কলকাতা, 16 ফেব্রুয়ারি : এবার শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারিকরণের পথে হাঁটতে পারে রাজ্য সরকার (ppp model to be introduced in state education system) । পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপি মডেলে রাজ্যের শিক্ষাকে আরও উন্নত করতে রাজ্য সরকারের এই পরিকল্পনা বলে মনে করা হচ্ছে । তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেছেন, আদতে এই নীতি সার্বিক শিক্ষাকে শ্রীহীন করে দেবে ।
শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী-শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চের রাজ্য সম্পাদক কিংকর অধিকারী মনে করছেন, "রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থাকে পিপিপি মডেলের মাধ্যমে যেভাবে সম্পূর্ণ বেসরকারিকরণ করার ছক কষা হচ্ছে, তাতে শিক্ষা আরও মহার্ঘ পণ্যে পরিণত হবে । সাধারণ বাড়ির সন্তানরা তার নাগাল পাবে না । কোনমতেই তা হতে দেওয়া চলে না ।’’
তাঁর অভিযোগ, ‘‘দীর্ঘদিন শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী নিয়োগ না-করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্রমশ মানুষের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করে তোলা হচ্ছে । নেই নৈশ প্রহরী, নেই ঝাড়ুদার। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতেও নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক, নেই পরিকাঠামো, নেই গ্রুপ ডি, ক্লার্ক-এর পদে কর্মী । অর্থের বিনিময়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতে যা রয়েছে, সরকারি স্কুলের পরিকাঠামোতে তা নেই ।’’
তাঁর আরও দাবি, ‘‘শিক্ষা বহির্ভূত অসংখ্য কাজে জেরবার করে রাখা হয়েছে বিদ্যালয়গুলিকে । ব্যর্থতার সরকারী দায় চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে অন্যদের ঘাড়ে । ব্যক্তি মালিকের ব্যবসার ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করে শিক্ষাকে আরও মহার্ঘ পণ্যে পরিণত করার যে অপকৌশল শুরু হয়েছে, তার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি আমরা ।"
পাশাপাশি শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার বলেন, "আমার মনে হয় এটা শিক্ষার একটা সর্বনাশ ডেকে আনবে আমাদের রাজ্যে । কারণ এখন সরকার যে শিক্ষাটা দেয় মোটামুটি অল্প খরচের শিক্ষা ৷ তাতে দরিদ্র ঘরের পড়ুয়ারা আসতে পারে । কিন্তু পিপিপি মডেলে শিক্ষা ব্যবস্থা হলেই স্কুলের মাইনে বেড়ে যাবে । সরকার অবশ্য এখন বলবেন যে না মাইনে বাড়বে না ৷ কিন্তু তা বিশ্বাসযোগ্য নয় । কারণ, বেসরকারি সংস্থা লাভের জন্য আসবে । স্বাধীনতার এতদিন পরেও আমরা অনেককেই শিক্ষিত করে তুলতে পারিনি । তবে এই ব্যবস্থা হলে বহু ছেলেমেয়েকে স্কুলের বাইরে রেখে দেবে বলে আমার মনে হয় । তাই আমি এর সম্পূর্ণ বিরোধী ।"
তবে এই ব্যবস্থাকে স্বাগত জানিয়েছেন শিক্ষাবিদ মালিনী ভগৎ । তিনি বলেন, "আমি এই ব্যবস্থাকে স্বাগত জানাই । কারণ, বেসরকারি স্কুলের পঠনপাঠন পদ্ধতি ও সরকারি স্কুলের পঠন পাঠনের পদ্ধতির মধ্যে অনেকটাই ফারাক রয়েছে । তাই পড়াশোনা বা ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে থাকে সরকারি স্কুলের পড়ুয়ারা । সরকারি স্কুলের পঠন পদ্ধতিতে আনতে হবে নতুনত্ব এবং বিজ্ঞানসম্মত ভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের তৈরি করতে হবে তাদের ভবিষ্যতের জন্য । তাই এই দুয়ের মেলবন্ধনে অনেক বেশি সুযোগ পাবে ছাত্রছাত্রীরা । তবে এই জন্য চাই পরিকল্পনা, যাতে অভিভাবকদের ওপর বাড়তি আর্থিক চাপ না পড়ে ।"
এই নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারি বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সৌগত বসু বলেন, "পিপিপি মডেল বিভিন্ন উৎসাহী ব্যক্তি, ট্রাস্ট বা সংস্থার মাধ্যমে রাজ্যের বিদ্যালয়ের শিক্ষার ক্ষেত্রে নতুন প্রতিষ্ঠান স্থাপনের যে খসড়া প্রস্তাব আজ প্রকাশিত হয়েছে, তা একই সঙ্গে নানাবিধ সংশয় এবং আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে ।’’
তাঁর বক্তব্য, ‘‘রাজ্যের অধিকাংশ মানুষ এখনও রাজ্য সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীনে পরিচালিত সরকারি বিদ্যালয় এবং সরকারি সাহায্য প্রাপ্ত বিদ্যালয়ের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল । এই কোভিড অতিমারির মধ্যে রাজ্যের বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যখন বেতন সংক্রান্ত নানা গন্ডগোল চলছে (এমনকি বেশ কিছু ক্ষেত্রে মামলা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে), সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে 2022 শিক্ষাবর্ষে রাজ্যের সমস্ত সরকারি ও সরকার অধিগৃহীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ভর্তির হার বৃদ্ধি পেয়েছে ।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘কিন্তু রাজ্য যদি এভাবে বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে পিপিপি মডেল রূপায়ণে উৎসাহী হয়, তাহলে আগামী দিনে সরকারি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে শিক্ষা আরও সংকুচিত হবে বলেই আমরা বিশ্বাস করি । যে জায়গাটা আমাদের কাছে আশঙ্কার এবং আতঙ্কের, তা হল 6 থেকে 14 বছর বয়স পর্যন্ত যে কোনও শিশুর শিক্ষা 'শিক্ষার অধিকার আইন' অনুসারে নিশ্চিত করা যে কোনও সরকারের পক্ষে একটি বাধ্যতামূলক কর্মসূচি । কিন্তু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যখন এই কাজটি করবে, তখন শিক্ষার অধিকার আইনের মূল ধারা অর্থাৎ কোনও রকম অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় ছাড়াই শিক্ষা গ্রহণের অধিকার থেকে রাজ্যের এক বিরাট অংশের মানুষ বঞ্চিত হবেন ।’’
একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘এমন নয় যে আমাদের রাজ্যে এই ধরনের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই, সেগুলি আছে এবং তারা তাদের মতো করেই শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যবসা-বাণিজ্য করে চলেছে । তারপরেও রাজ্যের অব্যবহৃত স্কুলের জমি-বাড়ি যদি এই খসড়া প্রস্তাব অনুসারে বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হয়, তাহলে কোনও একটা জায়গায় গিয়ে মনে হয় সরকার শিক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে চাইছেন ।’’
পশ্চিমবঙ্গ সরকারি বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সৌগত বসু আশঙ্কার আরও একটি বিষয় উল্লেখ করেছেন ৷ তিনি বলেন, ‘‘শিক্ষক এবং শিক্ষা কর্মী নিয়োগের দায়িত্ব স্বাভাবিক কারণেই এই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হাতে থাকবে । যে অর্থের বিনিময়ে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের কাজ করতে বাধ্য করা হবে, তার নিয়ন্ত্রণও সরকারের হাতে থাকবে না । এমনকি বিগত কয়েক মাসের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি যে যে কোনও শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী চাকরির জন্য নিরাপত্তা বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লঙ্ঘিত হয়েছে, তার পরেও এই ধরনের উদ্যোগ মানুষের এই বার্তা দেয় যে রাজ্যের শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সম্মানজনক বেতন পেয়ে চাকরি পাওয়ার যে নৈতিক অধিকার বর্তমান সরকারের শিক্ষা দফতর সেই অধিকারটিও সংকুচিত করার কাজ করতে চলেছে ।"
আরও পড়ুন :School Reopening : 2 বছর পর ফের ক্লাসরুমে ফিরল প্রাক-প্রাথমিক থেকে সব শ্রেণির পড়ুয়ারা