কলকাতা, 3 অগস্ট :ভোট পরবর্তী হিংসার (Post Poll Violence) মামলার শুনানি শেষ হল কলকাতা হাইকোর্টে (Calcutta High Court) ৷ মঙ্গলবার শুনানি শেষ হলেও রায়দান করেনি উচ্চ আদালত ৷ সংবাদসংস্থা জানিয়েছে, আগামিকাল দুপুর আড়াইটে পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে হাইকোর্ট ৷ এই মামলা নিয়ে কোনও পক্ষ যদি নতুন কোনও নথি জমা দিতে চায়, তাহলে ওই সময়সীমার মধ্যে তা জমা দিতে হবে ৷ কবে রায়দান হবে তা জানা যায়নি আদালত ৷
ভোট-পরবর্তী হিংসার এই মামলার শুনানিতে গতকাল, সোমবার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (NHRC) তরফে আদালতে বক্তব্য পেশ করা হয়েছিল ৷ এদিন পাল্টা বক্তব্য পেশ করে রাজ্য সরকার । আইনজীবী অভিষেক মনু সিংভি (Abhishek Manu Singhvi) বলেন, ‘‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (National Human Rights Commission) বিশেষ দলের এই রিপোর্ট একটা ধাঁধার মতো এবং ত্রুটিপূর্ণ । আমরা এই কমিটির দুই তিনজন সদস্যের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছি । সহজ ভাবেই বোঝা যায় যে এঁরা পক্ষপাতদুষ্ট । যদি একজন সদস্যের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ওঠে, তাহলে এই রিপোর্ট খারিজ করে দেওয়া উচিত এবং এই রিপোর্টকে কলুষিত বলে আখ্যা দেওয়া উচিত ।’’
আরও পড়ুন :ভোট-পরবর্তী হিংসা মামলায় অতিরিক্ত হলফনামা জমা দিতে রাজ্যকে অনুমতি হাইকোর্টের
কংগ্রেসের সাংসদ এই আইনজীবীর দাবি, ভোট পরবর্তী হিংসার তদন্তে মানবাধিকার কমিশনের তরফে গড়া কমিটির একজন সদস্য আতিফ রশিদ একজন পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথোপকথনের ভিডিয়ো গত 9 জুলাই তাঁর টুইটার হ্যান্ডেলে আপলোড করেছিলেন । 13 জুলাই কমিটি তার চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করেছিল ৷ কিন্তু কমিটির মনোভাব 9 জুলাই-এর ওই কথোপকথন থেকে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল বলে দাবি অভিষেক মনু সিংভির ।
শুনানিতে তিনি আরও বলেন, ‘‘এই কমিটির অপর একজন সদস্য শ্রীযুক্ত দেশাই সরাসরি বিজেপির সঙ্গে যুক্ত ৷ সেকারণেই পক্ষপাতিত্বের উপযুক্ত কারণ রয়েছে বলে আমরা মনে করছি । এই কমিটি এবং তার রিপোর্ট গোটা প্রক্রিয়াকে কলঙ্কিত করছে । অভিযোগ পত্রের ধরন দেখে মনে হচ্ছে যেন এগুলো আগে থেকেই তৈরি করা ছিল ৷ কমিটির মনোভাব এমন ছিল, যে অভিযোগ আসবে সবটাই রিপোর্টের মধ্যে ঢুকিয়ে দাও ।’’
আরও পড়ুন :মানবাধিকার কমিশনের সদস্যের গেরুয়া যোগ ! টুইটারে সরব অভিষেক মনু সিংভি
তাঁর দাবি, ভোট-পরবর্তী সন্ত্রাস সেটা, যা ভোটের ফল ঘোষণার পরেই হয় ৷ তার একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা আছে ৷ এখানে যে অভিযোগগুলোর কথা বলা হয়েছে, তার বেশির ভাগের সঙ্গে ভোট-পরবর্তী হিংসার কোনও যোগ নেই ৷ একই সঙ্গে মনু সিংভির অভিযোগ, কমিটির সদস্যরা অভিযোগগুলিকে বাংলা থেকে ইংরেজি করার সময় প্রায় সম্পূর্ণ বক্তব্য পাল্টে ফেলেছেন । অনুবাদ করার সময় তৃণমূলী গুন্ডাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে ৷ যেটা এই মামলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে ।
রাজ্য সরকারের এই আইনজীবীর বক্তব্য, ‘‘ইংরেজি অনুবাদে দেখা গিয়েছে যে অভিযোগকারী বলছেন, তিনি ভয়ের কারণে অভিযোগ দায়ের করতে পারেননি৷ কিন্তু আসলে দেখা যাচ্ছে যে পুলিশ বলার পরেও তিনি অভিযোগ দায়ের করতে চাননি এসব থেকেই বোঝা যায় যে বক্তব্যের বিকৃতি ঘটানো হয়েছে।’’
আরও পড়ুন :BJP Documentary : মমতার ‘‘প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন’’ বানচাল করতে হিংসার তথ্যচিত্র হাতিয়ার বিজেপির
আদালতে তিনি আরও বলেন, ‘‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কমিটির কাছ থেকে পুলিশ 1429টি অভিযোগ পেয়েছে ৷ তার মধ্যে 1338টি অভিযোগের উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে পুলিশ । জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বিশেষ কমিটির কাছ থেকে পাওয়া অভিযোগের আগে রাজ্য পুলিশ কী করছিল ? যদি এগুলোকে ভোট-পরবর্তী সন্ত্রাসের অভিযোগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সেক্ষেত্রে পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ থাকছে ।’’
এরপর রাজ্য পুলিশের ডিজির হয়ে সওয়াল করছেন সৌমেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। তাঁর সওয়াল, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বিশেষ কমিটির তরফ থেকে 1979টি অভিযোগ দেওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে 864টি অভিযোগের কোনও তারিখ উল্লেখ করা নেই ৷ যে 52টি খুনের অভিযোগ উঠেছে, তার মধ্যে আটটি ক্ষেত্রে কোনও তারিখের উল্লেখ নেই ৷ যে 72টি ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে, তার মধ্যে বেশ কয়েকটিতে কোনও তারিখের উল্লেখ নেই এবং চারটি ক্ষেত্রে অভিযোগ ধর্ষণ 5 মে-র মধ্যে ঘটেছে ।
আরও পড়ুন :Post Poll Violence : নিহত বিজেপি কর্মীর ডিএনএ পরীক্ষার নির্দেশ কলকাতা হাইকোর্টের
রাজ্যের হয়ে অ্যাডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্ত বলেন, ‘‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বিশেষ দলের অভিযোগ ছাড়াও 268টি ক্ষেত্রে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা রুজু করেছে পুলিশ ।’’ এর পর হাইকোর্ট জানতে চায়, ‘‘আপনাদের স্বতঃপ্রণোদিত অভিযোগগুলি কোন তারিখে করেছিলেন ৷’’ কিশোর দত্ত পালটা বলেন, ‘‘বিস্তারিত তথ্য আমাদের হলফনামায় দেওয়া রয়েছে । পুলিশ যে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ছিল, তেমনটা নয় ৷ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বিশেষ কমিটির সুপারিশ ছাড়া ও পুলিশ এফআইআর রুজু করেছে । নথি দেখেই বোঝা যায় পুলিশের কাছে অভিযোগ এসেছে, তার ভিত্তিতে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে পুলিশ ।’’
অ্যাডভোকেট জেনারেলের এই বক্তব্য শুনে পালটা প্রশ্ন তোলে আদালত৷ জানতে চায়, ‘‘প্রথম দিন থেকে আপনারা বলে আসছিলেন যে এখানে কিছুই হয়নি ৷ তাহলে এই রিপোর্টগুলো এল কোথা থেকে ?’’ কিশোর দত্ত তখন বলেন, ‘‘যা অভিযোগ এসেছে তার 45 শতাংশ ঘটনা 2-5 মে-র মধ্যে ঘটেছে ৷ তার পর অভিযোগের সংখ্যা এক ধাক্কায় অনেক কমে গিয়েছে ।’’ তাঁর আরও দাবি, মানবাধিকার কমিশনের এই কমিটি তার সীমার বাইরে গিয়ে কাজ করেছে ৷ ভোট পরবর্তী সন্ত্রাস কখনও অনির্দিষ্টকাল ধরে চলতে পারে না । নির্বাচনের ফলের সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকতে হবে । খুন-ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রেও পুলিশকে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা রুজু করেছে ।
আরও পড়ুন :Post Poll Violence : কমিশনের রিপোর্ট শুধুই 'হিমশৈলের চূড়া'
তিনি আরও বলেন, ‘‘হ্যাঁ সে ক্ষেত্রেও আমরা মামলা রুজু করেছি এবং আমরা তার তালিকা আদালতে পেশ করব । ভোটের ফলাফলের সঙ্গে সম্পর্ক নেই, এমন বহু ঘটনার উল্লেখ এই রিপোর্টে আছে ৷ যেমন আসল অভিযোগে দেখা যাচ্ছে একটি সোনার হার ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে ৷ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টে তৃণমূল কর্মীদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়া এবং পাগড়ি খুলে ফেলার অভিযোগ লেখা হয়েছে ।’’
সওয়াল-জবাব অবশ্য এখানেই শেষ হয়নি বলে আদালত থেকে জানা গিয়েছে ৷ এর পর বক্তব্য শুরু করেন কেন্দ্রীয় সরকারি আইনজীবী ওয়াই জে দস্তুর । তিনি বলেন, ‘‘আদালত যদি গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে নির্দেশ দেয়, তাহলে আমরা তদন্ত করতে প্রস্তুত ৷ কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যকে সাহায্য করতে প্রস্তুত ৷ আদালত যদি চায় তাহলে এনআইএ (NIA) অথবা সিবিআই-কেও (CBI) তদন্তভার দিতে পারে ।’’
আরও পড়ুন :সাংবিধানিক ব্যবস্থায় বিশ্বাস নেই মমতার, অভিযোগ বিজেপির গৌরবের
তাঁর দাবি, যেহেতু রাজ্য সরকার বলছে যে অনেক অভিযোগে অপরাধের কোনও উল্লেখ নেই ৷ তাই এই ক্ষেত্রে রাজ্যের হাত থেকে তদন্তভার নিয়ে কেন্দ্রীয় কোনও সংস্থাকে দেওয়ার এটাই আদর্শ সময় ৷ তবে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘‘আমি রাজ্যের কর্মদক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না ৷ আমি শুধু অবগত করতে চাই যে কেন্দ্র সাহায্য করতে প্রস্তুত আছে ।’’ এর পর শুনানি শেষ হয় ৷ কিন্তু আদালত রায়দান স্থগিত রেখেছে ৷