমোটার দিয়ে ওই বাড়ি সারিয়ে নিতে পারেন ৷ আর অতিরিক্ত এফএআর জায়গায় প্রোমোটার নির্মাণ করে বিক্রি করতে পারবেন ৷ তাহলে দুই পক্ষের স্বার্থই রক্ষিত হবে ৷ পাশাপাশি ঐতিহ্যও রক্ষা করা যাবে ৷"
কলকাতা পৌরনিগমের হেরিটেজ বিভাগের মেয়র পারিষদ সদস্য স্বপন সমাদ্দার বলেন, "ওই বাড়ি চাইলেও কেউ প্রোমোটিং করতে পারা যাবে না ৷ হেরিটেজ কমিটির কাছে আবেদন জানাতে হবে ৷ সেই অনুসারে কলকাতা পৌরনিগমের ইঞ্জিনিয়ার বলে দেবেন বাড়ির কাঠামো নকশা কতটা অপরিবর্তিত রেখে সংস্কার করা যেতে পারে ৷"
আরও পড়ুন:
- চন্দননগরে বিপ্লবী ভবনের জানালা বন্ধের অভিযোগ ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে
- পুজো বন্ধ করতে চেয়েছিল ব্রিটিশরা, বিপ্লবী আন্দোলনের স্মৃতি নিয়ে আজও কালী বন্দনায় নায়েক পরিবার
- প্রেমিকাকে চিঠি থেকে গোপনে বিপ্লবী যোগ, নেতাজির স্মৃতি আগলাচ্ছে গিদ্দা পাহাড়ের বাড়ি