হায়দরাবাদ, 17 অগস্ট: ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ-আমেরিকান লেখক সলমন রুশদির উপর হামলা চালানোর ঘটনায় তোলপাড় দুনিয়া ৷ নিউ ইয়র্কে এই আক্রমণের তীব্র নিন্দা করেছেন আন্তর্জাতিক লেখকেরা ৷ তার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশের নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন ৷ শেষ পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী, 75 বছর বয়সি রুশদিকে ভেন্টিলেশন থেকে বের করে আনা হয়েছে ৷ তবে তিনি এখনও সংকটজনক ৷ তাঁর উপর ছুরিকাঘাত চালানোর পর মৃত্যু হুমকি পেয়েছেন হ্যারি পটার লেখক জে কে রাওলিং, তসলিমা ৷ 'দ্য স্যাটানিক ভার্সেস'-এর লেখকের উপর এই হামলা নিয়ে ইটিভি ভারতের প্রতিনিধিকে একান্ত সাক্ষাৎকারে কী বললেন আরেক বিতর্কিত লেখিকা (Taslima Nasrin exclusive interview with ETV Bharat)?
ইটিভিভারত:সলমন রুশদির উপর হামলায় আমি হতবাক, টুইট করলেন শশী থারুর
তসলিমা নাসরিন: এটা বিশ্বের প্রত্যেকটি জায়গাতেই বেড়ে চলেছে ৷ মানুষের আরও সতর্ক হওয়া উচিত ৷ এমন ঘটনা বন্ধ করতে হবে ৷ এইভাবে কেউ কাউকে হত্যা করতে পারে না ৷
- এটা বন্ধ করতে আমাদের কী করা উচিত ? 'সির টান সে জুড়া'-র মতো স্লোগান উঠছে, এমনকী ভারতেও ৷
সারা দুনিয়ায় এই ঘটনা ঘটছে ৷ আমেরিকার মতো দেশে রুশদি অনেক বেশি নিরাপত্তা পান ৷ যদি সেখানে এমন হামলা হয়, তাহলে যে কোনও জায়গায় হতে পারে ৷ মৌলবাদের বাড়বাড়ন্ত আটকাতে পারলে সন্ত্রাস কমবে ৷ এর জন্য অনেক কিছু করতে হবে ৷ মৌলবাদীদের নিশানা 25-26 বছর বয়সি যুবকেরা ৷ তাদের মাথায় খুব সহজে বিষয়টি ঢোকানো যায় ৷ আর ধর্মীয় নেতারা এটা ভালোভাবে করে থাকেন ৷ এটা বন্ধ হলে, সব ঠিক হয়ে যাবে ৷ আরেকটা ব্যাপার, 'সাংঘাতিক কট্টরপন্থি বার্তা' ভেসে আসছে ইন্টারনেটে ৷ এই সকল বার্তা তরুণ প্রজন্মকে জঙ্গি হামলার দিকে ঝুঁকতে বাধ্য করবে ৷
- আপনি কি মনে করেন 'মাদ্রাসা' মৌলবাদ ছড়াচ্ছে ?
বেশকিছু মাদ্রাসা আছে, যেখানে পড়াশোার বদলে ধর্মের বিষ দেওয়া হয় ৷ সরকারকে নজর রাখতে হবে এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণ জরুরি ৷
- আপনি কি বিশ্বাস করেন ভারত সরকার এ বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে ?
আমি এই সরকারের কথা বলছি না, বিশ্বের সব সরকারের জন্য ৷ সারা পৃথিবীতে মাদ্রাসাগুলির মাধ্যমে তরুণদের মাথায় এসব ঢোকানো হয় ৷ প্রতিটি দেশের সরকারকে মাদ্রাসা কী করছে, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে ৷ তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ৷ সন্ত্রাসবাদ একটা আইডিয়া ৷ একে এভাবে শেষ করা যায় ৷ জঙ্গিদের মেরে ফেললেও সন্ত্রাসবাদ কখনও শেষ হবে না ৷ সন্ত্রাসবাদ সংক্রামক ৷ একজনের থেকে অন্যের মধ্যে এটা ছড়িয়ে যায় ৷
আরও পড়ুন: 'টাকার প্রেমে যাঁরা পড়েন, তাঁদের ওপর থেকে শ্রদ্ধা চলে যায়', মন্তব্য তসলিমার
- যখনই আমরা সন্ত্রাসবাদ নিয়ে কথা বলি, তখনই সেটা ইসলামে গিয়ে শেষ হয় ৷ কেন ?
আসলে ইসলামের সংস্কার হয়নি, বিবর্তন হয়নি ৷ আমরা যদি কোনও রকম সংস্কারের কথা বলি, তাহলে আমাদের মেরে ফেলা হবে ৷ তাই, যদি সংস্কার নিয়ে কোনও সমালোচনাই করা না যায়, তাহলে পুরুষ এবং নারীর সমান অধিকারের কথা কেউ বলবে কী করে ? ধর্মীয় নিয়মকানুনগুলো মানুষের অধিকার এবং ন্যায্য বিচারের উপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত ৷ কেউ এসব নিয়ে কথা বললে যে কোনও দল তাঁকে হত্যা করবে ৷ সরকার তাদের কখনও থামাবে না ৷ মুসলিম দেশগুলির সরকার ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে থাকে ৷ এই জন্য ওই দেশগুলি রাষ্ট্র আর ধর্মকে একে অপরের থেকে আলাদা করে না ৷ আধুনিক আইনকানুন কার্যকর করতে দেওয়া হয় না এসব দেশে ৷ তারা সপ্তম শতকের আইন মেনে চলে ৷ আর সরকারও কখনও তা বদলাবার চেষ্টাও করে না ৷ তাই ইসলাম আর ইসলাম নেই ৷ এটা 'রাজনৈতিক ইসলামে' পরিণত হয়েছে ৷ এই পরিবর্তনটা ভয়ঙ্কর ৷ তাদের ধর্মকে বাঁচিয়ে রাখতে রক্ত দরকার ৷
- সলমন রুশদির উপর এই হামলা কি সমগ্র লেখককুলের উপর ? আপনার কী মনে হয় ?
সব লেখকদের আক্রমণ করা হয়নি ৷ যে সব লেখকেরা ইসলাম ধর্মের সংস্কার চায়, এর বদল চায়, তাঁদের উপর হামলা করা হয় ৷ আমাকেও হত্যার ফতোয়া জারি করা হয়েছে ৷ আমার মাথার দাম ঘোষণা করেছে ৷ তাই, সবাই নয়, কয়েকজন লেখকের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ ৷ রুশদিকে আঘাত করায় কয়েকটি মুসলিম দেশ রীতিমতো উৎসব পালন করেছে ৷ পাকিস্তানের চরমপন্থী তেহরিক-ই-লব্বাইকের নেতা সাদ রিজভি বলেছেন, "আমরা সলমনের উপর হামলা করেছি ৷ এবার তসলিমাকে হত্যা করতে হবে ৷" পাকিস্তানের প্রায় 20 লক্ষ মানুষ তাঁর এই ঘোষণা শুনেছে ৷ আমাকে বলা হয়েছে, এরপর আমি ৷ তখন থেকে আমি টুইটারে খুনের হুমকি পেয়ে চলেছি ৷ সলমন রুশদি পাশ্চাত্য দেশগুলিতে থাকেন ৷ তিনি পুরো পুলিশি নিরাপত্তা পান ৷ তাই তিনি বেঁচে গিয়েছেন ৷ বেশির ভাগ লেখকরা, যাঁরা ইসলামকে সংস্কার করতে চান, তাঁরা আধুনিক মানসিকতা, আধুনিক ইসলামে বিশ্বাসী ৷ তাঁদের জীবন ঝুঁকিতে ৷ তাঁদের জন্য কোনও প্রশাসনিক সুরক্ষা নেই ৷ তাই খুব সহজে মৌলবাদীরা তাঁদের টার্গেট করতে পারে ৷ মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী লেখকেরা তাঁদের ইসলামের আদর্শের জন্য নিশানা হয়ে যান ৷
- ভারতে নূপুর শর্মাকেও এরকম মৃত্যু হুমকি দেওয়া হয়েছে ৷ এ বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী ?
দেখুন, আমার উপরে অনেক বার হামলা চালানো হয়েছে এবং মেরে ফেলার একাধিক হুমকি জারি করা হয়েছে ৷ ইসলামের সংস্কারের কথা যাঁরা বলেন, তাঁদেরই বেশি করে নিশানা করা হয় ৷ একই অবস্থা নূপুর শর্মার ক্ষেত্রেও ঘটেছে ৷ উদয়পুরে কানহাইয়াকে এই সব লোকেরা মেরে ফেলেছে ৷ খুব বিপজ্জনক ৷ তাদের ধর্ম এতটাই দুর্বল, এতটাই উৎসর্গিত যে তাকে বাঁচাতে অন্যদের মেরে ফেলতে হচ্ছে ৷ এতেই প্রমাণিত হয় যে, তাদের ধর্ম শক্তিশালী নয় ৷
- সলমন রুশদির জন্য আপনি কোনও বিশেষ বার্তা দিতে চান ?
আমি এ ধরনের হিংসার বিরুদ্ধে এবং সব সময়েই বিরোধিতা করেছি ৷ যখন থেকে এসব শুরু হয়েছে, তখন থেকেই ৷
আরও পড়ুন: স্বাধীনতার 75 বছরে রুশদির দ্য স্যাটানিক ভার্সেসের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হোক, দাবি অপর্ণার