কলকাতা, 21 সেপ্টেম্বর : আল কায়দার উপমহাদেশীয় শাখা জামাত কায়দাতুল জিহাদ উপমহাদেশ তৈরির সময়েই বেঁধে দেওয়া হয়েছিল লক্ষ্য । তার মধ্যে অন্যতম ছিল জেলবন্দী জঙ্গিদের মুক্ত করার শপথ । তার জন্য তৈরি করা হয়েছে নীল নকশা । সেটা যে কথার কথা ছিল না, কোরোনা আবহে তা আরও একবার মনে করিয়ে দিয়েছে আল কায়দার শীর্ষ নেতারা । কায়দাতুল জিহাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব স্পষ্ট বাংলায় লিখে পাঠিয়েছে, “প্যানডেমিক কোরোনা ভাইরাস সম্পর্কে সতর্কবাণী ও অসিয়তমালা।" ইতিমধ্যেই গোয়েন্দাদের হাতে এসেছে সেই দলিল ।
মোট 8 পাতার নির্দেশিকা। যেটি পাঠানো হয়েছিল মার্চে । সেখানে একদিকে যেমন রয়েছে জিহাদিদের জন্য বার্তা । ঠিক তেমনভাবেই রয়েছে সম্পদশালী মুসলিমদের প্রতিও নির্দেশ । যেখানে জিহাদিদের প্রতি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বার্তা, “ গুয়াতানামো থেকে হায়ার, তুদমার থেকে আবু সালিম, আবি জালাল... জালিমের কারাগারে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে দশকের পর দশক ধরে নির্যাতিত হচ্ছে তারা । এই বিপর্যয় থেকে আমাদের অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপলব্ধি করতে হবে। কারা-বন্দীদের মুক্তির জন্য আমাদের বাস্তবতার আলোকে পদক্ষেপ করতে হবে ।"
আল কায়দা বা জামাত কায়দাতুল জিহাদ (উপমহাদেশ)-এর মুর্শিদাবাদের জঙ্গি মডিউলে ভারতে হামলার পরিকল্পনা ছিল । মূলত রাজধানী দিল্লিতে হামলার পরিকল্পনা করা হচ্ছিল বলে ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টে জানতে পেরেছিল NIA । তার পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লিতে দায়ের হয় মামলা (RC case no-31/2020/NIA/DLI) । তারপর থেকেই গোয়েন্দারা বিভিন্ন সূত্র মারফত খবর নেওয়া শুরু করেন । সেই সূত্র ধরে মুর্শিদাবাদের নাজমুস সাকিব, আবু সুফিয়ান, মইনুল মণ্ডল, লিউইয়ান আহমেদ, আল মামুন কামাল, আতিউর রহমানকে গ্রেপ্তার করেছে NIA গোয়েন্দারা । কী পদ্ধতিতে নাশকতা, কবে কোথায় সেটি ঘটানো হত সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে টানা জিজ্ঞাসাবাদ করে চলেছেন গোয়েন্দারা । পাশাপাশি, কোন কোন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ছক ছিল তাদের, তাও জানার চেষ্টা চলছে । কারণ গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন , শীর্ষ নেতাদের নির্দেশ ছিল জেল থেকে জঙ্গিদের মুক্ত করার ।
আরও পড়ুন :পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালা থেকে গ্রেপ্তার 9 আল কায়দা জঙ্গি
জঙ্গিদের মুক্ত করার নানা ছক আগেও সামনে এসেছে । এই যেমন জঙ্গিগোষ্ঠী জামাত উল মুজাহিদিনের আমের সালাউদ্দিন সালেহিনের কথাই ধরা যাক । বাংলাদেশে সিরিয়াল বিস্ফোরণে উঠে আসে সালাউদ্দিন ওরফে সালেহিনের নাম। পরে বাংলাদেশ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সে । দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়ায় তিনটি মামলায় তার মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছিল বাংলাদেশ আদালত । 2014 সালের 23 ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশের প্রিজ়ন ভ্যানে তাকে এবং কওশরকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল অন্য জেলে । সেই প্রিজ়ন ভ্যানে পুরোপুরি সিনেমার কায়দায় ঘিরে ধরে করা হয় আক্রমণ । জঙ্গিদের গুলিতে মৃত্যু হয় এক পুলিশকর্মীর । সালাউদ্দিন, কওসর এবং রাকিবুল হাসানকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় জামাত জঙ্গিরা । পরে অবশ্য বাংলাদেশের মির্জাপুরে পুলিশের এনকাউন্টারে মৃত্যু হয় রাকিবুল হাসানের । কিন্তু সালাউদ্দিন এবং কওসর পালিয়ে আসে ভারতে । তারপরই পশ্চিমবঙ্গে জঙ্গিবাদের ইতিহাস বইতে শুরু করে অন্য খাতে । পরে বেঙ্গালুরু থেকে গ্রেপ্তার করা হয় কওসরকে । গোয়েন্দারা জানতে পারেন, বোমারু মিজান ওরফে কওসরকে আদালতে নিয়ে আসার পথে ছিনিয়ে নেওয়ার ছক কষেছিল জামাত-উল-মুজাহিদিন । সেই ছক ছিল জামাতুল মুজাহিদিন ইন্ডিয়ার পরের আমের ইজ়াজ় আহমেদের । সেই মোতাবেক রেইকিও করা হয়েছিল বলে জানতে পারে স্পেশাল টাস্ক ফোর্স । দায়ের করা হয়েছিল মামলাও । সেই ছকের অংশীদার বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ । ওই মামলায় ইজ়াজ়ের নাম ছিল 6 নম্বর অভিযুক্ত হিসেবে । অর্থাৎ জঙ্গিদের ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার ছক চলছেই।
গোয়েন্দারা মনে করছেন, আল কায়দার ছক জামাতের মতো পলকা হবে না । কারণ, এর আগে বড় ঘটনা ঘটিয়েছিল জঙ্গিরা । 1999 সাল । ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট 814 নেপাল থেকে দিল্লির উদ্দেশে রওনা দেয় । বিমানে 176 জন যাত্রী এবং 15 জন ক্রু ছিলেন । সেই বিমানটি ছিনতাই করে । নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান পৌঁছায় । সেখান থেকে জ্বালানি নিয়ে বিমান পৌঁছায় আফগানিস্তানের কান্দাহারে । তখন আফগানিস্তানে রাজত্ব করছে তালিবান । সর্বাধিনায়ক ওসামা বিন লাদেন । কান্দাহারে বিমানটি পৌঁছানোর পরেই স্বমহিমায় ফেরে আল কায়দা জঙ্গিরা । বিমানের জীবিত যাত্রী এবং ক্রু-দের ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে তারা মাসুদ আজহার, মোস্তাক আহমেদ জারগার এবং আহমেদ অমর শহিদ শেখকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় । তারপর থেকে সংসদ ভবন হামলা, মুম্বই হামলা কিংবা পুলওয়ামা হামলা- প্রতিটি ঘটনাতেই উঠে এসেছে মাসুদের নাম ।
আরও পড়ুন :হামলার ছকের বিস্তারিত জানতে চায় NIA, 24 সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ট্রানজ়িট রিমান্ড মঞ্জুর
ভারতের বিভিন্ন জেলে বন্দী রয়েছে আল কায়দা সহ একাধিক সংগঠনের কুখ্যাত সব জঙ্গিরা । ব্যতিক্রম নয় পশ্চিমবঙ্গও । গোয়েন্দারা জানার চেষ্টা করছে জঙ্গিদের ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার ছক কোন পথে সাজাচ্ছে কায়দাতুল জিহাদ ? NIA-এর ধারণা, ধৃত আবু সুফিয়ানদের জেরা করে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যেতে পারে।
কায়দাতুল জিহাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশিকায় রয়েছে সতর্কবার্তাও । তারা ভালোভাবেই জানে সরকার (যাদের মুরতাদ হিসেবে চিহ্নিত করে জঙ্গিরা) এখন কোরোনার কারণে বিপর্যস্ত । আর সেই কারণে, এই সময় আঘাত হানা তাদের জন্য সেরা সময় বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে । লেখা হয়েছে, “ যে ভয়, যে আতঙ্ক তোমাদের উপর আছড়ে পড়েছে, তা আমাদের জন্য এক শুভ সংবাদ । আমরা প্রার্থনা করি আল্লাহ যেন তোমাদের দুঃখ-দুর্দশা আরও বাড়িয়ে দেন । তোমাদের তাঁর ক্ষমতা দেখান এবং খুব দ্রুত তোমাদের ধ্বংস করে দেন।" কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এই নির্দেশ মানতে সব রকম ভাবেই জঙ্গিরা তৈরি হচ্ছিল বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা।