কলকাতা, 24 এপ্রিল : পরীক্ষা শেষের আগেই নতুন শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে ফাঁপড়ে পড়েছেন একাদশ থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ পড়ুয়ারা । কারণ, তাঁদের কাছে নেই পাঠ্য-পুস্তক । গত 16 মার্চ থেকে বন্ধ রাজ্যের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান । বন্ধ থাকবে ১০ জুন পর্যন্ত । ফলে, রাজ্য সরকারের দ্বাদশ শ্রেণির যে দুটি বিষয়ের বই দেয় সেগুলি এখন পড়ুয়াদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার কোনও উপায় নেই । অন্যদিকে, 3 মে পর্যন্ত রাজ্যজুড়ে লকডাউন । কলকাতার বিখ্যাত বইপাড়া কলেজ স্ট্রিট বা রাজ্যের অন্যান্য জেলাগুলিতেও বইয়ের দোকান বন্ধ । ফলে, অন্যান্য বিষয়ের বই চাইলেও কিনতে পারবেন না দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীরা । অনলাইন ও টেলিভিশনের মাধ্যমে ভার্চুয়াল ক্লাস দ্বারা পড়ুয়াদের একটা অংশ লাভবান হলেও, রাজ্যের প্রান্তিক এলাকা ও দুস্থ ঘরের ছেলে-মেয়েদের জন্য তা খুব একটা কার্যকর নয় বলে মত শিক্ষা মহলের । সব মিলিয়ে রাজ্যের আগামী বছরের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক না পাওয়া একটা বড় সমস্যা বলে মেনে নিচ্ছেন সকলেই ।
নেই বই, পরীক্ষা শেষের আগেই দ্বাদশে উত্তীর্ণ হয়ে ফাঁপড়ে একাদশের পড়ুয়ারা - school
বই না থাকার কারণে দ্বাদশ শ্রেণীতে উঠেও অসুবিধায় পড়েছেন একাদশের পড়ুয়ারা ।
চলছিল পরীক্ষা । কোরোনা নিয়ে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে আর তিনদিন বাকি থাকতেই স্থগিত হয়ে যায় তা । এর মধ্যে গত 15 এপ্রিল একাদশের বাকি পরীক্ষা না নিয়েই সব পড়ুয়াকে দ্বাদশ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করার ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী রাজ্যের প্রায় 11 লাখের বেশি একাদশ শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রী বর্তমানে দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়া । কিন্তু, হঠাৎ নতুন শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে ফাঁপড়ে পড়েছেন তাঁরা । কারণ, একাদশের পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরেই রাজ্য সরকার থেকে প্রথম ভাষা ও দ্বিতীয় ভাষার বই দেওয়া হয় দ্বাদশ শ্রেণির জন্য । অন্যান্য বিষয়ের পাঠ্যপুস্তকের তালিকা স্কুল থেকে দেওয়া হয় । সেই তালিকা অনুযায়ী বা নিজেদের মনপছন্দের বেসরকারি প্রকাশকের বই কিনে থাকেন পড়ুয়ারা । কিন্তু, বর্তমানে COVID-19 মোকাবিলায় লকডাউনের জেরে বন্ধ কলেজ স্ট্রিট, বইয়ের দোকান । বন্ধ স্কুলও । এই পরিস্থিতিতে নতুন ক্লাসে উত্তীর্ণ হলেও এখনও পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক হাতে পাননি আগামী বছরের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা ।
দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকের বিষয়ে স্কুল শিক্ষা দপ্তরের এক আধিকারিক বলেন, " সমস্যা হচ্ছে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির বই আলাদা । একাদশ শ্রেণির পরীক্ষা হওয়ার পর নতুন বুকলিস্ট দেওয়া হয় । উচ্চমাধ্যমিকের দুটি বই সরকার থেকে দেওয়া হয় । বাকি বইগুলোর জন্য বহু প্রকাশক আছেন । তাঁদের আবার বহু লেখক ও বহু ধরনের বই আছে । কোন বই কোন স্কুলে যাবে সেটা বুকলিস্ট না দিলে জানা সম্ভব নয় । স্কুল থেকে সেই বুকলিস্ট দিয়ে দেওয়া হয় । সেগুলো কলেজ স্ট্রিট বা বুকসেলারের কাছ থেকে কিনে নেন পড়ুয়ারা । এখন কলেজ স্ট্রিট বন্ধ । শুধু বাংলা, ইংরেজি বই সরকার থেকে দেওয়া হয় । সব স্কুলেই উচ্চমাধ্যমিকের অতিরিক্ত বই থাকে । স্কুল খুললে সরকারের বইগুলো পেয়ে যাবে। যেহেতু, মুখ্যমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, একাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের দ্বাদশে উত্তীর্ণ করে দেওয়ার কথা সেখানে দেখতে হবে কী করে দ্বাদশ শ্রেণির বই পড়ুয়াদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় । তবে, কলেজ স্ট্রিট না খুললে এটা করা খুব কঠিন ।"
দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের কাছে পাঠ্যপুস্তক না থাকার বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারি বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সৌগত বসু বলেন, "এটা একটা বড় সমস্যা । নামেই ক্লাসে উঠেছে । কোনও বই নেই। বাংলা, ইংরেজি সরকার দেবে । সেগুলো দেওয়ার মতো পরিকাঠামো এখন সরকারের নেই । বাকি বিষয়ের বইগুলো পড়ুয়ারা দুভাবে জোগাড় করে । একাদশ ও দ্বাদশের পরীক্ষা একসঙ্গে শেষ হয় । সেক্ষেত্রে একাদশের পড়ুয়ারা দ্বাদশের পড়ুয়াদের থেকে বইপত্রগুলো নিয়ে নেয় । এবছর সেটা হল না। দ্বিতীয় পদ্ধতি, বই কেনা । এখন কলেজ স্ট্রিট মার্কেট বন্ধ, পাড়ার দোকানও বন্ধ । সবাই যেমন কলেজ স্ট্রিট থেকে বই কেনে না সেটা যেমন সত্যি, তেমনি সব বইয়ের দোকান কলেজ স্ট্রিট থেকে বই কেনে সেটাও সত্যি । পরিস্থিতির বিচারে বলতে পারি এই মুহূর্তে দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের হাতে বই কোনোভাবেই পৌঁছাবে না । আর বই না পেলে তার পড়ার কোনও রাস্তা নেই । প্রাইভেট টিউটররা কেউ কেউ অনলাইনে ক্লাস চালু করেছে । কিন্তু, বই না থাকলে সার্বিক চিত্রটা পড়ুয়ারা পাবে না । ফলে খুব খারাপ অবস্থা। আশু কোনও সমাধানের রাস্তাও দেখা যাচ্ছে না ।" মাধ্যমিক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতির সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ মিত্র বলেন, "একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণির কেবলমাত্র প্রথম ও দ্বিতীয় ভাষার সরকারি বই দেওয়া হয় । কিন্তু, বাকি চারটি বিষয়ের বই ওদের সরকারিভাবে দেওয়া হয় না । সেগুলো ওদের কিনতে হয় । এখনও পর্যন্ত সরকারি বই ওদের হাতে তুলে দেওয়া যায়নি। বই নেই। এখন লকডাউনের বাজারে কোথাও বই পাবে না। একটা সমস্যা তো এই সংকটের মধ্যে তৈরি হয়েছে। সেটা অস্বীকার করা যায় না।"
স্কুলে লম্বা ছুটি । তারমধ্যেই পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েও বইয়ের অভাবে অপচয় হচ্ছে সেই সময়। আগামী বছর এই পড়ুয়ারাই বোর্ড পরীক্ষা দেবেন। লকডাউন চলাকালীন এই সময়ে তাদের পড়াশোনা অব্যাহত রাখার প্রয়াস করছে সরকার এবং স্কুল উভয়েই। কিন্তু, অনলাইন ও টেলিভিশনের মাধ্যমে সেই পড়ার মাধ্যমে রাজ্যের অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল শ্রেণির পড়ুয়ারা উপকৃত হলেও, প্রান্তিক অঞ্চলের, নিম্নবিত্ত পরিবারের পড়ুয়াদের খুব একটা লাভ হচ্ছে না বলেই মনে করা হচ্ছে। স্কুল শিক্ষা দপ্তরের এক আধিকারিক বলেন, "সব গরিব পড়ুয়া কাছে অনলাইন ক্লাসের জন্য ল্যাপটপ থাকবে, স্মার্টফোন থাকবে সেটা কখনোই আশা করা যায় না। আমাদের ভাবতে হবে বই কী করে পৌঁছানো যায়। কারণ, এখনও বইয়ের উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল ছাত্র-ছাত্রীরা। এটা অবশ্যই একটা বড় সমস্যা।"
তবে, দুধের সাধ ঘোলে মেটাতে এই মুহূর্তে অনলাইনের মাধ্যমে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াটাই একমাত্র উপায় বলে মনে করছেন শিক্ষা মহলের একাংশ। যাদবপুর বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক পরিমল ভট্টাচার্য বলেন, "সমস্যা তো আছেই। তবে, কোরোনা ভাইরাসকে কেন্দ্র করে সারা বিশ্ব যেখানে কাঁপছে, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে সরকারি উদ্যোগে টেলিভিশনের মাধ্যমে পড়াশোনা চালু করা হয়েছে সেই প্রয়াসটা অবশ্যই ভালো। এই মুহূর্তে আর কিছু করার নেই। দ্বাদশের পড়ুয়াদের হাতে এখন বই নেই সেটা সত্যি। কিন্তু, তাঁরা মনে করলে টিভিতে যে ভার্চুয়াল ক্লাস হচ্ছে, সেই ক্লাসের বিষয়ে ধরে ইন্টারনেটের সার্চ করলেই তাঁরা সব তথ্য দেখতে পাবেন। বা ক্লাসটা দেখে নেওয়ার পর বিষয় ধরে সার্চ করলেও আরও বিস্তারিত তথ্য পেয়ে যাবেন। ফলে, দুধের সাধ ঘোলে মেটের মতো করেও তাঁরা একটু এগিয়ে যাবেন। এ ছাড়া, গ্রাম হোক বা শহর, প্রত্যেকের পাড়াতেই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী রয়েছেন। সেক্ষেত্রে তাঁরা যেভাবে হাটে বাজারে যাচ্ছেন অত্যাবশ্যকীয় জিনিস কিনতে, লকডাউনের মধ্যেই সেভাবেই ওইসব পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বইগুলো জোগাড় করে নিতে পারে। একটু উদ্যোগী হলে এই বই জোগাড় করা অসম্ভব নয়।"