দিল্লি : 20 জন জওয়ানের মর্মান্তিক মৃত্যু ৷ যাঁদের মধ্যে একজন কমান্ডিং অফিসারও রয়েছেন ৷ এই ঘটনা লাদাখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (LAC)-র পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝিয়েছে দেশকে ৷ 1962 সালের পর এটা সম্ভবত ভারত ও চিনের মধ্যে সবচেয়ে বড় সংকট ৷ আর এর ফলে দুই দেশের সম্পর্কে সম্ভবত দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়বে ৷ প্রায়ই সাধারণ মানুষ জানতে চায় যে, এই সমস্যার মূল কোথায়, ভৌগোলিক এলাকা কেমন এবং কীভাবে এই দুই দেশের সেনার মধ্যে এই উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হল ৷ আমি এই বিষয়গুলিই তুলে ধরার চেষ্টা করব ৷
দা LAC
1962 সালের যুদ্ধের সময় চিনা সেনা পশ্চিম লাদাখের 38 হাজার কিলোমিটার দখল করে নেয় ৷ চিনের দখলদারির ফলে ভারতীয় ভূখণ্ডের উপর যে সীমানা তৈরি হয়, তাকেই LAC বলা হয় ৷ যেহেতু LAC ম্যাপে নেই এবং বাস্তবেও কোনও সীমারেখা টানা নেই, তাই দুই পক্ষের এই নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে ৷
ভারত ও চিনের সেনাবাহিনী তাদের মত অনুযায়ী, LAC-তে টহলদারি করে ৷ যে সমস্ত এলাকা নিয়ে বিবাদ রয়েছে, সেখানে দুই পক্ষ প্রায়ই মুখোমুখি লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে ৷ এই ধরনের লড়াই শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করার জন্য একাধিক চুক্তি ও প্রোটোকল রয়েছে ৷ যা দুই পক্ষের জওয়ানদের পথ দেখায় ৷ উদাহরণ হিসেবে, 2013 সালের ‘বর্ডার ডিফেন্স কো-অপারেশন এগ্রিমেন্ট’-এর 4 নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে :
‘‘যে সমস্ত জায়গায় প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা নিয়ে ঐকমত্য নেই, সেখানে দুই পক্ষের মধ্যে মুখোমুখি লড়াইয়ের পরিস্থিতি তৈরি হলে, দুই পক্ষই আত্ম-নিয়ন্ত্রণ করবে । এমন কোনও পদক্ষেপ করবে না, যাতে উত্তেজনা তৈরি হয় । দু'পক্ষই সেনার ব্যবহার করবে না বা সেনার ব্যবহারের হুমকি অন্য পক্ষকে দেবে না । একে অপরকে সম্মান দেবে এবং অস্ত্র নিয়ে লড়াই থেকে বিরত থাকবে ৷ এতে দুই পক্ষই সহমত হয় ৷’’
1975 সালে সীমান্তের একটি ঘটনায় চারজন ভারতীয় জওয়ান শহিদ হন ৷ তার পর থেকে LAC-তে এই কঠোর নিয়ম দুই পক্ষই মেনে চলছে ৷ এই পরিস্থিতি আচমকাই মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে বদলে গিয়েছে চিনের আগ্রাসনের জেরে ৷
চিনের দখলদারির ফলে ভারতীয় ভূখণ্ডের উপর যে সীমানা তৈরি হয়, তাকেই LAC বলা হয় পূর্ব লাদাখের ভূগোল
লাদাখকে উচ্চ-উচ্চতার মরুভূমি বলা হয় এবং পূর্ব লাদাখ তিব্বত মালভূমির পাশেই অবস্থিত ৷ প্যাংগং সো হ্রদ এবং গালওয়ান নদী উপত্যকা 14 হাজার ফুট উপরে অবস্থিত ৷ 15 হাজার 500 ফুট উচ্চতায় রয়েছে উষ্ণ প্রসবন ৷ এই তিনটি এলাকাতেই বর্তমানে চিনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে ৷
সবচেয়ে বেশি উত্তেজনা তৈরি হয়েছে প্যাংগং সো এবং গালওয়ানে ৷ প্যাংগং সো-এর উত্তর প্রান্তে LAC নিয়ে ভারত ও চিন, দুই পক্ষেরই ভিন্ন মত রয়েছে ৷ অতীতে দুই পক্ষই তাদের দাবি মতো এলাকায় টহলদারি করত ৷ চিনের দাবি LAC-এর অবস্থান ফিঙ্গার 4-এ ৷ সেখানে ভারতের দাবি যে, তা আরও পূর্বে ফিঙ্গার 8-এ অবস্থিত ৷ সম্প্রতি, চিন যে এলাকা দাবি করে, সেই এলাকা দখল করে নিয়েছে ৷ আর ভারতীয় সেনাকে তাদের দাবি অনুযায়ী এলাকায় টহল দিতে বাধা দিচ্ছে ৷
গালওয়ান উপত্যকায় LAC ভারতের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ৷ ওই রাস্তা বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু বিমানঘাঁটি দৌলত বেগ ওল্ডি (DBO) পর্যন্ত বিস্তৃত ৷ DBO-তে ও এর সংলগ্ন অঞ্চলে মোতায়েন সেনাদের নিয়ে যাওয়া-আসা এবং তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য এটাই একমাত্র রাস্তা যা দিয়ে আবহওয়ার সমস্ত পরিস্থিতির মধ্যেই যাওয়া যায় ৷ রাস্তা শুরু হয়েছে দারবুক থেকে আর 255 কিলোমিটার দূরে DBO-তে শেষ হয়েছে ৷ 2000 সালে এই রাস্তা তৈরি হয় ৷ কিন্তু শায়োক নদীর উপর কোনও সেতু না থাকায় এটা সেনাবাহিনী ব্যবহার করতে পারছিল না ৷ 2019 সালে একটা স্থায়ী সেতু তৈরি হয় এবং তা প্রতিরক্ষা মন্ত্রী উদ্বোধন করেন ৷ এই রাস্তার একটি কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে ৷ কারণ, উত্তর লাদাখে সহজেই জওয়ান এবং সেনার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দ্রুত এই রাস্তা দিয়ে পৌঁছে দেওয়া যায় ৷
যদি চিন গালওয়ান উপত্যকা দিয়ে LAC-এর এপারে প্রবেশ করে, তাহলে তারা এই গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে ৷ ভারতীয় সেনা শক্তিশালীভাবে আমাদের এলাকায় চিনের অনুপ্রবেশ রুখে দিয়েছে ৷ সেই প্রচেষ্টা চলাকালীনই 15 জুন সংঘাত তৈরি হয় ৷ যাতে 20 জন জওয়ান শহিদ হন ৷
সবচেয়ে বেশি উত্তেজনা তৈরি হয়েছে প্যাংগং সো এবং গালওয়ানে পরিস্থিতি কতটা গুরুতর?
অতীতে অনেক অনুপ্রবেশ হয়েছে ৷ তার মধ্যে বেশ কয়েকটায় উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ৷ যেমন 2013 সালে ডেসপাংয়ে, 2014 সালে চুমারে এবং 2017 সালে ডোকলামে ৷ যদিও সেগুলি ছিল স্থানীয় ঘটনা ৷ আর তা কোনওরকম হিংসা ছাড়াই দুই পক্ষের মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে মিটিয়ে নেওয়া হয় ৷ চিনের বর্তমান পদক্ষেপ একেবারে আলাদা ৷
LAC বরাবর বিভিন্ন সেক্টরে চিনের তরফে প্রচুর পরিমাণ সেনা মোতায়েন করা হয়েছে ৷ আর এটা চিন সরকারের শীর্ষস্তর থেকে অনুমোদন দেওয়ার পরই হয়েছে ৷ চিনের সেনাবাহিনীর তরফে নজিরবিহীন পদক্ষেপ করা এবং দুই সেনাবাহিনীকে পথ দেখানোর জন্য তৈরি সমস্ত প্রোটোকলই ভেঙে ফেলে ফেলা হয়েছে ৷ তার জেরেই হিংসা ছড়িয়েছে ৷
চিনের পদক্ষেপের ফলে যে নিয়ম মেনে ভারতীয় সেনা জওয়ানরা LAC তে কাজ করেন, তা পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেছে ৷ আর তাই আমরা আরও আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখাচ্ছি ৷ এটা সীমান্ত ব্যবস্থাপনার জন্য দীর্ঘমেয়াদী প্রয়োগ ৷ আর আমরা আরও উত্তপ্ত LAC দেখতে পাব অদূর ভবিষ্যতে ৷
এর ফলে ভারত ও চিনের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হবে ৷ আর তা ইতিমধ্যেই প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে ৷ চিন বিরোধী একটা মনোভাব ক্রমশ গোটা দেশের মধ্যে তৈরি হচ্ছে ৷ যে পরিস্থিতিতেই এই সমস্যার সমাধান হোক না কেন, ভারতীয় নাগরিকরা কিন্তু দেশের বিরুদ্ধে চিনের এই সেনা শক্তির দেখানোর বিষয়টি কোনওভাবেই ভুলবে না ৷
LAC বরাবর বিভিন্ন সেক্টরে চিনের তরফে প্রচুর পরিমাণ সেনা মোতায়েন করা হয়েছে