পাহাড় ও তরাই অঞ্চলে প্রায় 3 বছর ধরে আপাত শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি থাকার পর ফের নতুন করে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হতে শুরু করেছে । আর তা হয়েছে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার (GJM) প্রাক্তন প্রধান বিমল গুরুঙের আচমকা, নাটকীয় এবং রহস্যজনক পুনর্ভাবির্ভাব ঘিরে । তিনি জনগণের দৃশ্যপটের আড়ালে চলে গিয়েছিলেন 2017 সাল থেকে । ওই সময় তাঁর বিরুদ্ধে রাজ্য পুলিশ কিছু মামলা দায়ের করে । তার মধ্যে কিছু ছিল আনলফুল অ্যাক্টিভিটিস (প্রিভেনশন) অ্যাক্টের অধীনে । আর কিছু মামলা ছিল ভারতীয় দণ্ডবিধির জামিন অযোগ্য বেশ কয়েকটি ধারায় । পুলিশের দ্বারা মামলা দায়ের পর থেকেই বিমল গুরুংকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি ।
গুরুঙের বিরুদ্ধে পাহাড়ে হিংসা ছড়ানোর ষড়যন্ত্রে মূলচক্রী হওয়ার অভিযোগ উঠেছিল । পাহাড়ের ওই হিংসায় সরকার বিরোধী প্রতিবাদে অংশ নেওয়া 11 জন পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছেন বলে অভিযোগ । আর একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইনস্পেক্টর মারা গিয়েছেন । গুরুং দিল্লি, সিকিম, নেপাল ও ঝাড়খণ্ডে লুকিয়ে ছিল বলে খবর পাওয়া যাচ্ছিল । আর তাঁকে একেবারেই প্রকাশ্যে দেখা যায়নি বললেই চলে ।
আইনগত দিকটি ছেড়ে দিলেও গত 21 অক্টোবর গুরুঙের ফের প্রকাশ্যে আসার বিষয়টির মধ্যে আরও একটি তাৎপর্য রয়েছে । আর তা হল প্রকাশ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি সমর্থন প্রকাশ এবং BJP-র প্রতি অনাস্থা ব্যক্ত করা । এটা সেই একই BJP, যাদের তিনি 2007 সাল থেকে সমর্থন করে আসছেন । আর যার ফলে ওই গেরুয়া দলের 2009 সাল থেকে পরপর 3 বার দার্জিলিং লোকসভা আসনে জিততে সুবিধা হয়েছে । এখন গুরুঙের অভিযোগ দার্জিলিং ও পৃথক রাজ্য নিয়ে তাঁদের আশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে BJP ।
- জটিলতা ও তা কীভাবে শুরু হল ?
UPA সরকার অন্ধ্রপ্রদেশকে ভেঙে দেওয়ার এবং নতুন রাজ্য তেলাঙ্গানা গঠন করার যে সিদ্ধান্ত নেয়, তা থেকেই জটিলতা শুরু হয় । এর ফলে সীমান্ধ্র, বোরোল্যান্ড, বুন্দেলখণ্ড, বিদর্ভ ও হরিৎ প্রদেশ গঠনের দাবি নতুন করে উঠতে শুরু করে । কিন্তু এর মধ্যেও গোর্খাল্যান্ডের দাবি সব সময়ই একেবারে আলাদা ছিল । তার প্রথম কারণ হল, এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং দ্বিতীয়ত, এর হিংসাত্মক অতীত ।
উত্তরবঙ্গের গোর্খাদের জন্য একটি আলাদা রাজ্যের দাবি 100 বছরেরও বেশি সময় ধরে হয়ে আসছে । দার্জিলিং পাহাড়ে এই দাবি প্রথমবার উঠেছিল 1907 সালে । তখন এই দাবি তুলেছিল হিলম্যান্স অ্যাসোসিয়েশন অফ দার্জিলিং (HAD) । তারা সেই সময় পাহাড়ের জন্য পৃথক প্রশাসনিক পরিকাঠামোর দাবিতে মোরলে-মন্টি রিফর্মস কমিশনকে স্মারকলিপিও দিয়েছিল ।
এই দাবি ফের ওঠে 1917 সালে । তখন আবার বাংলা সরকার, ভারতের রাজ্য সচিব ও ভাইসরয়কে স্মারকলিপি দেয় HAD । তাতে তারা দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ির জন্য আলাদা প্রশাসনিক পরিকাঠামোর দাবি করেন ।
ব্রিটিশ সরকার এই আবেদন কখনও গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি । আর গোর্খারাও কখনও নিজেদের দাবি থেকে সরে আসেনি । তারা নির্দিষ্ট সময় অন্তর এই দাবি তুলেছে । 1929 সালে সাইমন কমিশনের সামনে এই দাবি তোলা হয়েছিল । 1930 ও 1941 সালে বাংলা প্রদেশ থেকে দার্জিলিংকে বাদ দেওয়ার এবং মুখ্য কমিশনারের প্রদেশ তৈরির দাবিতে সরব হতে দেখা গিয়েছিল । 1952 সালে কালিম্পঙে অখিল ভারতীয় গোর্খা লিগ দেখা করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে । তারা তখন অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও গোর্খা জাতিকে আরও বড়ো পরিচয় দেওয়ার দাবি তুলেছিল । একই সঙ্গে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দাবিও জানানো হয়েছিল । এভাবেই তাদের আবেদন ও প্রতিনিধিত্ব কখনও থেমে থাকেনি ।
কিন্তু সবটাই হয়েছিল অহিংস ভাবে এবং ঝড়ের বিপরীতে একেবারে শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় ।
- আকাঙ্ক্ষার মানে হয়ে উঠল হিংসা
পৃথক রাজ্য হিসেবে গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে হিংসার সূচনা হল 1980 সাল নাগাদ । দার্জিলিং পাহাড়ে রক্তাক্ত পরিস্থিতির সূচনা হয় 1980 সালের 5 এপ্রিল । আর সেই রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের সূচনা করেছিল সুবাস ঘিসিঙের নেতৃত্বে গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (GNLF) । যিনি ছিলেন স্বায়ত্ত্বশাসনের ক্ষমতা সম্পন্ন দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল (DGHC) গঠিত হওয়ার পর 1988 সালের 22 অগাস্ট ওই আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে । কিন্তু তার আগেই কেন্দ্রীয় আধা-সামরিক বাহিনীর ভারী বুটের শব্দে পাহাড়ে নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়েছিল । আর অশান্তির জেরে অন্তত 1200 প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিল ।
সুবাস ঘিসিং ওই কাউন্সিলের তত্ত্বাবধায়ক হয়ে উঠেছিলেন । আর DGHC হয়ে উঠেছিল পাহাড়ের প্রধান কর্তৃপক্ষ । কিন্তু অন্য সমস্ত পরিচায়ক রাজনীতির মতো DGHC এর নেতারা কখনও পুরোপুরিভাবে পৃথক রাজ্যের দাবি থেকে সরে আসেনি । তারা এই দাবি বারবার জানাতে থাকে । আর 2004 সালে ঘিসিং ওই কাউন্সিলকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফশিলে যুক্ত করার দাবি তোলেন ।
- ষষ্ঠ তফশিল নাকি আরও বড়ো কোনও উদ্দেশ্য ?
সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের নিয়ম অনুযায়ী তা ছিল সবচেয়ে ভালো বিকল্প। আর গোর্খাদের স্বায়ত্ত্বশাসনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার পথে স্বতন্ত্র একটি পদক্ষেপ । তাছাড়া এর মাধ্যমে যে কোনও ধরনের বিদ্রোহের সম্ভাবনাকেও প্রশমিত করা যায় । যেমনটি হয়েছে অসমের বোরোল্যান্ড টেরিটোরিয়াল কাউন্সিলের ক্ষেত্রে । এই বিষয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা সহমত হয়েছেন ।
গোর্খাদের জন্য এর ফলে তাঁদের পৃথক রাজ্যের দাবির সঙ্গে আপোস করতে হত । কারণ, সংবিধানে উল্লেখ করা আছে যে যে এলাকা ষষ্ঠ তফশিলের অধীনে চলে আসবে তা ভবিষ্যতে আর কখনও পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা পাবে না ।
একদিকে ঘিসিং পাহাড়ের জন্য ষষ্ঠ তফশিলের দাবিতে সরব হয়েছিলেন । অন্যদিকে তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীরা প্রতিবাদ করতে শুরু করে সংবিধানের ভুল ব্যাখ্যা হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে । শেষ পর্যন্ত কেন্দ্র এই বিষয়টিকে এড়িয়ে যায় ।
এই পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে ঘিসিঙের একনায়কতন্ত্রের মতো কাজকে ঘিরে । তাছাড়া পাহাড়ের রাস্তার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়, পানীয় জলের সংকট দেখা দেয় এবং নিকাশি ও আবর্জনা পরিষ্কারের কাজের নাম নেমে যায় । যার ফলে DGHC এর উপর থেকে মানুষের আস্থা সরে যায় । কাউন্সিলের কিছু সদস্যের ঘিসিঙের সঙ্গে মতবিরোধ তৈরি হয় । আর 2007 সালে GNLF এ ভাঙন অবধারিত হয়ে ওঠে ।
- একটি টিভি রিয়ালিটি শো ও বিমল গুরুঙের উত্থান
GNLF এর মধ্য থেকে যে ব্যক্তিটি নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একেবারে প্রথম সারিতে চলে এলেন, তিনি হলেন বিমল গুরুং । যিনি ছিলেন ঘিসিংয়ের একেবারে বিশ্বস্ত সহকারী ।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে যে ঘটনা বিমল গুরুঙের উত্থানে সাহায্য করেছিল, তা রাজনৈতিক ছিল না । কিন্তু সেটা ছিল একটা টিভি রিয়েলিটি শো । ইন্ডিয়ান আইডল নামে ওই রিয়েলিটি শোয়ে স্থানীয় ছেলে প্রশান্ত তামাঙের সমর্থনে গুরুঙের পিছনে মারাত্মক সমর্থন চলে এল । দার্জিলিং পাহাড়ে মানুষ মিছিল করল ।
তামাং প্রতিযোগিতায় জিতে গেল । আর GNLF ভেঙে গেল এবং বিমল গুরুঙের নেতৃত্বে তৈরি হল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা (GJM) । সেই একই বিমল গুরুং, যাঁর উচিত ছিল DGHC এর অকার্যকারিতার জন্য ঘিসিঙের সঙ্গে দোষ ভাগ করে নেওয়া । কারণ, তিনিও DGHC এর কাউন্সিলর ছিলেন। তাই তাঁরও সমান দায়িত্ব ছিল । কিন্তু এই বিপরীত প্লাবনে নিজের মতো এগিয়ে গেল ।
রাজনীতিতে একটা জায়গা করে নিতে এবং নিজের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে গুরুংয়ের GJM 2009 সালের সাধারণ নির্বাচনে দার্জিলিং লোকসভা আসনে BJP এর যশবন্ত সিংকে সমর্থন করল ।
যশবন্ত সিং জিতলেন । কিন্তু NDA নির্বাচনে হেরে গেল । আর তার সঙ্গে নতুন করে তৈরি হওয়া গোর্খা রাজ্যের স্বপ্নও চাপা পড়ে গেল । পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা সর্বসম্মত ভাবে রাজ্যের যে কোনও রকম বিভাজনের বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নিল । বামেদের কাছে খুব বেশি বিকল্প ছিল না । আর বিধানসভা ভোট এগিয়ে আসছিল । তখন গুরুং সেটাই শুরু করল, যা তিনি সবচেয়ে ভালো পারেন । আর তা হল হিংসা ।
2011 সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গুরুঙের নেতৃত্বে গোরুবাথান থেকে জয়গাঁ পর্যন্ত GJM সমর্থকরা ‘লং মার্চ’ করছিলেন । জলপাইগুড়িতে প্রবেশের মুখে পুলিশ তাঁদের উপর গুলি চালায় । এর পরই পাহাড়ে হিংসা শুরু হয় যায় । আর তার পর টানা নয় দিনের বনধ হয় ।
2011 সালের বিধানসভা নির্বাচনে বাংলা থেকে বামফ্রন্ট বিদায় নেয় । আর আগমন ঘটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের । GJM পাহাড়ের তিনটি আসন দার্জিলিং, কার্শিয়াং ও কালিম্পঙে জয় লাভ করে । আর রাজ্য বিধানসভায় জায়গা করে নেয় । 2011 সালের জুলাই মাসে একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয় GJM, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও কেন্দ্রের মধ্যে । তার মাধ্যমেই কিছুটা স্বায়ত্ত্বশাসনকারী প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ তৈরি হয় । যার নাম গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (GTA) । সেপ্টেম্বরে রাজ্য বিধানসভায় GTA বিল পাস করানো হয় । আর 2012 সালে GTA-র বিভিন্ন পদে নির্বাচন হয় । GJM 17 টি আসনে জয় লাভ করে । আর বাকি 28 টি আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দখল করে নেয় । আর এটা ছিল গুরুং ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের মধুচন্দ্রিমার সময়কাল । আর সব সময়ের মতো এটাও খুব বেশি দিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি ।
মমতার ভিতরের রাজনীতিক জানত যে GJM এর জয়ের পর তাঁকে সমতল ও তরাই-ডুয়ার্স অঞ্চলে নিজের জায়গা তৈরি করতে হবে । না হলে তিনি আরও জমি হারাতে পারেন । বিল অনুযায়ী, ওই এলাকায় সমস্ত স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানের শেষ কথা ছিল GTA । তা সত্ত্বেও মমতা তাঁর মন্ত্রিসভার দুই জন সদস্যকে ওই প্রতিষ্ঠানগুলির কয়েকটির পরিচালক মণ্ডলিতে দিয়েছিলেন, যাতে তাঁরা গোটা পরিস্থিতির উপর নজর রাখতে পারেন । অন্যদিকে সমান্তরালভাবে তিনি নেপালি ভাষায় কথা বলে এমন 15 টি জাতিকে নিয়ে একটি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তৈরি করেন । আর সেখানে অর্থও বরাদ্দ করেন । অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি নিয়মিত হচ্ছিল । গুরুংও এটা জানতেন যে দার্জিলিং পাহাড়ে যদি মমতার তৃণমূল কংগ্রেস জায়গা করে নেয়, তাহলে GJM এর জন্য খারাপ হবে । ফলে মধুচন্দ্রিমা সেখানেই শেষ হয়ে যায় । আর গুরুং GTA থেকে পদত্যাগ করেন ।
তারপর থেকে তিস্তা দিয়ে দ্রুতগতিতে জল বয়ে গিয়েছে । 2016 সালে মমতা দ্বিতীয়বারের জন্য জিতেছেন । আর তৃণমূল কংগ্রেস GJM এর নাকের ডগা দিয়ে মিরিক ও দার্জিলিং পৌরসভার নির্বাচনে জয় লাভ করেছে । আর 2017 সালের 8 জুন যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি দার্জিলিং পাহাড়ে ক্যাবিনেট মিটিং করবেন, তখন পরিস্থিতি একেবারে আয়ত্তের বাইরে চলে গেল ।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজ্যে সরকার পরিচালিত সমস্ত স্কুলে বাংলা ভাষাকে বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব পেশ করে । এর মধ্যে দার্জিলিংও রয়েছে । সেখানেও যদিও অধিকাংশ মানুষ নেপালিতে কথা বলেন । আর এটাই ক্ষোভের আগুনে ঘি দেয় । গুরুং পাহাড় ও তরাই-ডুয়ার্স অঞ্চলে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট ডাকেন ।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কড়া অবস্থান নেন । আর তাঁর পুলিশকে অশান্তির পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পাঠিয়ে দেন । আর তার ফলে একটা রক্তক্ষয়ী অচলাবস্থা তৈরি হয় । যা চলে প্রায় 104 দিন ধরে । এতে সরকারি ও বেসরকারি, উভয় দিকেরই সম্পত্তি নষ্ট হয় । অনেক প্রাণহানিও ঘটে । দার্জিলিং চায়ের মূল্যবান দ্বিতীয় পর্যায় কার্যত নষ্ট হয়ে যায় । কারণ, বাগানগুলিতে কর্মীরা কাজে যোগ দিতে অস্বীকার করেন । গুরুঙের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করা হয় । তাঁর ঘনিষ্ঠ অনুচরদের বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের হয় । এর ফলে বাধ্য হয়ে তাঁরা এবং অন্য GJM সমর্থকরা পালিয়ে যান ।
GJM-এ ভাঙন ধরে । আর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় । একটি অংশের নেতা হিসেবে সামনে উঠে আসেন বিনয় তামাং । যিনি গুরুঙেরই খুব বিশ্বাসী ছিলেন । তামাং আর গুরুঙের আরও এক প্রাক্তন ঘনিষ্ঠ সহকারি অনিত থাপা এখন GTA চালাচ্ছেন । বিক্ষোভ চলার সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের কাছে আলোচনার বিষয়টি খুলে দেন তামাং । তারপর আলোচনা শুরু হয় । আর বিক্ষোভেরও সমাপ্তি ঘটে ।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমর্থন করার যে সিদ্ধান্ত গুরুং নিয়েছে, তা কি পাহাড়ে TMC-র জন্য খেলা ঘুরিয়ে দিতে পারবে ? GJM এর দুইটি বিবাদমান গোষ্ঠী, গুরুং পক্ষ ও তামাং পক্ষ কি নিজেদের মধ্যে সন্ধি করে নেবে ? যদি গুরুং ও তামাং পক্ষ এক জায়গায় চলে আসে আর GJM-র সঙ্গে TMC-র জোট হয়, তাহলে গোর্খা আকাঙ্ক্ষার কী হবে ? দার্জিলিং পাহাড় ও তরাই অঞ্চলের মানুষ কার সঙ্গে থাকবে ? যদি দুই পক্ষই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে চলে যায়, তাহলে কি এটা GJM-র শেষ হবে ? পাহাড়ের বাসিন্দাদের নতুন আকারে গোর্খাল্যান্ডের দাবি তোলার জন্য অপেক্ষা করতে হবে? পাহাড়ে BJP-র কি হবে ?
এই ধরনের অনেক প্রশ্নই শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিঙের রাস্তায় ঘোরাফেরা করছে । কিন্তু অধিকাংশ প্রশ্নেরই এখনও পর্যন্ত কোনও উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না । এখন অনেকটা অপেক্ষার খেলা চলছে । পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিমল গুরুঙের এই পদক্ষেপকে কেন্দ্রে BJP-র সরকার কীভাবে গ্রহণ করবে, সেটাও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ হতে চলেছে ।
1879 সালে যখন ফ্রাঙ্কলিন প্রেস্টাজ দার্জিলিঙে ঐতিহ্যবাহী দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের লাইন পেতেছিলেন, তখন উচ্চতা পরিমাপ করার জন্য তিনি ‘Z-রিভার্স’ নামে এক অভিনব পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন । এই পদ্ধতিতে ট্রেন প্রথমে উপরের দিকে যাবে । তারপর থামবে । এরপর পিছন দিকে উপরের দিকে উঠবে । এভাবে অন্যদিকের উচ্চতায় পৌঁছে যাবে । আর পরবর্তী পর্যায়ের জন্য যাত্রা শুরু করবে । ‘Z-রিভার্স’-র পিছনে মূল ভাবনটা এই রকম ছিল যে যখন সামনে যাওয়া সম্ভবপর হয় না । তখন পিছিয়ে এসে নতুন রাস্তা খোঁজার চেষ্টা করা উচিত ।
দার্জিলিং ও তরাইয়ের সমস্ত পক্ষের জন্য এই ‘Z-রিভার্স’ পদ্ধতিটি চোখ খুলে দেওয়ার মতো বিষয় । এটাই সময় যখন তাদের বুঝতে হবে যে রাজনীতিতে সব সময় সোজা রাস্তায় এগিয়ে যাওয়া যায় না ।