পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / city

"প্রচারে বেরিয়ে সুধীন দত্ত পড়তে দেখেছি প্রণববাবুকে" - অশোক ভট্টাচার্য

প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে স্মৃতিচারণ করেছেন প্রদেশ কংগ্রেসের মুখপাত্র অশোক ভট্টাচার্য ৷

pranab mukherjee
সুধীন দত্ত পড়তে দেখেছি প্রণব বাবুকে

By

Published : Sep 1, 2020, 1:12 PM IST

Updated : Sep 1, 2020, 2:13 PM IST

তাঁর কাছাকাছি অনেকবার গিয়েছি কিন্তু সেবারের অভিজ্ঞতাটা ছিল একটু অন্যরকম । সোমেনদা তৃতীয়বারের জন্য সভাপতি হয়েছেন 2018-তে ৷ দিল্লি গিয়েছেন রাহুল গান্ধির সঙ্গে নবনিযুক্ত কমিটির জরুরির বৈঠকে যোগ দিতে । সোমেনদার ছায়াসঙ্গী আমি । বৈঠকের পরদিনই সম্ভবত সোমেনদা, শিখা মিত্র ( বৌদি) এবং আমি প্রণববাবু'র বাড়িতে গেলাম । কথাবার্তা চলছে সোমেন দা, বৌদির সাথে প্রণববাবুর । রাজনীতি থেকে পড়াশোনা, শবরীমালা বিতর্ক সব আলোচনার মাঝে সোমেনদা হঠাৎ প্রণববাবুকে বললেন, "রাজা কিন্তু খুব ভালো লেখে।" আমায় অবাক করে দিয়ে প্রণববাবু বললেন, "আমি জানি তো, নাটকের রিভিউ পড়েছি ওর..।" সোমেন দাও অবাক। কারণ সোমেন দাও জানতেন না আমি নাটকের রিভিউ লিখতাম । আমিও বলিনি কখনও । প্রসঙ্গটা উল্লেখ করলাম এই কারণে যে রাজনীতিবিদ, ইন্দিরা ঘনিষ্ঠ, রাষ্ট্রপতি, কুটনীতিবিদ কিংবা বহু গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রিত্ব সামলানো ক্রাইসিস ম্যানেজার প্রণব মুখার্জিকে নিয়ে আলোচনা করা আমার মতো অর্বাচীনের পক্ষে অন্ধের হস্তী দর্শন মাত্র। তাই এইসব বৃত্তের বাইরের এক রাজনীতিবিদকেই রাজনীতির এক সামান্য ছাত্র হিসেবে খোঁজার চেষ্টা করব।

টানটান টেনশনের জঙ্গিপুরে নির্বাচনী প্রচারে বেরিয়েছেন । ছাত্র পরিষদের কর্মী হিসেবে সম্রাট তপাদারের সাথে আমরা প্রচারে গিয়েছি । প্রার্থী প্রণববাবুর গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আমরা ৷ দেখি গাড়িতে বসে প্রার্থী সুধীন দত্তের শ্রেষ্ঠ কবিতা হাতে নিয়ে নিবিষ্ট পাঠে ডুবে। এই প্রণববাবুকেই চেনার চেষ্টা করেছি বারবার ৷ তাঁর মুখেই শুনেছি... "কলকাতার ছোকরাগুলো যেভাবে লিটল ম্যাগাজিনের পিছনে বাপ-মায়ের টাকার শ্রাদ্ধ করে তা সারা বিশ্বে কোথাও দেখিনি...কী লড়াই যে ছেলে-মেয়েগুলো করে...।" "প্রতিক্ষণ" পত্রিকাটি জন্ম নেওয়ার লগ্নে প্রণব মুখার্জি এবং তাঁর প্রয়াত স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জির নেপথ্য ভূমিকা হয়ত অন্তরালেই থেকে যাবে। কলকাতায় এলেই একটা সময় "প্রতিক্ষণ" দপ্তরে ঢুঁ মারা ছিল মানুষটার নিয়মিত রুটিন।

"প্রতিক্ষণ" -এর পক্ষ থেকে একটা সময় গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে কেন্দ্রীয় বাজেট প্রকাশের পরদিনই বাজেট বিশ্লেষণের আয়োজন করা হত ৷ আলোচনা করতেন ড. ভবতোষ দত্ত। বাংলায় সেই প্রথম বাজেট বিশ্লেষণের রেওয়াজ শুরু, বলাবাহুল্য নেপথ্যে ছিল প্রণব বাবুর উদ্যোগ। এই যে আজ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বাম ও উদার জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলোকে একত্রিত করে একটা কমন প্ল্যাটফর্ম গঠনের চিন্তাভাবনা, সাহিত্য জগতে "প্রতিক্ষণ" বোধহয় তারই সূতিকাগার ছিল এই বাংলায়, যার সেতুবন্ধনের কাজটা প্রণববাবু করতেন। যখনই সময় পেতেন বইয়ের ভিতর ডুবে থাকাটা মানুষটার নেশা ছিল। কংগ্রেস রাজনীতি, দেশ-বিদেশের সমস্যা, কখনও প্রদেশ কংগ্রেসের দায়িত্ব সব কিছু সামলেও এমন স্থিতধী মানুষ খুব অল্প দেখেছি। রাজনীতিতে 'ধী' শক্তির যে প্রয়োজনীয়তা তা তাঁর মধ্যে ছিল, যা যে কোনও তাবড় রাজনীতিবিদের কাছেই ঈর্ষনীয়।

2003 সালে দিল্লিতে N.S.U.I -এর সর্বভারতীয় সম্মেলন "দৃষ্টিকোণ"-এ প্রতিনিধি হিসেবে গেছি, সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে প্রণববাবু "ভারতীয় অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি" নিয়ে বক্তব্য রাখবেন। যেই বক্তব্য রাখতে উঠলেন, শিবাজি স্টেডিয়ামে স্লোগান উঠল "প্রণব মুখার্জি জিন্দাবাদ"। স্পষ্টত বিরক্ত প্রণববাবু বক্তব্য শুরুই করলেন এই বলে... "..কারও নামে জিন্দাবাদ দিলেই সে বেঁচে থাকে না, আবার মুর্দাবাদ দিলেই সে মরে যায় না..।" এই চরম নিস্পৃহতাই ছিল বোধহয় প্রণব মুখার্জির USP ৷ সেবারই ফেরার সময় টিকিটের টাকা নেই। আমাদের তো সম্মেলনে যাওয়া আসার জন্য প্রতিনিধিদের ট্রেন ভাড়া দল দেয় না কোনওদিন । নিজেদেরই ব্যবস্থা করতে হয়। আমরা সম্মেলনের শেষের পর দিন গেলাম তালকোটরা রোডে ওনার বাড়িতে। বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার কাজটা করল সম্রাট তপাদার। প্রণববাবু কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, "এই জন্যই সকালবেলা দল পাকিয়ে আসা হয়েছে? "। এ কথা সে কথার পর বেরিয়ে এলাম, ওমা হঠাৎ দেখি ওনার সিনিয়র আপ্ত সহায়ক এম.কে.মুখার্জি একটা মোটা খাম এগিয়ে দিয়ে বললেন, " দাদা 15 হাজার দিয়েছেন তোদের গাড়ি ভাড়ার জন্য..। " সদ্য তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম হয়েছে ৷ লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসকে পিছনে ফেলে তৃণমূল এগিয়ে গিয়েছে ৷ হতাশাজনক ফল কংগ্রেসের । সেই সময় একটি টি ভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন,... " সাফল্যতেও মাথা ঘোরে না, আবার ব্যর্থতার শূণ্যতাতেও হতাশ হই না.."।

বাঙালিয়ানা নিয়ে প্রণববাবুর একটা চাপা আভিজাত্যই হোক কিংবা শ্লাঘাই হোক, তা আমার নজর এড়ায়নি । একটা ব্যাপার বললে তা স্পষ্ট হবে। তাঁর ইংরেজি উচ্চারণ ছিল একেবারে রাঢ় বাংলার অ্যাকসেন্টে । জীবনে কখনও তা বদলাবার চেষ্টা তিনি আদৌ করেননি । হয়তো তা সচেতন ভাবেই। একবার কথায় কথায় তাঁর মুখে শুনেছিলাম... " একজন বাংলা জানা ইংরেজ কি আমাদের মতো করে বাংলা বলেন..?" প্রণববাবুর মৃত্যুতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বোধহয় শেষ ধুতি পাঞ্জাবি পরা বাঙালির প্রতিনিধিত্বের জার্নিতে ছেদ পড়ল । সেই ছেদরেখা কবে, কীভাবে মুছবে? আদৌ মুছবে কি না? তার উত্তর নিশ্চিতভাবেই সময়ের গর্ভে।

Last Updated : Sep 1, 2020, 2:13 PM IST

ABOUT THE AUTHOR

...view details