পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / state

ভোটের হাওয়ায় হারাতে বসেছে রাজনৈতিক সৌজন্য ?

কেউ তোলাবাজ, কেউ ঘুষখোর... কাউকে আবার দল ছাড়ার পর পেলেন মীরজ়াফর, বিশ্বাসঘাতক, গদ্দারের তকমা ।

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন 2021
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন 2021

By

Published : Feb 6, 2021, 11:14 PM IST

Updated : Feb 7, 2021, 8:33 AM IST

হাওড়া, 6 ফেব্রুয়ারি : রাজ্যে বিধানসভা ভোটের এখনও মাসখানেক দেরি । চূড়ান্ত দিনক্ষণও ঘোষণা হয়নি । কিন্তু ভোটের দামামা এখন থেকেই বেজে গিয়েছে । উত্তপ্ত হচ্ছে রাজ্য রাজনীতির বাতাবরণ । চলছে আক্রমণ, পালটা আক্রমণের পালা । এ বলছে আমায় দেখ, ও বলছে আমায় দেখ । কাদা ছোড়াছুড়ির খেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে শালীনতা ও রাজনৈতিক সৌজন্যবোধ ।

রাজ্যে দলবদলের পালা শুরু হওয়ার পর থেকে এই রাজনৈতিক কদর্যতা যেন আরও বেশি করে সামনে আসতে শুরু করেছে । প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও সভা করছেন শুভেন্দু । আর প্রতিদিনই চাছাছোলা ভাষায় আক্রমণ করে যাচ্ছেন... কখনও তৃণমূল সুপ্রিমোকে... আবার কখনও ভাইপোকে । শুভেন্দু দলত্যাগী হওয়ার পর বেসুরোদের তালিকায় সবথেকে বড় মুখ ছিলেন প্রাক্তন বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় ।

দলের বিরুদ্ধে বেসুরো হলেও রাজীব কিন্তু শুরুর দিকে দলনেত্রীর প্রতি অনেকটাই বিনীত ছিলেন । এমনকী যেদিন বিধায়ক পদে ইস্তফা দিয়ে বিধানসভা ছাড়লেন, সেদিনও বেশ আবেগপ্রবণ হতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে । দলনেত্রীর ছবি হাতে নিয়ে বিধানসভা ছেড়েছিলেন সেদিন । কিন্তু পদ্মশিবিরে যোগ দেওয়ার পরই ভোলবদল । একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে তিনিও রাজ্যের শাসক দলকে একের পর এক বাক্যবাণে বিঁধতে শুরু করলেন । সরাসরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ না করলেও রাজীবের মুখে নিজের 'দুয়ারে সরকার'-এর তুলোধনা হজম করাটা বেশ অস্বস্তিরকর ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য ।

পালটা আক্রমণ শানাতে দেরি করেনি ঘাসফুল শিবিরও । যে রাতে তিনি দিল্লিতে উড়ে গিয়ে বিজেপিতে যোগ দিলেন, তার পরের দিন সকালে হাওড়ার বিভিন্ন জায়গায় তাঁর নামে পোস্টার পড়ল । কেউ বললেন মীরজ়াফর, বিশ্বাসঘাতক, গদ্দার... কেউ পড়ালেন জুতোর মালা । কেউ আবার বললেন, উনি তো অভিনেতাদেরও অভিনেতা ।

রাজীব বিজেপিতে যাওয়ার পর কী বললেন অরূপ রায় ?

আরও পড়ুন : প্রাদেশিকতার আগুন জ্বালাচ্ছে তৃণমূল, যা সাম্প্রদায়িকতার থেকেও ক্ষতিকর: রাজীব

ডুমুরজলার সভা থেকে যখন রাজ্যে পরিবর্তনের পরিবর্তনের ডাক দিচ্ছেন রাজীব, যখন সওয়াল তুলছেন ডাবল ডেকার সরকারের পক্ষে... সেই সময় জেলার একাধিক জায়গায় তৃণমূলের নিচু তলার কর্মীদের অসন্তোষ আর কটূক্তির শিকার হচ্ছে রাজীবের ছবিসহ ব্যানার-হোর্ডিং ।

হাওড়া জেলা তৃণমূলের অন্দরে কান পাতলেই শোনা যায়, রাজীব-অরূপ দ্বৈরথের কথা । একদিকে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্যদিকে অরূপ রায় । হাওড়া জেলা তৃণমূলের শীর্ষস্তরের কোন্দল এতটাই খারাপ পরিস্থিতিতে গিয়ে ঠেকেছিল যে, জেলায় একটি তৃণমূলের কার্যালয় দু'টি । কোনা এক্সপ্রেসওয়ের ধারে রাজীব-অনুগামীরা পৃথক একটি দলীয় কার্যালয় তৈরি করে নিয়েছিলেন । রাজীব জার্সিবদলের পর, বাঁকড়া গ্রাম পঞ্চায়েত ও বাঁকড়া বাজার এলাকায় রাজীব অনুগামীদের কার্যালয়ের দখল নেয় শাসক দলের কর্মীরা । ছিঁড়ে ফেলা হয় রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি দেওয়া ব্যানার-হোর্ডিং । সূত্রের খবর, এই ঘটনার পিছনে হাত ছিল অরূপপন্থীদের ।

রাজীব-অরূপ দ্বৈরথের কথা দীর্ঘদিন ধরে শোনা গেলেও এতদিন পর্যন্ত তা কখনওই প্রকাশ্যে আসেনি । কিন্তু রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় জার্সিবদলের পর থেকে বারবার সামনে চলে আসছে, এতদিন ধরে জ্বলতে থাকা তুষের আগুন ।

আরও পড়ুন : যত কাণ্ড হাওড়া তৃণমূলে, নেপথ্যে...

ডুমুরজলা থেকে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, বিগত দিনে তিনি কখনও দলের কোনও কর্মীকে অসম্মান করেননি । কিন্তু তাতে তৃণমূলের কর্মীদের ক্ষোভ কমার কোনও লক্ষণ নেই । দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি সময় ধরে তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছিলেন । নেত্রী ভরসাও করতেন তাঁকে । 2004 সালের লোকসভা নির্বাচনে উলুবেড়িয়া কেন্দ্র থেকে প্রার্থী করেছিলেন রাজীবকে । সেই বার নেত্রীর মুখে হাসি ফোটাতে পারেননি রাজীব । বিপক্ষ প্রার্থী সিপিএম নেতা হান্নান মোল্লার কাছে হেরে গিয়েছিলেন । কিন্তু রাজীবের উপর ভরসা রেখেছিলেন নেত্রী । প্রথমে সেচ পরে বন... একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্ব রাজীবের হাতে তুলে দিতে দ্বিতীয়বার ভাবেননি নেত্রী । সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে, দলত্যাগী রাজীবের চুপচাপ পদ্মে ছাপের ডাক একেবারেই মেনে নিতে পারছে না তৃণমূলের নিচু তলার কর্মীরা ।

ভোটের দিন যত এগিয়ে আসছে, তত বাড়ছে স্নায়ুর চাপ । 'দল-বদলু' রাজীবরা তাই যখন স্লোগান তুলছেন, "চলুন পালটাই", তখন চুপচাপ বসে থাকতে নারাজ, অরূপ রায় । বললেন, "নিজেকে কেউ কেউকেটা বা হরিদাস পাল ভাবতেই পারেন । তাহলেই তিনি হরিদাস পাল হয়ে যান না । হরিদাস পাল মানুষ তৈরি করে ।" রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের মতে, স্নায়ুর চাপ ধরে রাখতে না পেরেই এই ধরনের মন্তব্য । আবার অন্য একটি অংশের মতে, রাজীব-অরূপ যে দ্বৈরথ চলে আসছিল, তা এতদিন ধরে চাপা ছিল । কিন্তু দলত্যাগী হওয়ার পর, তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খোলা এখন আরও সহজ হয়ে উঠেছে অরূপ রায়ের জন্য ।

জেলা সদরের তৃণমূল সভাপতি ভাস্কর ভট্টাচার্য অবশ্য রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিশেষ গুরুত্ব দিতে নারাজ । তাঁর দাবি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশীর্বাদ ধন্য যে কেউ ডোমজুড়ে দাঁড়ালেই জিতবে ।

রাজীব-অরূপ এই তুষের আগুন আজকের নয় । এর শুরু হয়েছিল পঞ্চায়েত ভোটের সময় থেকে । ডোমজুড়ে জেলা পরিষদের প্রার্থী দেওয়া নিয়ে প্রথমবার প্রকাশ্যে এসেছিল রাজীব-অরূপ সংঘাত । অরূপ রায় তাঁর পছন্দের মানুষ কল্যাণ ঘোষকে জেলা পরিষদের প্রার্থী করেছিলেন । কিন্তু তাতে সায় ছিল না রাজীবের । সেইবার পঞ্চায়েত ভোটে ডোমজুড়ে জেলা পরিষদে জেতেন জসিমউদ্দিন, যিনি ছিলেন একজন নির্দল প্রার্থী । কানাঘুষো শোনা যায়, এই জসিমউদ্দিন ছিলেন রাজীবের পছন্দের প্রার্থী ।

আরও পড়ুন : মুসলমানদের অপছন্দের তালিকায় বিজেপি না তৃণমূল ? ভাবার সময় এসেছে

হাওড়ার 40 টি জেলা পরিষদ আসনের মধ্যে 39 টিতেই জিতেছিল তৃণমূল । একমাত্র ডোমজুড় জেলা পরিষদ আসনে হারের সম্মুখীন হতে হয়েছিল তৃণমূলকে । তৃণমূলের অন্দরে কান পাতলে শোনা যায়, রাজীবের এই চ্যালেঞ্জকে মোটেই ভালোভাবে নেননি অরূপ । আর সেই থেকে অলিখিতভাবে দু'টি শিবিরে ভাগ হয়ে গিয়েছে হাওড়া জেলা তৃণমূল । অবশেষে রাজীবের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ বৈশালী, রথীনরাও যোগ দেন বিজেপি শিবিরে ।

আর এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের আঁচ এখন ছড়িয়ে পড়েছে পাশের জেলা হুগলিতেও । উত্তরপাড়ার বিধায়ক প্রবীর ঘোষাল দলত্যাগ করার পর সরব হয়েছেন হুগলি জেলা তৃণমূল সভাপতি দিলীপ যাদবও । প্রবীর ঘোষালের বিধায়ক পদ আগলে রাখা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি । কানাঘুষো শোনা যায়, এই অসন্তোষও আজকের না ।

আর সেই কারণে রাজীব-প্রবীররা দলত্যাগী হওয়ার পর জরুরি বৈঠকে বসতে দেখা যায় জেলা তৃণমূলকে । বিভিন্ন শাখা সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন হুগলিতে জেলা তৃণমূলের বৈঠকে । সূত্রের খবর, ভোটের আগে দলে যাতে নতুন করে কোনও ভাঙন না ধরে তা নিশ্চিত করতে চাইছে তৃণমূল । বৈঠক সেরে নিয়েছে হাওড়া জেলা তৃণমূলও । রাজীব, বৈশালী থেকে শুরু করে লক্ষ্মীরতন শুক্লারা বিভিন্ন সময়ে হাওড়া জেলা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন । অভিযোগ, তাতেও কোনও ব্যবস্থা হয়নি । এরপরেই একে একে দলত্যাগী হতে দেখা যায় নেতাদের ।

দাবি - পালটা দাবি, অভিযোগ - পালটা অভিযোগ নিয়েই এখন বেড়ে চলেছে রাজনৈতিক তরজা । আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে রাজনৈতিক শালীনতা ও সৌজন্যবোধ । তাই আসন্ন নির্বাচনে বিবাদমান দুই শিবির যে বিনা যুদ্ধে এক ইঞ্চি জমিও ছাড়তে নারাজ, তা স্পষ্ট ।

Last Updated : Feb 7, 2021, 8:33 AM IST

ABOUT THE AUTHOR

...view details